দলগুলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব হবে: আলী রীয়াজ
Published: 20th, February 2025 GMT
জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাসসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে বড় পরিসরে এটি (সংস্কার) করা সম্ভব। এটি অসম্ভব নয় এবং আমি আরও আশাবাদী। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রীয়াজ বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত’, যদিও অনেকেই এ বিষয়ে ‘খুবই হতাশাবাদী’ এবং কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পড়ানো এই শিক্ষাবিদ বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বাংলাদেশের জনগণও ভোটের অপেক্ষায় আছে। কারণ, তারা গত ১৭ বছরে ভোট দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি আদর্শ রূপরেখা। আমি মনে করি, (সংস্কারের মাধ্যমে) নির্বাচন সম্ভব। কারণ, এই মুহূর্তে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিকরাও ভোট দিতে চায়।’
রীয়াজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার অন্তর্বর্তী সরকার ‘যতটুকু প্রয়োজন তার একদিনও বেশি ক্ষমতায় থাকতে চায় না।’
সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থাসহ প্রধান খাত বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছয়টি কমিশনের সংস্কার সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছিল।
১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করার সময় ঐকমত্য কমিশন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক, সাংবিধানিক এবং নির্বাচনী সংস্কার এজেন্ডায় ঐকমত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করে।
অধ্যাপক ড.
জাতীয় ঐক্য কমিশনের কর্মপরিকল্পনা
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের প্রথম কাজ হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরবরাহ করা, যা ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মূল প্রস্তাবগুলো চিহ্নিত করবে এবং কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জরুরি তা নির্ধারণ করবে।
কমিশনের সহসভাপতি জানান, এখন পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো এবং কমিশন উভয়েই এর অপরিহার্যতা স্বীকার করেছে।
জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এই প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করতে চাই না। কারণ, ফলপ্রসূ আলোচনা নিশ্চিত করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেখানে ‘সংলাপ ও পদক্ষেপ একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।’
তবে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, ঐক্য কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে সংস্কার ইস্যুগুলোর ওপর ঐকমত্যে পৌঁছানোর কাজ শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানানো জরুরি এবং জনগণ নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব থাকায় প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করার প্রচেষ্টা চলছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যদি বড় দলগুলো এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংবিধান সংস্কারের কোনো প্রস্তাবে একমত হয়, তাহলে সেটিকে গৃহীত হিসেবে বিবেচনা করে অন্য ইস্যুতে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ছয়টি কমিশন তাদের সুপারিশ প্রদান করেছে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব বিকল্প প্রস্তাবও থাকতে পারে, যা তাদের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই শাসনভার থাকবে।
ড. রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
জাতীয় সনদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রীয়াজ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর প্রক্রিয়াটি একটি জাতীয় সনদে পরিণত হবে, যা ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারের জন্য একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সনদ হবে পথনির্দেশক। যেই ক্ষমতায় আসুক, জনগণ জানবে যে এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।’
কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে যে- কোন সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা হবে, কোনগুলো নতুন সংসদে তোলা হবে এবং কোনগুলো গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ড. রীয়াজ বলেন, কমিশনের কাজ হলো আলোচনা পরিচালনা করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি কার্যকর পথ তৈরি করা। তবে ‘এখানে কোনো একক পথ নেই’।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জোর দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইচ্ছামতো সংস্কারগুলো নির্ধারণ করবে এবং তাদের সম্মত সুপারিশগুলো সুনির্দিষ্ট একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, ‘এই চুক্তিগুলো প্রকাশের কারণ হলো- এক্ষেত্রে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কী ধরনের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. রীয়াজ বলেন, জনগণের সম্পৃক্ততা একটি অগ্রাধিকার হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও জনসাধারণের সরাসরি মতামতের জন্য প্রক্রিয়া এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে কিনা—এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রীয়াজ বলেন, আমি আশা করি, দলগুলো ভবিষ্যতের দিকে নজর রাখবে। তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের মতো বন্দি হয়ে না থাকি।’
তিনি বলেন, অতীতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে সফল চুক্তির দৃষ্টান্তও রয়েছে, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে ১,৪০০-এর বেশি প্রাণহানি ঘটার পর রাজনৈতিক দলগুলো এখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে।
রিয়াজ বলেন, ‘কোনো দলই বলছে না যে সবকিছু ঠিক আছে। সবাই স্বীকার করছে যে শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।’ তবে তিনি বলেন, দলগুলোর প্রতিশ্রুতির মাত্রা ভিন্ন হতে পারে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘প্রতিটি দল সংস্কার চাইলেও তাদের অগ্রাধিকার আলাদা হতে পারে। আমাদের কাজ হলো আলোচনা সহজতর করে সাধারণ ভিত্তি খুঁজে বের করা।
নির্বাচনের পর সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে রীয়াজ পরামর্শ দেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি বাধ্যতামূলক জাতীয় সনদ প্রতিষ্ঠা করা, যা সমস্ত দল নির্বাচনের আগে ও পরে মেনে চলবে।
রীয়াজ বলেন, ‘এটি আদর্শ রূপরেখা।’ তবে তিনি আরও বলেন, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করে তারা কীভাবে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে।
তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি চলমান জাতীয় ঐক্য আলোচনার অংশ হবে না কারণ এটি আলাদা বিচারিক ও সরকারি প্রক্রিয়ার আওতায় পড়বে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, জাতিসংঘ আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নথি সংরক্ষণ করেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘এই দায় একজন ব্যক্তির। এটি আমাদের কমিশনের আলোচনার বিষয় নয় বরং এটি একটি বিচারিক প্রক্রিয়া, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে।’
তিনি উল্লেখ করেন যে, আওয়ামী লীগের ইতিহাস আদর্শিক উদ্বেগের কথা তুলে ধরে। এক্ষেত্রে তিনি ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী শাসন এবং ২০০৯-২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘এটি একই রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ), যা ব্যক্তিবাদী স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছে। তাই তাদের আদর্শে অবশ্যই কিছু ভুল রয়েছে। এটি কেবল একটি ঘটনা হতে পারে না। এটি একবার ঘটেনি বরং দুইবার ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, উভয় ক্ষেত্রেই এটি ‘সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছিল। এটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি ওই রাজনৈতিক দলের আদর্শ এবং আমার তা ভুলে যেতে পারি না।’ ড. রীয়াজ বলেন, ‘এটি আমাদের কাঠামোগত সংস্কার থেকে বিরত রাখা উচিত নয়।’
সংবিধান সংস্কার
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান রীয়াজ বলেন, তাদের সুপারিশগুলো নির্বাহী আদেশে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, বরং এটি জাতীয় ঐকমত্য এবং সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারে বিভিন্ন পথ রয়েছে— সংবিধান সভা, গণভোট বা সমঝোতার মাধ্যমে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে বা নিজস্ব পথ তৈরি করতে পারে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই প্রধান জোর দিয়ে বলেন, কমিশনের ভূমিকা ছিল সংবিধান পর্যালোচনা করা, ফাঁকগুলো চিহ্নিত করা এবং সুপারিশ করা- সংস্কার প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করা নয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা কখনও ‘সংশোধন’ শব্দটি ব্যবহার করিনি। এক্ষেত্রে আমরা সংস্কারের প্রয়োজনীয় ধারাগুলো তুলে ধরেছি। কী গ্রহণ করবে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বর্তাবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনসহ কিছু প্রস্তাবের জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন।
আলী রীয়াজ বলেন, প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে কোন পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, তারপর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
উপসংহার টেনে তিনি বলেন, ‘আসুন প্রথমে নির্ধারণ করি কী পরিবর্তন প্রয়োজন। তারপর বাস্তবায়নের কথা ভাববো। আগে জাতীয় সনদটি তৈরি করা হোক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র য় জ বল ন জ ত য় সনদ য় ঐকমত য ন র জন য সরক র র র বর ত র র জন আম দ র প রথম আওয় ম আদর শ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কথা বলে দুই দেশের উদ্বেগজনক বাণিজ্য বিরোধের মীমাংসা করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞ নেতারা দীর্ঘ আলোচনা করে ঠিক করতে পারছেন না কীভাবে নির্বাচন ও সংস্কার কাজটি করা যাবে।
অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে অবাক হইনি। কিন্তু ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তাদের সই না দেওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এটা নিয়ে তারা যে দর–কষাকষি করছে, তার পেছনে কি নীতিগত অবস্থান, না ভোটের হিসাব–নিকাশ মুখ্য ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হতে পারলে নির্বাচন হবে কীভাবে?
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল। আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল। তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি। আবার কোনো কোনো দল দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে। যেখানে গিয়ে ভোটের মাঠে সুবিধা করা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যাবে।
মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দিয়েছে। যদিও সনদ তৈরির সময় বলা হয়েছিল, তারা আইনি ভিত্তির সুপারিশ করবে না। কিন্তু অসমাপ্ত সনদ করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র, তার একটি হলো গণভোটের তারিখ। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের দাবি, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তাঁরা মনে করেন, আগে গণভোটের দাবি তোলা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য দুই বিকল্প প্রস্তাবই সরকারের কাছে পেশ করেছে। সমস্যা হলো যিনি সরকারপ্রধান, তিনি ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কে কার কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, জুলাই সনদে ঐকমত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ হলেও আইনি ভিত্তির সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের প্রধান আপত্তি এখানেই। জুলাই সনদে বলা হয়েছে, যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, নির্বাচনে তারা জনগণের রায় পেলে সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু আইনি ভিত্তিতে যখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সেটি অনুমোদন করে নিলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।
তাদের তৃতীয় আপত্তির জায়গা হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের এই আইনি ভিত্তির সঙ্গে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফওর মিল খুঁজেও পেয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র অনৈক্যের কারণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘দুরূহ চ্যালেঞ্জ’ দেখছে সরকার। তবে গণভোটসহ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)
সিদ্ধান্তটি কবে হবে, কেমন হবে? যদি একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াত ও এনসিপি কি মেনে নেবে? আর যদি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হয়, বিএনপি কি তা গ্রহণ করবে? যদি না করে, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি দিতে গিয়ে। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করবে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থাশীল নয়। নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকে সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সন্দেহ বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিও একধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।
সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, সেখানেই তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এই একটি বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির সংস্কারকাজ অনেকটা সহজ হতো। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চাপে সনদে যতই সই করুক না কেন, কাজ করবে তাদের মতো করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন থেকেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যত বাড়বে, আক্রমণের আশঙ্কারও তত জোরদার হবে। এই সহজ সত্যটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে অবিলম্বে সৃষ্ট জট খোলার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসুন। সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে।
● সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কবি
* মতামত লেখকের নিজস্ব