নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশের সমস্যা তত বাড়বে: তারেক রহমান
Published: 17th, February 2025 GMT
নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশের সমস্যা তত বাড়বে বলে মনে করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশ পরিচালনার দায়িত্ব জনগণ ঠিক করবে, তারা কাদের (দায়িত্ব) দেবে। কাজেই এই বিষয় (নির্বাচন) যত দেরি হবে, আমরা মনে করি, বিভিন্নভাবে ধারণা করি, তাতে করে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত বিভিন্ন গণমাধ্যমের আলোকচিত্র সাংবাদিক ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তারেক রহমান এ কথাগুলো বলেন। আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন মিলনায়তনে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ এ মতবিনিময়ের আয়োজন করে।
বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা আড়াই বছর আগে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। তখন কেউ সংস্কারের কথা বলেনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই স্বৈরাচারের (শেখ হাসিনা) পতন হবে। পতনের পরে যেভাবে তারা দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছে, এর মেরামত প্রয়োজন হবে। মেরামত করতে হলে একটা পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখন যাঁরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছেন, এ কথাটি আমরা অনেক দিন আগে বলেছিলাম।’
৩১ দফার মূল কথা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ—এ কথা উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এর মূল কথা বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রত্যেক মানুষের। যে বাংলাদেশে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার থাকবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে। তিনি বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার যদি প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে তারেক রহমান আরও বলেন, ‘দেশের অনেক মৌলিক সমস্যা আছে, যার একটি বেসিক সমাধানের পরিকল্পনা আমাদের ৩১ দফায় দিয়েছি। আমরা যদি মানুষের সমস্যার সমাধান করতে না পারি, তাহলে উচ্চকক্ষই বলুন, এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হবে না বলুন, আরও যথাযথ ক্ষমতার ভারসাম্য—যত যা–ই বলি না কেন, দিন শেষে মানুষের কোনো উপকার হবে না।’
বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি ‘জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘এ দেশের মূল মালিক বাংলাদেশের জনগণ। কাজেই বাংলাদেশের জনগণের সেই অধিকার আছে এই দেশ নিয়ে কী হবে না হবে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সমগ্র পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, সেটি হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাঁদের মতামত ব্যক্ত করে থাকেন।’
তারেক রহমান বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তারা কী চায়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার জবাব দিয়ে থাকে তারা দেশ সম্পর্কে কী বলতে চায়। আবার রাজনীতিবিদকে তারা কী বলতে চায়, সেটাও তারা নির্বাচনের মাধ্যমে বলে থাকে। জনগণের অধিকার যদি জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হয়, দেশ কীভাবে কী হবে—এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ জনগণের। তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের অধিকার যত দ্রুত জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব, আমি বিশ্বাস করি তত দ্রুত আমরা দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব।’
অনুষ্ঠানে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার আলোকচিত্র সাংবাদিকদের প্রতি সহমর্মিতা এবং সম্মান জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাঁর পক্ষ থেকে আহত সাংবাদিকদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়।
‘আমরা বিএনপি পরিবার’–এর আহ্বায়ক আতিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহসম্পাদক আশরাফউদ্দিন, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম মহসিন, সাধারণ সম্পাদক বাবুল তালুকদার, জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক বুলবুল আহমেদ, তারিফ রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র ক রহম ন ব এনপ র জনগণ র যত দ র র জন ত সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
চীনের উত্থান ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাস্তবতা
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ সম্ভাবনা ক্ষীণ; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার ত্রিসংযোগস্থলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা জটিল করে তুলছে, ঠিক সেই সময়ে যখন চীন কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের রাজধানী আইজলে একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এই রাজ্যে মিয়ানমারভিত্তিক দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা।
চিনল্যান্ড কাউন্সিল (সিসি) কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের চিন রাজ্যে সক্রিয় ছিল। ২০২১ সালে ইন্টেরিম চিন ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কাউন্সিল (আইসিএনসিসি) গঠিত হয়। এটি গঠিত হয় মূলত সিসি-এর কিছু ভিন্নমতাবলম্বী অংশের উদ্যোগে। উভয় গোষ্ঠীই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে– গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে– লড়াই করেছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা গণমাধ্যমকে জানান, চিনের জনগণের সংগ্রামে সহায়তা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এই একত্রীকরণে ভূমিকা রাখেন। একীভূত সংগঠনের নাম রাখা হয়– চিন ন্যাশনাল কাউন্সিল (সিএনসি)।
ভারতের মিজোরামে মিজো, পার্শ্ববর্তী মণিপুরের কুকি, মিয়ানমারের চিন ও তার আশপাশের রাজ্যের চিন জনগণ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায় একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ, যাদের সম্মিলিতভাবে ‘জো জনগোষ্ঠী’ (মিজো-কুকি-চিন সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত নাম) বলা হয়। আন্তর্জাতিক ও প্রাদেশিক সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত হলেও তাদের মধ্যে একটি গভীর জাতিগত বন্ধন বজায় আছে। তবে একটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের ঐক্য গড়ার পদক্ষেপ নেওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত মিয়ানমার নিয়ে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারত জান্তা সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দিল্লিতে গণতান্ত্রিক বিরোধী পক্ষের সদস্যদের একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মেইতেই ও নাগা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ মণিপুর ও মিয়ানমারভিত্তিক কুকি-চিন বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে। এই কুকি-চিন বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালাচ্ছে মিয়ানমারভিত্তিক মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর। মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো আবার জান্তা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে চলছে।
লালদুহোমার দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জো জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে– ভারত কি জো জাতিগোষ্ঠীভুক্ত চিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করছে, যে বিদ্রোহীরা বর্তমানে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে?
এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। অভ্যুত্থানের পর তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ জান্তা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দেয়। মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর জন্য এক কূটনৈতিক সংকটে পরিণত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি : ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতপন্থি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হওয়া এবং তাতে ভারতের কৌশলগত পরিবেশ আরও জটিল হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত স্পষ্টভাবে হাসিনাপন্থি অবস্থান নিয়েছে। তিনি ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এখন চীনঘেঁষা নীতি নিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে তাঁর চার দিনের চীন সফরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা স্পষ্ট। ঢাকা থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূস সরকারের ওপর মার্কিন প্রভাবও বাড়ছে।
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি সফল করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। কারণ এই নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগ জোরদারে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি সীমান্তবর্তী মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনঃসংগঠনের ইঙ্গিত আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করছে।
সতর্ক কৌশলের প্রয়োজন
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এক জটিল ভূকৌশলগত এলাকা। যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়াবলির সীমানা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত এই অঞ্চল। অঞ্চলটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, পরিবেশ ও ভূপ্রকৃতিগতভাবে সংবেদনশীল। রাজনৈতিকভাবেও জটিল। ফলে এখানে নিরাপত্তা, কৌশলগত ও মানবিক সমস্যা সব ঘনীভূত।
ভারতের পশ্চিম সীমান্তে মূল উদ্বেগ পাকিস্তান ও পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খেলোয়াড় অনেক। তাদের স্বার্থও পরস্পরবিরোধী। বহু জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের স্বার্থ-সংঘাতে এই অঞ্চল প্রায় স্থায়ীভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতে সম্ভবত আর কোনো অঞ্চলেই অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সীমান্তবর্তী জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি, তাদের জাতিগত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের মিশ্রণ এখানে জটিল আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা তৈরি করেছে। এই অঞ্চল সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এখানে একটিও ভুল সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। পরে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই অনিশ্চয়তার নতুন অধ্যায়। গণতন্ত্রপন্থিরা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গঠন করে। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এটি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দেশটি জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে ভারতের সীমান্তবর্তী অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মণিপুর ও মিজোরামের সীমানায় অবস্থিত চিন রাজ্যে সিএনএ, সিডিএফ ও কেএনএর মতো জো জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে জান্তা বাহিনী। এসব গোষ্ঠী পিডিএফের মিত্র হিসেবে নিজেদের জো জনগণের প্রতিনিধি বলে দাবি করে থাকে।
চিন রাজ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর এর প্রভাব পড়ে ভারতে। মিজোরাম ও মণিপুরে শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়। মিজোরামে, যেখানে জো-জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মণিপুরে জো ও নাগা দুটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, শরণার্থী আগমনের ফলে রাজ্য জনসংখ্যার ভারসাম্য হারাচ্ছে। মেইতেই সম্প্রদায় অনুপ্রবেশকারী বহিষ্কারের দাবি তোলায় জো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ে।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই ও জো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এতে মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়। এই গোষ্ঠীকে এক সময় ভারত দমন করেছিল।
ভারতের মিয়ানমার সীমান্তে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলাচল ঠেকাতে ভারত ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’-এর পরিসর সীমিত করেছে। ‘প্রটেকটেড এরিয়া রেজিম’ পুনর্বহাল করেছে। সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণ শুরু করেছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো জো ও নাগা জনগণের ঐতিহ্যবাহী আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ইম্ফলভিত্তিক এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব সিদ্ধান্তে মেইতেইদের মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঠেকানো নিয়ে আশ্বাস তৈরি হলেও, জো ও নাগা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তা ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের বহু মানুষ অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বিদ্রোহীদের মোকাবিলা
২০২৫ সালের মে মাস নাগাদ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগালিমের (এনএসসিএন-আইএম) অন্যতম নেতা ইকাটো চিশি সিউ মিয়ানমারে চলে যান। যেখানে তিনি এইচ এস রামসান ও অ্যাবসালম রামান নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ দেন বলে জানা যায়। এই পদক্ষেপ নাগা শান্তি আলোচনাকে বিপদের মুখে ফেলে। একই সঙ্গে নাগা সশস্ত্র সংগ্রামের পুনরুত্থান নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়।
এনএসসিএন-আইএম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী– যা নাগাল্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এরা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়। ভারত থেকে স্বাধীনতার দাবিতে গঠিত হলেও, তারা ১৯৯৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে। বর্তমানে তারা বৃহত্তর নাগাল্যান্ড দাবি করছে, যেখানে আসাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত। তবে ওই তিন রাজ্যই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এক আদালতে দাবি করে, এনএসসিএন-আইএমের মিয়ানমারভিত্তিক চীন-মিয়ানমার মডিউল নিষিদ্ধ মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাংলেই ইয়াউল কানবা লুপ (কেওয়াইকেএল) এবং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) সহায়তা করে ভারতে অনুপ্রবেশ করাতে। যেন তারা জো জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে। কেওয়াইকেএল এবং পিএলএ মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকাভিত্তিক সাতটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। গোষ্ঠীগুলো ভারত থেকে আলাদা হতে চায়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি রয়েছে।
এনআইএর এই অভিযোগে নাগা ও মেইতেই উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এনএসসিএন-আইএমের দাবি, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কুকিদের পক্ষ নিচ্ছে। এরপর ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। তবে সিউর পদক্ষেপ আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতাকারী এনএসসিএন-কে (ইয়ুং অং) এখনও মিয়ানমারের নাগা স্বশাসিত অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। এই অঞ্চল ভারতের নাগাল্যান্ড ও চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তঘেঁষা।
মিয়ানমারের সাগাইং, চিন ও রাখাইন রাজ্যে ভারতের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা প্রায়ই মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে। জো জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) চিন ও সাগাইংয়ে সক্রিয়। এরা জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) সহযোগিতা করে। কেআইএর সঙ্গে এনএসসিএনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কেএনএ ও কেআইএ উভয়েরই রাখাইনভিত্তিক আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।
জোমি রেভলিউশনারি আর্মি (জেডআরএ) চিন ও সাগাইং অঞ্চল থেকে পরিচালিত হয় এবং মিয়ানমারের চিন ন্যাশনাল আর্মির (সিএনএ) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সিএনএর সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে লালদুহোমার জোরাম পিপলস মুভমেন্টের (জেডপিএম) কাছে ক্ষমতা হারায় এমএনএফ। এমএনএফেরও আরাকান আর্মির সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে জোমি রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন (জেডআরও), যা চিন রাজ্যে সক্রিয়, তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করে। মণিপুরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিএলএ সাগাইংয়ে সক্রিয় এবং জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা-ইন্ডিপেন্ডেন্টেরও (উলফা-আই) মিয়ানমারে ঘাঁটি রয়েছে। তারা বিদ্রোহবিরোধী কর্মকাণ্ডে জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করে বলে জানা যায়।
ইম্ফলভিত্তিক সাংবাদিক প্রদীপ ফানজৌবমের মতে, মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতীয় বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। অথচ সরকারের অবস্থান এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। ‘আমরা নতুন নতুন সমীকরণ ও পুনর্গঠনের খবর পাচ্ছি,’ বলেন তিনি। ‘সরকার কী অনুমোদন করবে আর কী করবে না– তা এখনই ঠিক করতে হবে। অথচ এখনও আমরা সেই পুরোনো কৌশলই দেখছি। এক গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আরেক গোষ্ঠীকে দমন করার খেলা।’
একসময় ভারত ও মিয়ানমার যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়ে এনএসসিএন-কে, উলফা-আই, পিএলএ, জেডআরএ এবং কেএনএর ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ায় এ ধরনের যৌথ অভিযানের সুযোগ কম। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শীতলতাও সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলেছে।
চীনা চ্যালেঞ্জ
ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা এলেও সীমান্ত পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। উভয় দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) পাশে সামরিক ও নাগরিক অবকাঠামো নির্মাণ করছে। চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর ‘বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ’ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ভারত আশঙ্কা করছে, এই বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে চীনের পদক্ষেপগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চীন বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি ব্যবহারসহ নানা কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত হতে চাইছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার চাইছে। মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি এতটাই বেড়েছে যে গণতন্ত্রপন্থিরা জান্তা সরকারকে ‘চীনা ক্রীড়নক’ বলেও আখ্যায়িত করছে। কিছুটা পশ্চিমা সমর্থনও পাচ্ছে তারা।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) এখনও একটি মূল অগ্রাধিকার। কিয়াওকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার আরও সহজ হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকার একটি আইন পাস করেছে– পাবলিক সিকিউরিটি সার্ভিসেস ল। এর মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় চীনের নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় হতে পারবে। এমনকি দেশটি চীনা নববর্ষকে জাতীয় ছুটি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।
সম্ভবত এরই প্রতিদানস্বরূপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৯ মে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে মিয়ানমারের জান্তা নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বোঝায়, চীন ও রাশিয়া তাদের পাশে রয়েছে। ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, এই সাক্ষাৎ রাশিয়ারও চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে অবস্থান সাযুজ্যের ইঙ্গিত দেয়। চীন ও রাশিয়া দুটোই মিয়ানমার জান্তার অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।
এর আগে চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি অ্যালায়েন্স আর্মিকে (এমএনসিএএ) শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লাশিও শহরটি জান্তার কাছে হস্তান্তরের জন্য রাজি করায়। এই শহর চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে, তারা যেন সিএমইসির রুটের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে দূরে থাকে। তবে জান্তা সরকারের প্রতি চীনের স্পষ্ট সমর্থন বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর কাছে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের কিছু অংশে চীনবিরোধী মনোভাব বাড়ছে ক্রমশ। v
সৌজন্যে: আউটলুক ম্যাগাজিন, ১ জুন ইস্যু