খুলনাকে নিরাপদ ও শান্তির শহর গড়তে নয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, পুলিশের মনোবল বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ ১৭টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একইভাবে পাঁচটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে নগরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গেল ৫ আগস্ট পরবর্তী বিগত চার মাসের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ চিত্র উপস্থাপন করেন পুলিশ কমিশনার মো.
পুলিশ কমিশনার বলেন, “গেল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সারাদেশের ন্যায় খুলনা মহানগরীতেও পুলিশিং ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশিং ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল ও কার্যকর করানোর লক্ষ্যে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কর্তৃপক্ষ নানামুখী পদক্ষেপ নেয়।”
নিরাপদ শহর গঠনে তিনি নিম্নরূপ চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করেন। যথাক্রমে পুলিশ সদস্যদের সক্রিয়তা ও পেশাদারিত্বে ঘাটতি, নাগরিকদের আইন মান্যতায় ঘাটতি, মহানগরীর বেশ কিছু রাস্তার বেহাল দশা, শহর জুড়ে ড্রেন নির্মাণ কার্যক্রমের কারণে রাস্তা কাটাকাটি ও ব্যবহারযোগ্য রাস্তা সরু হয়ে যাওয়া, ইন্ডাস্ট্রি কম থাকায় বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, মাদকাসক্তি ও মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, মাদক কারবারি ও অবৈধ দখলদারিত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, সন্তান মানুষ করার বিষয়ে পিতামাতাদের গাফিলতি ও স্পোর্টস এবং অন্যান্য ইতিবাচক কর্মকাণ্ড কম থাকা।
পুলিশ সদস্যদের মনোবল ও কর্মউদ্দীপনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ। যথাক্রমে থানা, ফাঁড়ি এবং ক্যাম্প ভিজিট করে পুলিশ সদস্যদের সাথে মতবিনিময়, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার আয়োজন, কেএমপি’র সকল ইউনিটে পিঠা উৎসবের আয়োজন, পুলিশ লাইন্সের পুকুর হতে মৎস্য আহরণ করে অর্ধেক মূল্যে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বিতরণ ও পেশাগত কাজে উৎকর্ষতা প্রদর্শনের জন্য নগদ অর্থ পুরস্কার ও সার্টিফিকেট প্রদান।
নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলমান পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করেন পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, “জনগণের সাথে পুলিশের সম্পৃক্ততা বাড়াতে থানা এলাকায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময়, ভোরবেলায় চুরি, ডাকাতি এবং ছিনতাই রোধকল্পে সকাল ৬টায় ট্রাফিক ডিউটি নিশ্চিত করা। ট্রাফিক ও ক্রাইম ডিভিশনের সমন্বয়ে যৌথ চেকপোস্ট কার্যক্রম, ক্রাইমের হটস্পটগুলোতে প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত রেইড। মাদক বিক্রেতা এবং মাদকসেবীদের গ্রেপ্তার, মহানগরীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজদের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
বিগত চার মাসে নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর হতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে খুলনা মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের পাশাপাশি নগরীর পুলিশিং কার্যক্রম পুরোদমে অপারেশনাল কাজে ফাংশন করা শুরু হয়।
এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে ‘নিরাপদ খুলনা’ বিনির্মাণে পাঁচটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, নগরবাসীকে একটি নিরাপদ শহর উপহার দিতে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। চলমান বিভিন্ন কার্যক্রমের বাইরে কেএমপি আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এগুলো হলো- নগরবাসীর মধ্যে নিরাপত্তা-সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ‘অ্যাওয়ারনেস কার্ড’ তৈরি করা হয়েছে। কার্ডটি সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিতরণের সময় বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের সাথে মতবিনিময় করা হবে। এই কার্ড নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াবে। ফলে নাগরিকেরা নিজে থেকেই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সজাগ থাকবেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, চিহ্নিত অপরাধী এবং অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে সার্ভিলেন্স বাড়ানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বাসা-বাড়ি ও অফিসগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য নাগরিকদেরকে উৎসাহিত করা হবে, খুব শীঘ্রই খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় নগরীর ইজিবাইক চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেএমপি কতটুকু সফল- এ প্রশ্ন রেখে পুলিশ কমিশনার বলেন, “পুলিশের সাফল্যের মাপকাঠি আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিকদের অনুভূতি বা ভাবনা। নিরাপত্তা বোধ বৃদ্ধি পেলে ধারণা করা যায় পুলিশ ভালো করছে। গত ৪ মাসে বেশ কয়েকটি বড় আকারের অনুষ্ঠান সাফল্যের সাথে অনুষ্ঠিত করা গেছে। যেমন- দুর্গাপূজা, ইজতেমা, ২৫ ডিসেম্বর, থার্টিফার্স্ট নাইট, কুয়েট ভর্তি পরীক্ষা, এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা ইত্যাদি। পুলিশ কতোটুকু ভালো করতে পারছে সেব্যাপারে নাগরিকরাই সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন করতে পারবেন। তার চেয়েও বড় কথা পুলিশ ভালো কাজ করার চেষ্টা করছে কিনা। পুলিশের আচার আচরণ কেমন? সে আগের মতো মানুষকে হয়রানি বা নিপীড়ন করে কিনা? সে সেবা দিতে অযথা ঘুরায় কিনা? ঘুষ বা অনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় কিনা? মামলা তদন্তে নিরপেক্ষ থাকে কিনা? পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান কিনা ইত্যাদি।”
তিনি বলেন, “পুলিশ যতোই চেষ্টা করুক জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া আইনশৃঙ্খলার উন্নতি খুব বেশি উন্নতি করা সম্ভব নয়। পুলিশ একা চেষ্টা করে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। জনগণের সহযোগিতা দরকার। যৌথভাবে একযোগে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া দরকার। নগরবাসীর মধ্যে আইন মান্যতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। কেএমপি আশা করে নগরবাসীর সহযোগিতা পেলে খুলনা মহানগরকে একটি নিরাপদ শহরে পরিণত করা সম্ভব হবে।”
ঢাকা/নুরুজ্জামান/ইমন
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর স থ ত পদক ষ প ন র পদ অপর ধ ক এমপ নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ অনেকটাই দূর হয়েছে
একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বেশ কিছু অংশীজনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান অংশীজন হলো নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যার দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যেই সংবিধানে তাদের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো সরকার অর্থাৎ সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।
তারপর গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো রাজনৈতিক দল এবং তাদের প্রার্থীরা। রাজনৈতিক দল যদি সদাচরণ বজায় রাখে এবং প্রার্থীরা যদি ছলে-বলে-কৌশলে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার জন্য ব্যাকুল না হন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এখন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে। এ সরকারের আমলে বর্তমান ইসি নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে তারা কোনো দলের প্রতি অনুগত নয় বলেই বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন নিয়ে যে বিরোধ, সহিংসতা এবং বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করছে, তা নির্বাচনী পরিবেশকে অনেকটা কলুষিত করছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
গতকাল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এখন প্রার্থী চূড়ান্ত করার পালা শুরু হবে। এই পর্যায়ে অশুভ প্রতিযোগিতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রতিযোগীরা ছলে-বলে-কৌশলে সর্বশক্তি নিয়োগ করলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই এখন বলটা রাজনৈতিক দলের কোর্টেই।
নির্বাচনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম। নাগরিক সমাজকে ‘ওয়াচডগ’-এর ভূমিকা পালন করে জনগণকে সচেতন ও সোচ্চার করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশের নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ এখন ‘ওয়াচডগ’ না হয়ে ‘ল্যাপডগে’ পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে নাগরিক সমাজকে দুর্বল করা হয়েছে। গণমাধ্যমেও পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়।
সব অংশীজনের মধ্যে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাজনৈতিক দলের। তারা যদি সদাচরণ বজায় রাখে, সহিংসতা থেকে দূরে থাকে এবং নিজেদের মধ্যকার অশুভ প্রতিযোগিতা পরিহার করে, তাহলে নির্বাচনের পথ সুগম হবে।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও তারা সাহসিকতা দেখাতে পারবে কি না—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারা আইনকানুন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত। এরই মধ্যে দেখা গেছে, আরপিও অনুযায়ী তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্যানেল গঠন করে মনোনয়ন দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো দলই এই প্যানেল তৈরি করেনি। এটি সুস্পষ্ট আরপিও লঙ্ঘন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে সন্দেহ ছিল, তফসিল ঘোষণার পর তার অনেকটাই দূর হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় লিপ্ত হলে নির্বাচন নিয়ে আবার অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। একই সঙ্গে যারা পরাজিত বা পলাতক শক্তি রয়েছে, তারাও নির্বাচন ভন্ডুল করার চেষ্টা করতে পারে। যদিও তারা খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর অশুভ প্রতিযোগিতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে পরাজিত শক্তিও সুযোগ পাবে।