চোরতন্ত্র ও সাধুতন্ত্রের মাঝে...
Published: 14th, February 2025 GMT
পৃথিবীজুড়ে কত রকমের সরকার! আমাদের দেশেও দেখেছি নানা আকারের ও প্রকারের শাসন। এখন চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের আমল। এটি অবশ্য দ্বিতীয়বার এসেছে। প্রথমবার এসেছিল ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। তখন সরকারের হাল ধরেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ওই সরকার নির্বাচন দিয়েছিল তিন মাসের মধ্যে। এখন চলছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। কত দিন চলবে জানি না।
দুই অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে একটা ফারাক আছে। প্রথমবার এটি এসেছিল সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সেবার সরকারের ‘পতন’ হয়নি। একনায়ক এরশাদ পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তারপর তাঁকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে দু–দুবার সংবিধান সংশোধন করিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন স্বপদে ফিরে গিয়েছিলেন
গত বছর ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলো। বলা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। প্রচণ্ড এক গণবিদ্রোহে তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সরকার বলতে তখন রাস্তায় ছাত্র-জনতা আর গণভবন-বঙ্গভবনে সেনাবাহিনী। ৮ আগস্ট তৈরি হয় ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। বলা হলো, এ সরকার জমে থাকা জঞ্জাল সাফসুতরো করে নির্বাচন দেবে। সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে ইউনূস সরকারকে বৈধতা দিয়ে দেন।
অন্তর্বর্তী সরকার বলতে আমরা বুঝি দুটি ‘স্বাভাবিক’ সরকারের মধ্যবর্তী সময়ের একটি অস্থায়ী সরকার। এটির দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই এটি অন্তর্বর্তী সরকার। অনুমান করি, এই সরকারের অধীনে একটি সাধারণ নির্বাচন হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি ‘স্থায়ী’ সরকার গঠন করবেন। তখন সবকিছু চলবে শাস্ত্রমতে। শাস্ত্র হচ্ছে সংবিধান। তবে সংবিধান কোনো আসমানি কিতাব নয়। এটি প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী কাটছাঁট কিংবা বানানো হবে। যাঁরা দেশের অভিভাবকত্ব দাবি করেন, এটি তাঁরাই করবেন।
তর্কের খাতিরে ধরে নিই, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। গণতন্ত্রের কথা বলে কিছু ব্যক্তি ও পরিবার সংবিধান যথেচ্ছ কাটাছেঁড়া করে তন্ত্র রেখে গণ বাদ দিয়েছিল। এটাকে আমরা নাম দিয়েছি স্বৈরতন্ত্র। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে হাঁটি–হাঁটি পা–পা করে স্বৈরবাবু যাত্রা শুরু করে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে তার ষোলোকলা পূর্ণ করেছিল। সরকার থেকে ‘আমরা’ উঠে গিয়েছিল। চালু হয়েছিল ‘আমি’।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প চালু হলো। কিন্তু জেঁকে বসল পরিবারতন্ত্র। পর্যায়ক্রমে দুই পরিবারের শাসন, রহমান অ্যান্ড রহমান। ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নির্বাসনে পাঠিয়ে চালু হয় পুরোপুরি রাজতন্ত্র। এর সঙ্গে জুটে যায় নানা বর্ণের মৌ-লোভী স্তাবক-মোসাহেব। তাঁরা তাঁকে বলতেন ‘দেশরত্ন’।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই দেশরত্ন যখন তাঁর বোন আর কয়েকটি স্যুটকেস নিয়ে মন খারাপ করে গণভবন থেকে বেরিয়ে যান, স্তাবকেরা কেউ তাঁকে দেখতে আসেননি। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারলাম, রানির পরিবারের সবাই চোর। তাঁরা গণতন্ত্রকে মাটিতে পুঁতে চালু করেছিলেন চোরতন্ত্র। ১৯৭২ সালে শুরু হয়েছিল সামান্য কম্বল চুরি দিয়ে। শেষ হলো ব্যাংক লোপাট করে।
হাসিনাকে যেতে হবে, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর তাবৎ রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত লেঠেলদের বাইরে তিনি তাকিয়েছিলেন নয়াদিল্লির দিকে। নয়াদিল্লিও বুঝতে পেরেছিল, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া এই ঘোড়ার ওপর নতুন করে আর বাজি ধরা যায় না। হাসিনা এটা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কিছুটা সময় পেয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি তাঁর পরিবার, স্বজন ও কাছের জ্ঞাতি-গুষ্টির লোকেদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন।
সবার শেষে যান তিনি। সঙ্গে বোন আর বোনের দেবর, যাঁর হাতে ছিল সশস্ত্র বাহিনী। নয়াদিল্লি তাঁর ভার আর না বইতে চাইলেও তাঁকে ফেলে দেয়নি। আশ্রয় দিয়েছে পরম মমতায়। এত কিছু পাওয়ার পর এতটা অকৃতজ্ঞ কি তারা হতে পারে? তবে একটা নিশ্চিত তালুক হারিয়ে নয়াদিল্লিরও মন খারাপ। আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না, কীভাবে কী হয়ে গেল। পুরো ম্যাজিকটা বুঝতে আরও সময় লাগবে।
হাসিনার চলে যাওয়াটা ছিল একটা ‘নেগোশিয়েটেড সেটেলমেন্ট’। না গেলে তাঁর বিপদ হতো। যেভাবে লাখো মানুষ চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছিল গণভবনের দিকে, ওই সময় সটকে না পড়লে তাঁর জান যেত। এটা হতো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তি। নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধভাবে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নিঃশেষ করে দেওয়ার ফলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া আর কোনো পথ রাখেননি তিনি। একই ভুল করেছিলেন তাঁর পূর্বসূরি শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশে আগে একটা সরকার ছিল, এটা বোঝা যেত। এখন বোঝা যাচ্ছে না। অথবা আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না সরকারটা কোথায়? এটা কি ওয়াশিংটনে, প্যারিসে, শ্যামলীতে, নয়াপলটনে, মগবাজারে, হাটহাজারীতে নাকি মোনাইয়ের চরে। শাহবাগের চৌরাস্তা এখন পানিপথের ময়দান। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধ হচ্ছে। যাঁর যা দাবি আছে, তা–ই নিয়ে লোকেরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। এটা চাই, ওটা চাই। তাঁরা বলছেন এসব হলো ‘আন্দোলন’। সমস্যা কী? টাকা দেবে গৌরী সেন। গৌরী সেনের তো টাকা নেই। তো টাকা আসবে কোথা থেকে? ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়িয়ে গলায় গামছা দিয়ে গরিব মানুষদের কাছ থেকেই টাকা আদায় করা হবে। ২০ লাখ লোককে পুষতে ১৭ কোটি লোক কাফফারা দেবে। রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার এই এক দায়।
যাহোক, এখন আমরা আছি অন্তর্বর্তী জমানায়। প্রশ্ন হলো, এটা চলবে কত দিন? আমরা জানি, এ রকম টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হলে তার জের চলে অনেক দিন ধরে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে সেন্ট পিটার্সবার্গে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঘটল রুশ বিপ্লব। তারপর গৃহযুদ্ধ চলল কয়েক বছর। স্থিতি আসতে সময় লেগেছিল অনেক। আশপাশের দেশ কম্বোডিয়ায় এটি চলেছে কয়েক বছর। পাশের দেশ মিয়ানমারে চলছে অনেক বছর ধরে।
এটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? চোখে যা দেখছি, মনে হচ্ছে একটা গণরাজ কায়েম হয়েছে। রাজনৈতিক সন্তরা অনেকেই অধীর হয়ে আছেন নির্বাচনের জন্য। ফেলে আসা চোরতন্ত্র আর আগামীর বহু আকাঙ্ক্ষিত সাধুতন্ত্রের অন্তর্বর্তী স্তরে এখন চলছে এক অভূতপূর্ব ‘মবতন্ত্র’। এই মবের মধ্যে আবার অনেক রঙের মানুষ আছেন। এই মব কোনোক্রমেই অবিভাজ্য নয়। এ নিয়ে একদিন হয়তো তৈরি হবে নতুন তত্ত্ব, লেখা হবে নতুন শাস্ত্র। অনেকে এ নিয়ে গবেষণা করবেন। তার তথ্য-উপাত্ত জোগাড়ের আয়োজন চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কিতাব লেখা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। শেষ কথাটি বলা যাচ্ছে না।
এ দেশে বাণী দেওয়ার জন্য পীর-মুরশিদের অভাব হয়নি কখনো। তাঁদের কেউ পলিটিক্যাল, কেউ আধ্যাত্মিক। দেশের এই উথালপাতাল সময়ে বেশ কজন ত্রাতার আবির্ভাব দেখছি। তাঁদের সমর্থকের অভাব নেই। তাঁরা ফতোয়া দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই মব হলো উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এদের রুখতে হবে।
অন্যরা বলছেন, মব বলে গালি দেওয়ার অর্থ হলো পতিত স্বৈরাচারের গণবিরোধী ভূমিকাকে সমর্থন করা। উভয় দলই পরস্পরকে নির্মূল করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। আপনি যে আপনার মতটি নির্ভয়ে প্রকাশ করবেন, তার জো নেই। কিছু একটা বললেই আপনাকে কেউ না কেউ চেপে ধরবে। বলবে, ব্যাটা ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্টের দোসর, সাম্রাজ্যবাদের দালাল, ধর্মদ্রোহী, সুবিধাবাদী। একদল আরেক দলকে বলছে তৌহিদি জনতা কিংবা নাস্তিক। ভিন্নমত মানেই শত্রু। অতএব তাকে ধরে পেটানো জায়েজ।
এরা আমাদের অতিপরিচিত। এদের ঠিকুজি, এদের অতীত আমাদের জানা। তাঁরা আগে কে কোথায় কী বলেছিলেন, কী করেছিলেন, সেসব এখনো স্মৃতিতে রয়ে গেছে তাজা। কী আর করা! শেষমেশ রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় নিয়ে মনে মনে বলি:
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র নয় দ ল ল কর ছ ল ন সরক র র রতন ত র হয় ছ ল পর ব র আগস ট করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
কোনও মহামানবকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মানুষ আন্দোলন করেনি: আমির খসরু
কোনও মহামানবকে বাংলাদেশের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
সোমবার রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, কোনও মহামানব কোনও দেশের গণতন্ত্রের সমাধান দেবে তার জন্য দেশের জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে, এটা বিশ্বাস করার কারণ নেই।
এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় ন্যাপ ভাসানীর সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক উপস্থিত উপস্থিত ছিলেন।
পরে বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে আমজনতার দলের সঙ্গে বৈঠকে করে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। আমজনতার দলের আহ্বায়ক কর্নেল অব. মিয়া মশিউজ্জামানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশ পিপলস পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির পক্ষে বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন।
আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, মানুষ বলতে কারা? আমার বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, যারা জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করছে। যারা রাজনৈতিক দল হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় লড়াই করেছে, আমাদের সঙ্গে যারা রাস্তায় ছিল, ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টি দল, পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের জন্য।
তিনি আরও বলেন, সংস্কারের জন্য যে কথাগুলো বলা হয়, সংস্কারের ব্যাপারে যেখানে ঐকমত্য হবে- সেই সংস্কারগুলো দ্রুত করে নির্বাচন কমিশনকে বলা হোক, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করে রোডম্যাপ দিয়ে ভোটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তো জনগণ বলতে কারা?
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখন জনগণ বলতে যদি কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠী, সুবিধাভোগী- যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে, জনগণের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে গিয়ে গণতন্ত্রকে সংস্কারের মুখোমুখি করছে! এটা তো কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। ১৬ বছরের যুদ্ধটা ছিল গণতন্ত্রের জন্য, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য, জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে আনার জন্য। যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেটা যে সরকারই হোক।