বিজয়যাত্রার সূচনা হলো সর্বাত্মক যুদ্ধে
Published: 11th, December 2025 GMT
‘৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেলে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে আমার দপ্তরে কাজ করছি। সন্ধ্যা ছয়টায় টেলিফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ। দিল্লি থেকে জানালেন, পাকিস্তান পশ্চিমে আমাদের বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’
এভাবেই ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটা বর্ণনা করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। বিষয়টি কলকাতায় অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দিলেন জেনারেল মানেকশ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা তা-ই করলেন। দ্রুত তিনি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবকে ডেকে সব ফিল্ড কমান্ডারকে সতর্ক করে দিতে বললেন। সেই সঙ্গে একটি স্টাফ কনফারেন্স আয়োজন করতে বলে ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করতে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন রাজভবনে।
ইন্দিরা গান্ধী তখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ভাষণ শেষে রাজভবনে অবস্থান করছিলেন। সেখানে রাজ্যপাল এ এন ডায়াসের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এরপর বক্তব্য দেন শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এক বৈঠকে।
অরোরা রাজভবনে গিয়ে দেখেন ইন্দিরা গান্ধী বৈঠক শেষে নিজের কামরায় ফিরেছেন। দরজায় কড়া নেড়ে তিনি ভেতরে ঢুকে সেনাপ্রধানের বার্তা পৌঁছে দেন। তবে তিনি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে মুখ্য সচিব এন সি সেনগুপ্তের মাধ্যমে জরুরি তারবার্তায় পাকিস্তানি বিমান হামলার খবর জেনে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী।
এ বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তৎকালীন ভারতীয় উপসচিব ও পরে পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত। তিনি লিখেছেন, ‘৩ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যেই মিসেস গান্ধী কলকাতায় তাঁর কাজ সারেন। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে তিনি দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা ছাড়েন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বা সাতটায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডি পি ধর, পশ্চিমবঙ্গের দু-একজন রাজনীতিক এবং আমার ও পিটার সিনাইয়ের মতো মধ্য পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা, যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন।’
জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, ‘বিমানটি লক্ষ্ণৌর কিছুটা পূর্বাকাশে পৌঁছালে পাইলট ডি পি ধরের কাছে এসে বলেন, তাঁকে একবার ককপিটে যেতে হবে। কারণ, দিল্লি থেকে একটি জরুরি বার্তা এসেছে, ধর সাহেবকে একটু কথা বলতে হবে। তিনি তিন থেকে চার মিনিট ককপিটে অবস্থান করে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নিজের আসনে ফিরে এলেন।’ পাকিস্তানের হামলার বিষয়টি বর্ণনা করে জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিমান হামলার আশঙ্কায় ভারতের উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মিসেস গান্ধীর বিমান লক্ষ্ণৌতে বিরতি দিয়ে দিল্লিতে অবতরণ করে। দিল্লিতে ফিরে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে মধ্যরাতে বেতার ভাষণ দেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
সর্বাত্মক অভিযান শুরু৩ ডিসেম্বরের এই হামলার আগের সাতটি সপ্তাহ তীব্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের গেরিলা আক্রমণ এবং বিভিন্ন সেক্টরে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সীমান্ত চাপ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে ফেলেছিল। এর মধ্যে ২১ নভেম্বর যশোরের গরিবপুর-বয়রায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযানে পরাজিত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্রিগেড। প্রত্যক্ষ এই সামরিক হস্তক্ষেপের পর পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ভারতকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে তুলে ধরে বিশ্ব-জনমত তৈরির জোর চেষ্টা চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই ২ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের সাতটি ফ্রন্টে বাড়তি তিন ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে ভারত।
কৌশলগত এই টানাপোড়েন যখন তুঙ্গে, তখনই ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রাসহ সাতটি স্থানে অতর্কিতে একযোগে হামলা চালায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী। এরপর রাত ৮টায় জম্মু ও কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছামব ও পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করে।
বাংলাদেশের চলমান মুক্তিসংগ্রাম দমন করতে পাকিস্তানি বাহিনীর এই আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়। সেদিন রাতেই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে। গভীর রাতে ঢাকা এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের ওপর হামলা চালায় ভারতীয় জঙ্গিবিমান। বিপর্যস্ত হয়ে যায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী।
কৃষ্ণনগর, শিলিগুড়ি আর গুয়াহাটিতে ছয় ডিভিশন স্থলসৈন্যর সমাবেশ ঘটিয়েছিল ভারত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম, উত্তর, উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে ভারতীয় সৈন্যরা। ৪ ডিসেম্বর খুব ভোর থেকেই স্থলবাহিনী একযোগে আক্রমণ চালায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর। শহরগুলোর বাইরে যেসব জায়গায় পাকিস্তানিরা ঘাঁটি গেড়েছিল, তার ওপরও অভিযান চালাতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের নৌবাহিনীর শক্তি এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা। মুক্তিযোদ্ধারা গোপন সহায়তা ও স্থানীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যৌথ বাহিনীকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার ১৯৭১: ভেতরে বাইরে বইয়ে লিখেছেন, ৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একত্র হয়ে যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর যে কয়টি যুদ্ধবিমান ছিল, সেগুলো তারা যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনি। ভারতীয় বিমানবাহিনী সেগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে বেশির ভাগই অকেজো করে দেয় অথবা সেগুলো ব্যবহার করার জন্য যেসব রানওয়ে ছিল, তা ধ্বংস করে ফেলে।
সব মিলিয়ে এই সম্মিলিত শক্তির মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান অল্প সময়েই দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর পর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর বিজয় নিয়ে কোনো মহলে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সেই মুহূর্তে চলতে থাকে কূটনৈতিক যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের জন্য সরাসরি ভারতকে দোষী ঘোষণা করে জাতিসংঘকে অনুরোধ করে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকতে। এতে অধিকাংশের ভোটে ঠিক হয় যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হোক। কিন্তু সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাকে সমর্থন করে পোল্যান্ড। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না।
৩ ডিসেম্বরের সর্বাত্মক যুদ্ধ এগিয়ে চলে বিজয়ের পথে।
তথ্যসূত্র:
১.
২. একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, সম্পাদক: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন
৩. ১৯৭১: ভেতরে বাইরে, এ কে খন্দকার, প্রথমা প্রকাশন
৪. যুগান্তর, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ৩ ড স ম বর অবস থ ন ইন দ র কলক ত
এছাড়াও পড়ুন:
৮ ম্যাচে মাত্র ২ জয় রিয়ালের, চাকরি হারানোর শঙ্কার মুখেও ‘ইতিবাচক’ আলোনসো
লা লিগায় গত রোববার রাতে সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে হারের পর তীব্র হয়েছিল জাবি আলোনসোর ছাঁটাই হওয়ার গুঞ্জন। বলা হচ্ছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ম্যাচটা দিয়েই নির্ধারিত হবে আলোনসোর ভবিষ্যৎ। সেই ভাগ্য নির্ধারনী ম্যাচেও গতকাল রাতে হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদ। ২–১ গোলের এই হারের পর এখন সবার চোখ আলোনসোর চাকরি দিকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রিয়াল কি আলোনসোকে আরও সুযোগ দেবে নাকি এখানেই সম্পর্কের ইতি টানবে? রিয়ালের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে আরেকটু হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মাদ্রিদের ক্লাবটির মৌসুম যে ক্রমশ অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে তা বলাই যায়।
আলোনসোর রিয়াল সর্বশেষ ৮ ম্যাচের মাত্র ২টিতে জিতেছে। ব্যর্থতার এই যাত্রায় সবচেয়ে খারাপ যে ব্যাপারটি ঘটেছে তা হলো, আলোনসো কোচিংয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শন ভুলে গিয়েছেন।
আরও পড়ুনরিয়াল ও আলোনসোর দুর্দশা বাড়িয়ে বার্নাব্যুতে জিতল ম্যানচেস্টার সিটি৫ ঘণ্টা আগেগতকাল কথিত বাঁচা–মরার ম্যাচে সেই দর্শনটাই ফিরিয়ে আনার চেষ্টাই যেন করলেন তিনি। চোটাক্রান্ত কিলিয়ান এমবাপ্পের জায়গায় নামালেন গনসালো গার্সিয়াকে। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে গনসালো আলোনসোর বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এরপর ফেদেরিকো ভালভের্দেকে খেলালেন রাইট–ব্যাক হিসেবে, যদিও এ ভূমিকায় তিনি স্বচ্ছন্দ নন।
এরপর মিডফিল্ডে জায়গা পেলেন দানি সেবায়োস, আর তাই আরদা গুলেরকে বসে থাকতে হলো বেঞ্চে। উইংয়ে আলোনসো ভরসা রাখলেন ৩২ ম্যাচ ধরে গোলখরায় ভুগতে থাকা রদ্রিগোর ওপর। তবে রদ্রিগো গোল করে শেষ পর্যন্ত খরা দূর করেছেন।
সময়টা ভালো যাচ্ছে না আলোনসোর