দারিদ্র্যের কশাঘাত পেরিয়ে শতকোটিপতির জীবন যাঁদের
Published: 17th, February 2025 GMT
কুঁড়েঘর থেকে প্রাসাদের মালিক হওয়ার গল্প নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর অনেক মানুষই একসময় একেবারে গরিব ছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসে তাঁরা শতকোটিপতি হয়েছেন বা শতকোটি ডলারের মালিক হয়েছেন।
তাঁদেরই একজন অপরাহ উইনফ্রে। যুক্তরাষ্ট্রের এই জনপ্রিয় টক শো উপস্থাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বের বাল্যকাল কেটেছে সাদামাটা। বাবার সঙ্গে থাকতেন না তাঁর মা। সেই মায়ের সন্তান হিসেবে তেমন একটা সুখকর বাল্যকাল যে তাঁর থাকবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। বাল্যকালে প্রতি ক্রিসমাস বা বড়দিনের উপহারও জুটত না তাঁর।
১২ বছর বয়সে অপরাহ জানতে পারেন, সান্তা ক্লজ নামে বাস্তবে কারও অস্তিত্ব নেই এবং সে বছর মা তাঁকে বলেন, ক্রিসমাস বা বড়দিন উদ্যাপন করার সামর্থ্য তাঁদের নেই। এ কথা নিজের টক শোতে তিনি একবার দর্শকদের উদ্দেশে বলেছিলেনও। একধরনের আতঙ্ক ঘিরে ধরেছিল তাঁকে—সমবয়সীদের বলতে হবে যে সে বছর ক্রিসমাসের গিফট পাননি। শেষমেশ একদল সন্ন্যাসিনী বাড়িতে এসে কিছু খাবার ও পুতুল দিয়ে যান তাঁকে। সেটাই তাঁর জীবনের সেরা ক্রিসমাস উপহার হিসেবে তিনি এখনো মনে করেন।
অপরাহ উইনফ্রের মোট সম্পদমূল্য এখন ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেই যে সন্ন্যাসীরা তাঁকে উপহার হিসেবে পুতুল ও খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রতিদান হিসেবে তিনি এখনো প্রতিবছর লাখ লাখ খেলনা উপহার হিসেবে দান করেন।
আরেক বিখ্যাত নারী পপ তারকা রিহানা। বার্বাডোজে জন্ম নেওয়া এই পপ তারকার বাল্যকাল ছিল খুবই কঠিন। তাঁর বাবা পথের ধারে জামাকাপড় বিক্রি করতেন, কিন্তু মাদক ও অ্যালকোহলে আসক্ত ছিলেন তিনি। এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তিনি—এর মধ্যে আবার ছিল মাইগ্রেনের ব্যথা। চিকিৎসকদের সন্দেহ ছিল, তাঁর শরীরে টিউমার বাসা বেঁধেছে। তবে একবার গায়িকা হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এখন পর্যন্ত তিনি আটটি প্লাটিনাম স্টুডিও অ্যালবাম বের করেছেন। এখন তাঁর সম্পদমূল্য প্রায় দেড় বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি ডলারের বেশি।
স্টারবাকস কফির স্বত্বাধিকারী হাওয়ার্ড শুলজের ছেলেবেলাও ছিল অত্যন্ত করুণ। তাঁর বাবা ছিলেন ডায়াপার বিক্রেতা। শুলজের বয়স যখন সাত বছর, তখন কাজ করার সময় তাঁর বাবা আহত হন। কিন্তু তাঁদের কোনো বিমা বা নিয়মিত আয়ের উৎস ছিল না। ডায়াপার বিক্রির কমিশন থেকেই পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন তাঁর বাবা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিন হাউজিংয়ে বসবাস ছিল শুলজের পরিবারের; কিন্তু এমনো সময় গেছে, যখন তাঁর বাবা বাসাভাড়া পর্যন্ত নিয়মিত দিতে পারেননি।
২০১৯ সালে লেখা আত্মজীবনীতে শুলজ বলেছেন, নর্দার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনি বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করেছেন এবং কখনো কখনো নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করেছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি স্থানীয় একটি ব্র্যান্ড হিসেবে স্টারবাকস কিনে নেন; তখন এর শাখা ছিল মাত্র ১২টি। স্টারবাকসকে তিনি মানুষের ঘর ও অফিসের মধ্যবর্তী একটি স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। উন্নত মানের কফি পরিবেশনের সঙ্গে মানুষকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি; যার ফল তিনি পরবর্তীকালে হাতেনাতে পেয়েছেন। এখন তাঁর সম্পদমূল্য ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৩৩০ কোটি ডলারের বেশি।
কুঁড়েঘরের ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে পরবর্তী জীবনে শতকোটি ডলারের মালিক হওয়া বব পারসনসের জীবন খুবই ঘটনাবহুল। বাল্টিমোর শহরের এক দরিদ্র অঞ্চলে তাঁর জন্ম। তাঁর মা ঘরেই থাকতেন। তাঁদের দেখাশোনা করতেন। একই সঙ্গে তাঁর মানসিক অসুস্থতা ছিল। অন্যদিকে তাঁর বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র বিক্রেতা। তাঁর আবার ছিল জুয়ার অভ্যাস। জুয়া খেলার অভ্যাস থাকলে পকেটে সাধারণত টাকাপয়সা থাকে না। পুরো বিদ্যালয়–জীবনেই বব পারসনসকে সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং দ্বাদশ গ্রেডে তিনি প্রায় ফেল করে বসেছিলেন। এই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন মেরিন সেনার হয়ে যোগ দেন। যুদ্ধ থেকে ফেরেন চারটি মেডেল নিয়ে। যুদ্ধ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি গো ড্যাডি নামের ওয়েব হোস্টিং ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি সেটি বিক্রি করে দেন। বর্তমানে তিনি গলফ ক্লাব ব্র্যান্ড পিএক্সজির স্বত্বাধিকারী। একই সঙ্গে তাঁর মোটরসাইকেলের ডিলারশিপ ও বাণিজ্যিক আবাসন প্রতিষ্ঠান আছে। তিনি যুদ্ধফেরত বয়োজ্যেষ্ঠদের কল্যাণে অনেক অর্থ দান করেন। বর্তমানে তাঁর সম্পদমূল্য প্রায় চার বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার।
আরেক স্বপ্রতিষ্ঠিত শতকোটিপতি ডেভিড মার্ডকের মা–বাবার নিয়মিত উপার্জন ছিল না। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় প্রতিনিধি এবং মা ছিলেন লন্ড্রির দোকানের কর্মী। ১৪ বছর বয়সে তিনি স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। এরপর তিনি এক গ্যাস স্টেশনের ছাদে বসবাস শুরু করে সেখানেই কাজ করা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ১ হাজার ৮০০ ডলার ধার করে ছোট খাবারের দোকান চালু করেন। আবাসন খাতেও বিনিয়োগ করেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন কোম্পানি কেনা শুরু করেন, যেমন কেসেলেন্ট কুক। বর্তমানে তাঁর বয়স ১০১ বছর; ১২৫ বছর বয়স পর্যস্ত বাঁচার ইচ্ছা তাঁর। বর্তমানে তাঁর সম্পদমূল্য ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৩৭০ কোটি ডলারের বেশি।
ক্রিস গার্ডনার নামের মার্কিন স্টক ব্রোকারের ব্যবসায়ীর প্রথম জীবন ঠিক এখনকার মতো ছিল না। নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে এবং কঠোর পরিশ্রমের বদৌলতে তিনি সফল হয়েছেন। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে তাঁকে এক রাত সন্তানকে নিয়ে পাবলিক টয়লেটেও থাকতে হয়েছে। টানা কয়েক মাস তাঁর থাকার জায়গা ছিল না, সকালে সন্তানকে রেখে যেতেন দিবাযত্ন কেন্দ্রে, সেখান থেকে কাজে যেতেন এবং রাতে গৃহহীনদের অ্যাসাইলামে রাত কাটাতেন। কঠোর পরিশ্রম করে একপর্যায়ে তিনি স্টক ব্রোকার হন। এরপর বদলাতে শুরু করে তাঁর ভাগ্যের চাকা। প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্রোকারেজ হাউস। ক্রিস গার্ডনার অবশ্য শতকোটিপতি হতে পারেননি। তাঁর সম্পদমূল্য ৭০ মিলিয়ন বা ৭ কোটি ডলারের ওপরে। তাঁর জীবন নিয়ে পারস্যুট অব হ্যাপিনেস নামে একটি সিনেমা বানানো হয়েছে। এই সিনেমা তাঁকে বিখ্যাত করেছে।
সূত্র: ফোর্বস, সিএনবিসি,
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন নামঞ্জুর
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাত শিশুর জামিন আবেদনের শুনানি হয়। গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সৈয়দ আরাফাত হোসেন তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়। তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। ওই পাঁচজনের জামিন আবেদন করা হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
কারাগার সূত্র জানায়, গত ১৬ জুলাই সংঘর্ষের পর ১৭ ও ১৮ জুলাই জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৮ শিশুকে আটক করে পুলিশ। ১৮ জুলাই তাদের আদালতে হাজির করে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২১ জুলাই তাদের যশোরের পুলেরহাট শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আদালতের নথি অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বয়স, ঠিকানা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই। তবে গতকাল পর্যন্ত ১২ শিশুর নাম ও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আটক করা হয়েছে।
আরও পড়ুনগ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ২৭ জুলাই ২০২৫একজন শিশুর বাবা বলেন, ‘সংসারে অভাব–অনটন, নিজেরাই সংসার চালাইতে পারি না। আমার কষ্ট দেখে ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। সে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রমজান শেখ নামের একটা রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। কাজের সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’
আরেক শিশুর ভ্যানচালক বাবা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কোথাও কোনো কাইজের মধ্যে নেই। তিনডা ছেলে, বড়টা একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ছোট দুইডা এখনো পড়ে। যারে ধরছে, সে সবার ছোট। ওই দিন সকালে আমার মাদ্রাসায় গেছে, পরীক্ষা ছিল। পরে দুপুরের আগে আমি নিজে যাইয়ে নিয়ে আসছি। সেদিন বাড়িতেই ছিল। পরের দিনও সারা দিন বাড়ি ছিল, সেদিন তো কারফিউ ছিল। আসরের নামাজের পর আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে গেছে চটপটি খাইতে। পাশে মাদ্রাসার সামনেই চটপটির দোকান বসে। সেই হান দে ওরে ধইরে নিছে।’
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ধরার ঘণ্টাখানেক পর থানা থেইকা ফোন দিছে, কয় ছেলে ধরা হইছে। আমরা থানায় গিয়া অনেক কইছি, ও তো কোথাও যায় না, কোনো গ্যাঞ্জামের ছেলে না। মাদ্রাসায় পড়ে। কিন্তু কেউ কিছুই শুনল না। ছেলেরে ছাড়ায় আনতে অনেক জায়গায় দৌড়াইছি।’ তিনি জানান, এ ঘটনার পর থেকে তাঁদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
এ ছাড়া জামিনের আশ্বাস দিয়ে কয়েকজন লোক তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় আরও একটি মামলা, আসামি ৪৭৭ জন৩১ জুলাই ২০২৫গ্রেপ্তার এক শিশুর আইনজীবী ফিরোজা বেগম বলেন, ১৬ জুলাই সহিংসতার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় এই শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় দ্রুত তদন্ত করে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি তৌফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুরা অল্প সময় আগে গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনো তদন্ত চলছে। তাই হয়তো বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেছেন। এ মামলায় এখনো কারও জামিন হয়নি।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে সংঘাতের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন ১৮ জুলাই ২০২৫