চব্বিশের চেতনা নস্যাতের ষড়যন্ত্র রুখতে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. এনামউল্যা।

তিনি বলেন, “বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ফলে পঁচাত্তর সালে বিপ্লব হয়েছিল, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস নামে পরিচিত। একই চেষ্টা গত ১৭ বছর করা হয়েছিল, যারই ফসল চব্বিশের বিপ্লব। চব্বিশের চেতনা নস্যাতের ষড়যন্ত্র রুখতে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”

বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টায় হাবিপ্রবির অডিটোরিয়াম-২ তে ‘অমর একুশের ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। মহান শহীদ দিবস ও আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত এ সভায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি বলেন, “একুশের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। সেই সময়ও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল আমাদের তরুণ সমাজ। চব্বিশ সালে এসেও আমাদের তরুণ সমাজকে আবার রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছে। তারা ছিল সম্মুখ সারিতে, আর পেছনে কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সাধারণ মানুষ।”

তিনি আরো বলেন, “অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল স্বাধীনতার পরপরই একটা সরকার জনগণের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, গণতন্ত্র ধ্বংস করে বাকশাল কায়েম করে জাতিকে একটা দুর্ভিক্ষ উপহার দেয়। আমাদের মনে আছে, বাসন্তীরা গায়ে জাল জড়িয়ে কিভাবে লজ্জা নিবারণ করেছিল।”

এ অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.

মোহা. হাছানাত আলী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাবিপ্রবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম সিকদার ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর কবির। 

ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. এস. এম. এমদাদুল হাসানের সভাপতিত্বে ও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. আবুল কালামের সঞ্চালনায় সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, চেয়ারম্যান, হল সুপার, প্রক্টর, বিভিন্ন শাখার পরিচালকসহ অন্যান্য শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রধান আলোচক অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী তার বক্তব্যে বলেন, “পাকিস্তানি শোষকরা মাতৃভাষায় কথা বলতে দিতে চায়নি, আমাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল। সেই সময় ছাত্ররা বুক পেতে দিয়েছিল, রক্তে রাজপথ লাল হয়ে গিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় চব্বিশের আন্দোলনেও একজন ছাত্রের টুটি চেপে ধরে এক পুলিশ অফিসার বলেছিল, ‘কথা বলবি না।’ বায়ান্ন তে বলেছিল উর্দুতে কথা বলতে হবে, বাংলায় না। এখানেই স্বৈরশাসক তথা ফ্যাসিস্টদের চমৎকার একটি মিল। তারা কথা বলতে দিতে চায়না।”

তিনি বলেন, “একুশের চেতনা ছিল আমরা স্বাধীনভাবে মায়ের ভাষায় কথা বলবো, সেটা বলতে দিতে চায়নি পাকিস্তান। একাত্তর আসলো, আমরা স্বাধীন হলাম। ভেবেছিলাম স্বাধীনভাবে কথা বলবো, শোষিত হব না। কিন্তু ১৭ বছর এদেশে জন্মগ্রহণ করা কিছু মানুষই আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চিত করেছে; পাকিস্তানী বা অন্যরা না। আমাদের সন্তানদের হলে থাকতে দেয়নি, তাদের ছাত্র সংগঠন বাকশালি কায়দায় চাঁদাবাজি করেছে, সিট বাণিজ্য করেছে, মেধাবীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।”

“আন্দোলনকে দমাতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। নিজের বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বাংলাদেশে ভয়াবহ ম্যাসাকার করলেন। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এটা কল্পনা করা যায় না। চব্বিশ এর চেতনা ধারণ করে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সব শক্তিকে এক থাকতে হবে, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি করা যাবে না।”

ঢাকা/সংগ্রাম/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপ চ র য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। 

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি

৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।

৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।

৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।

১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না