র্যাবের নাম ও পোশাক বদলানো হচ্ছে, প্রয়োজনে নতুন করে গঠন
Published: 19th, February 2025 GMT
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নাম ও পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। নাম পরিবর্তনের একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিকে। প্রয়োজনে র্যাবকে নতুন করে গঠন করা হবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির পরবর্তী সভায়। এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে.
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সপ্তম সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকস চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ছিলেন। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন তিনি।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর যে তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশও রয়েছে। র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করে আসছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
র্যাবের বিলুপ্তি চেয়েছে বিএনপিও। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ র্যাবের অতীত কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেন। ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে পুলিশের এই বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। বিএনপির আমলে গঠিত এই বাহিনীকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্ত করতে চায়, প্রশ্ন করা হলে হাফিজ উদ্দিন আহমদ তখন বলেছিলেন, এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে, যখন একেবারে গ্যাংগ্রিন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
র্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে র্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে গতকালের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় আলোচনা হয়। সবার বক্তব্যে উঠে আসে গত ২০ বছরে র্যাব ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বহু মানুষকে গুম, খুন করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছে। যে কারণে এলিট ফোর্সকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ভবিষ্যতে সংস্থাটি যাতে একই অপরাধে না জড়ায়, সে জন্য ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, তুরস্কের মতো দেশে এ ধরনের এলিট ফোর্স কীভাবে কাজ করে, তা পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে আরও উন্নতি করতে হবে। আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনারা প্রতি সভাতেই একই কথা বলছেন। আসলে কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে? জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা গণমাধ্যমে দেখছেন কতটা উন্নতি হচ্ছে। আপনারাই বলবেন উন্নতি হচ্ছে কি না।’
গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরায় রামদা দিয়ে প্রকাশ্যে এক দম্পতিকে কোপানোর ঘটনা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জানতে চান সাংবাদিকেরা। উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেউ অপরাধ করার পর যদি আমরা অ্যাকশনে না যাই, তখন বলতে পারতেন যে আমরা কাজ করছি না।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দাবি করেন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, ছিনতাই আগের চেয়ে কমেছে। তবে সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি করা যায়, সভায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া শুনতে শুনতে তাদের মূল যে কাজ, সেটা না করে অন্য কাজে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের শক্তি কমে যাচ্ছে।’ তিনি দাবিদাওয়ার বিষয়ে আন্দোলনকারীদের নির্দিষ্ট জায়গায় অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনগণের ভোগান্তি কেউ চায় না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক র ন ত উপদ ষ ট পর স থ ত কম ট র
এছাড়াও পড়ুন:
মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা ভিন্ন
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিস্তর অভিযোগ ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, বেআইনি আটকসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ধ্বংস করে সেগুলোকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ গুম ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে, সেটি নিশ্চিতভাবেই ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। কিন্তু এ সরকারের ১৪ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, মব সহিংসতায় মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও সমানভাবে উদ্বেগজনক।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’–এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ মাসে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি—৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল; আর গত তিন মাসে ঘটেছে ১১টি। ৪০ জনের মধ্যে গুলিতে মারা গেছেন ১৯ জন, নির্যাতনে মারা গেছেন ১৪ জন, পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। গত তিন মাসে যে ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন; সেখানে পুলিশ, যৌথ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) অক্টোবর মাসের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে কারা হেফাজতে যেখানে ৮ জন মারা যান, এক মাস পর সেখানে ১৩ জন মারা গেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর এই তথ্য যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়, একই সঙ্গে জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করে। মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি আর মাঠের বাস্তবতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, সেই চিত্রই পরিষ্কার করে তুলে ধরে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে মব সহিংসতা ও রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানও দিয়েছে অধিকার। এ সময়ে মব সহিংসতায় ১৫৩ জন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৮১ জন নিহত হয়েছেন। এমএসএফ জানাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে ৫২টি ও অক্টোবর মাসে ৬৬টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কোনো পরিসংখ্যানই স্বস্তিদায়ক নয়। এই চিত্র সরকারের দুর্বলতা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতারই প্রতিচ্ছবি। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ও ভারত থেকে পুশ ইন ঠেকাতে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক চর্চার বাইরে গিয়ে দেখার অবকাশ নেই। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে লেখা খোলাচিঠিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক ছয়টি মানবাধিকার সংগঠন, ছয়টি নির্বিচার গ্রেপ্তার বন্ধ এবং গ্রহণযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার ও খারিজের আহ্বান জানিয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যুর মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের লাগাম টানতে হলে অবশ্যই সবার আগে বাহিনীগুলোর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কারের প্রশ্নটি সে কারণেই সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর তাদের সুপারিশে র্যাব বিলুপ্তি এবং বিজিবিকে সীমান্ত রক্ষা ও ডিজিএফআইকে সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া বাস্তবে কোনো সংস্কার করতে পারেনি। ফলে নির্বাচন–পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের আমলেও বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।
শুধু প্রতিশ্রুতি আর কথায় নয়, বাস্তবেও মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যুর অবসান হতে হবে।