নতুন আরও সাতজন সদস্য নিয়োগ দিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, পররাষ্ট্র ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাব্বির আহমদ চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মো.
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৩৮(১) অনুচ্ছেদে দেওয়া ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি তাঁদের এ নিয়োগ দিয়েছেন। সংবিধানের ১৩৯(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, সদস্যরা দায়িত্বভার গ্রহণের তারিখ থেকে ৫ বছর বা তাঁর ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার মধ্যে যা আগে ঘটে, সে কাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য পদে বহাল থাকবেন।
আরও পড়ুনরোমানিয়ায় বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা, সুযোগ-সুবিধা ও আবেদনের পদ্ধতি জেনে নিন১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি পিএসসিতে নিয়োগ পাওয়া ছয় সদস্যের নিয়োগের আদেশ শপথ গ্রহণের আগেই বাতিল করা হয়। পিএসসির একটি সূত্র তখন প্রথম আলোকে বলেছিল, নতুন নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার কারণে তাঁদের শপথ স্থগিত করা হয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন সদস্য বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় এই সমালোচনা হচ্ছিল। যাঁদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন অধ্যাপক শাহনাজ সরকার, মো. মুনির হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ, মো. মিজানুর রহমান, শাব্বির আহমদ চৌধুরী ও অধ্যাপক সৈয়দা শাহিনা সোবহান।
আরও পড়ুনবিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য বিধিমালা চূড়ান্ত পিএসসির১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মওদুদ আহমদের স্বস্তি-অস্বস্তির আত্মজীবনী
মওদুদ আহমদ হতে পারতেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ‘ভূমিপূত্র’। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী, তারপর তাঁর সচিব, জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, এরশাদ আমলে উপরাষ্ট্রপতি—ঐতিহাসিক সংশ্লিষ্টতায় ঈর্ষণীয় এক ক্যারিয়ার তাঁর। কিন্তু রাজকাহিনিতে প্রিয় পুত্র যেমন ত্যাজ্যপুত্র হয়, তেমনি তাঁর কপালেও জুটেছিল প্রিয় থেকে অপ্রিয় হওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া মওদুদ আহমদের আত্মজীবনী চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৯১ থেকে ২০১৯ বইটি এসবেরই এক অম্লমধুর ধারাবিবরণী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যক্ষদর্শীর এক মহাবিবরণী যেন তাঁর আত্মজীবনীর শেষ পর্ব। শুরুতে যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবিভক্ত ভারতের কলকাতার স্মৃতি পাওয়া যায়। খিদিরপুর ডকে দেবেন্দ্র ম্যানশনে থাকার সময় জাপানিদের বোমাবর্ষণের স্মৃতি আর বইটি শেষ করেছেন শেখ হাসিনার শাসনামলের বর্ণনা দিয়ে।
চিন্তাচর্চায় স্বতন্ত্রমওদুদ আহমদের জীবন ও সমসাময়িক কাল ও স্থান সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল এবং তা মেনেই তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেছেন। তাঁর এই অনুশীলনের কেন্দ্রে ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। অনেক রাজনীতিক ও আমলাকে দেখা যায়, অবসরে যাওয়ার পর তাঁরা লেখালেখিতে ব্যস্ত হন। আইন ও রাজনীতি পেশার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য মেনে তিনি অবসর নেননি।
মওদুদ আহমদের প্রথম বইয়ের প্রকাশকাল বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পেশাজীবনের অভিজ্ঞতাকে লেখায় অনুবাদ করেছেন মধ্যজীবন থেকে। লেখালেখি তাঁকে অন্য রাজনীতিকদের চেয়ে পৃথক করেছে।
রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী মওদুদ আহমদ তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় সক্রিয় ছিলেন চিন্তাচর্চাকারী হিসেবে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জীবনব্যাপী যা কিছু লিখেছেন, তা বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে বলা যায় ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাভাষ্যকার’।
মওদুদ আহমদের একাধিক বইয়ের সঙ্গে অনুসন্ধানী পাঠক তাৎপর্যপূর্ণভাবে তাঁর শেষ বইটিকে আলাদা করতে পারবেন। কারণ, এখানে তিনি পাঠককে তাঁর একান্ত ব্যক্তিজীবন সম্পর্কেও জানাতে চেয়েছেন। এর আগে তাঁর অন্য লেখার প্রধান ক্ষেত্র ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি। আর শেষ বইতে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে জড়িত ইতিহাসের ওপরও আলো ফেলেছেন।
আত্মজীবনীর ‘অস্বস্তি’আত্মজীবনী কখনো কখনো অস্বস্তি উৎপাদন করে। যে কারণে অনেকেই জীবদ্দশায় এর প্রকাশ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকেন না। অছিয়ত করে যান, মৃত্যুর পর প্রকাশের। মওদুদ আহমদ তাঁর এই বই প্রথমা প্রকাশনকে দেওয়ার আগে আরও দুটি প্রকাশনীর কাছে দিয়েছিলেন। ‘ঝুঁকি’ বিবেচনায় তাঁরা অপারগতা দেখায়; কিন্তু প্রথমা এ ব্যাপারে সাহসিকতা ও পেশাদারত্ব দেখিয়ে তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে বিপুলায়তন বইটির নির্ঘণ্ট যুক্ত হলে তা আরও পূর্ণতা পেত।
২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় হয় মওদুদ আহমদের বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ: ২০০৭-২০০৮ বইটি। এতে তিনি ‘এক-এগারো’র সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন। আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনে প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের অভাব নিয়ে।
মওদুদ আহমদের এমন পর্যবেক্ষণে তাঁর দলেরই নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মওদুদ বলেন, ‘সমস্ত বইয়ে চেষ্টা করেছি বস্তুনিষ্ঠভাবে দেশের ইতিহাস তুলে ধরতে। আমি তো এই বই বর্তমানের জন্য লিখিনি। এটা তো ভবিষ্যতের জন্য লিখেছি।’ (প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
মওদুদ আহমদের এই আত্মজীবনীর ব্যাপ্তি প্রায় আট দশক। তিনি তুলে এনেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চরিত্র ও ঘটনা। তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজনীতি ও আইন পেশা। স্বভাবতই এই দুটি বিষয় তাঁর আত্মজীবনীর বেশ বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। অন্য বিষয়গুলো তিনি কেবল ছুঁয়ে গেছেন।এর আগে তাঁর লেখা আ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ বইটি নিয়েও ২০১৩ সালে তাঁর দলের মধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন মওদুদ আহমদ। ওই সময় বইটির অংশবিশেষ আলোচনায় এনে তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল দলের নিজের একটি অংশ।
অন্য অনেক রাজনৈতিক নেতার কপটতার বিপরীতে মওদুদ আহমদ তাঁর লেখালেখিতে অন্তত অকপট ছিলেন—রাজনীতিসচেতন পাঠকেরা এমনটাই বলে থাকেন। চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৯১ থেকে ২০১৯ বইটিও ব্যতিক্রম নয়।
অখণ্ড সময়ের খণ্ড স্মৃতিচিহ্নবাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও লেখকদের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, আন্দোলন–সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, ঘটনা ও বিশ্লেষণে বিশেষ কোনো ব্যক্তি কিংবা নিজের ভূমিকাই প্রকট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে আমরা কদাচ ভারসাম্য দেখি। আর আত্মজীবনী হলে আমিত্বকে দূরে রাখা যায় না; বরং সেটিই চালক হয়ে ওঠে। তবে মওদুদ আহমদ তাঁর এই ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত সব বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে মওদুদ আহমদ অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছিলেন। এ ছাড়া একজন কৃতবিদ্য আইনবিদ ও সংবিধানবেত্তা হিসেবে তিনি সমকালীন বিশ্ব, সমাজ, রাজনীতি ও উন্নয়ন চিন্তা–সম্পর্কিত নানা বইয়ের নিয়মিত পাঠক ছিলেন তিনি। চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৯১ থেকে ২০১৯ বইটি পড়লে পাঠকেরা সেগুলোর একটি দারুণ অভিজ্ঞতা পাবেন।
বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতোই জেলজীবন ও মুক্তজীবনের মধ্যে শাটল কর্কের মতো আসা-যাওয়া ছিল মওদুদ আহমদের। ১৫ বছর বয়সে প্রথম তিনি জেলজীবন বরণ করেন; সেটি ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পর একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচিতে পতাকা উত্তোলনের জন্য।
মওদুদ আহমদ