মনে প্রেম থাকলে মানুষের বোকা হওয়া ঠেকায় কে! ‘প্রেমিকাদের কিছুটা বোকা হতে হয়’ বলে যে আপ্ত-বাক্য ছুড়ে দিয়েছেন তরুণ কবি শামীম পাটোয়ারী; বিপরীতে প্রেমিকরাও কেন বোকাসোকা হবে না এমন প্রশ্নও তোলা যায়। অবশ্য বোকা না হলেও উদার হতেই হবে এছাড়া যে প্রেমিকদের কোনো গত্যন্তর নেই! উদারই যদি করতে না পারল তবে কীসের প্রেম।

একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শামীম পাটোয়ারীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমিকাদের কিছুটা বোকা হতে হয়’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১৬৮-১৬৯ নম্বর স্টলে মিলছে বইটি। বইয়ের নাম শুনলে প্রথমে মনে হতে পারে এটা বুঝি ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের কবিতা। আদতে তা নয়, একটুও নয়। বাম রাজনীতির চেতনা যে কবির বুকে স্পন্দন তোলে অহর্নিশ চাইলেও তার পক্ষে অতটা আবেগী হওয়ার সম্ভব নয়। ইতি-নেতি প্রেমের দুটি দিকই তিনি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন এই কবিতায়।

‘প্রার্থনার ভঙ্গিতে তোমার নতমুখ’ পেরিয়ে দেখা দেয় বিপ্রতীপ চিত্র ‘তোমার স্বার্থপর চতুর মুখশ্রী’। পাশাপাশি দুটি চিত্র মেলে ধরে কবি প্রমাণ করতে চেয়েছেন কেন তার মানসপ্রতিমাকে বোকা হতে হবে! শুধু প্রেম-অস্বস্তি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলায় বিষয়ই নয়, কবি অনেক কঠিন নিরেট বাস্তব কথাও উচ্চারণ করেছেন ৮০ পৃষ্ঠার বইটির ছত্রে ছত্রে।

আরো পড়ুন:

‘বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা মোটেও সহজ নয়’

বইমেলায় রক্তিম রাজিবের ‘বোবা পাখির পালক’

অগ্রজ কবি সরকার মাসুদ যথার্থই বলেছেন ফ্ল্যাপে ‘শামীম পাটোয়ারী সাহিত্যে নবাগত নন, অন্যূন পঁচিশ বছর সাহিত্যচর্চা করার পর এই প্রথম তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। তার কবিতায় ভাষার স্বচ্ছতা, বিষয়ের স্পষ্টতা ও ভাবকল্পনার মনোগ্রাহী উপস্থিতি অস্তিত্বমান। এ কবির কাব্যে বিষয়বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে তিনি মনের নিগূঢ় অনুভব ব্যক্ত করে থাকেন। তার ভাবনা সচ্ছল অভিযাত্রা সর্বদাই গভীরতার দিকে। নর্দমার মশা থেকে কাঁটাতারে ঝুলন্ত ব্রা পর্যন্ত বিস্তৃত তার কবি কল্পনা। যা পথ দেখাতে উদ্বুদ্ধ করে প্রকৃত কবিতার মর্ম ও মিথস্ক্রিয়া।’

শামীম পাটোয়ারীর রাজনৈতিক চেতনা বরাবরই প্রখর। ‘নেতা’ কবিতায় তিনি যখন বলেন ‘বিপন্ন বাতাসে/ দুর্গন্ধের মতো আপনার সুনাম ছড়াচ্ছে’ তখন আমরা বুঝতে পারি বিরক্তির পরিধি কতটা গভীর। আবার ‘স্বাধীনতা’ কবিতায় কী কৌশলেই না জানিয়ে দিচ্ছেন ‘মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে/ সেখানে বিশেষত পতিতারা দাঁড়ায়।’ এভাবে সরাসরি না বলেও পরোক্ষভাবেই অনেক জটিল-কঠিন কথা বলে দেন কবি, জড়তা না রেখেই! 

‘বেত খাওয়া বালকের মতো’ কবিতায় তিনি বেত্রাঘাতটা যে ঠিক কোথায় করতে চেয়েছেন পাঠক হিসেবে ঠিকই আমরা বুঝে যাই। স্পষ্ট কথার শাণিত চাবুক পেরিয়ে কবিতা উচ্চারণ করেনÑ ‘যুদ্ধের মিথ্যে বাহানায় সিন্ডিকেট দেখায়/ গরিমায় হাসে হলুদাভ ডিম, মাংসের বাজারে/ ইদানীং কেউ যাচ্ছে না।’

উত্থাপিত চিত্রগুলো একেবারেই তরতাজা, চক্ষুষ্মান সবাই দেখে ও বোঝে শুধু সমাধানটাই অধরা! কবির সমাজতান্ত্রিক মানস মানুষে মানুষে প্রভেদ ঘোচানোর স্বপ্নই বপন করে চলে। অন্যদিকে বিরক্তিকর বাস্তবতা বুঝিয়ে দেয়, ক্ষমতাসীন মুখ পাল্টায় একে একে কিন্তু কাক্সিক্ষত মুক্তি ধরা দেয় না। ‘কবিদের লাম্পট্য’ কবিতায় শামীম পাটোয়ারী শিল্পচর্চার নামে চলমান আত্মপ্রচার তথা অপপ্রচারের দিকগুলো তুলে ধরেছেন। পঠন-পাঠন নেই, নতুন কোনো দর্শন নেই, স্বদেশ-সমকালকে তীর্যকভাবে দেখার দৃষ্টিশক্তিটুকুও নেই এরাই আবার বুনে যাচ্ছেন গণ্ডা-কানি কবিতার খেত-খামার! অকারণ আবেগ আর নির্জীব জীবনবোধকেই সহজ কথায় তুলে ধরেছেন শামীম পাটোয়ারী ‘কবিদের লাম্পট্যে একুশের মেলায়/ বাড়ে বইয়ের জঞ্জাল/ ফেসবুকজুড়ে স্ট্যাটাসের আবর্জনা/ ছবি-সমেত গড়াগড়ি খায়/ অকারণ উচ্ছাসে!’ 

সব কবিই কি এমন জলজ? অবশ্যই না। সত্যিকারের আকাক্সক্ষা, শুভবোধের স্বপ্ন দেখার কবিও কম নেই। বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে শামীম পাটোয়ারী বয়ান করেন নিজস্ব ইশতেহারÑ ‘আমরা মানে কবিরা সব প্রেমের সানাই/ কারো মাঝে জাগলে সে প্রেম/ আমরা তাকে ভীষণ বাজাই।’ প্রেম-প্রশস্তির বাইরেও চাপা থাকে না ক্ষোভ। ‘আরাধ্য’ কবিতায় লেখেনÑ ‘কবি নয়/ নেতা হওয়ার উদগ্র বাসনায়/ কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে হিতাহিত জ্ঞান। .

..সব দেখে চুপ থাকে/ প্রকৃত কবি/ নিভৃতে লেখে তার/ আরাধ্য কবিতা।’

বইটিতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে কবি ও কবিতাবিষয়ক কবিতা। যেমন ‘রূপসী তুমি কবিতার ভৃত্য’ কবিতায় কবি কী চমৎকারভাবেই জানিয়ে দেন ‘কবিতার মতো আর কোনো বিউটি পার্লার নেই/ আর কবির মতো বিউটিশিয়ান’। আবার ‘কবিতা তোমাকে মুগ্ধ করে না’ বলে কবি উচ্চারণ করেন অনুদ্ভাসিত সত্য ‘অথচ তোমার কবিতার শরীর’। জীবন শুধু কবিতার নয়, রুক্ষ ভূমিরও। পরিস্ফুট হয়েছে আরও কবিতায়। বিশেষ করে কাঁটাতারে ব্রা ঝুলে আছে বলে কবি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন আমাদের অন্তঃসারশূন্যতার দিকেই। দ্রোহে জ্বালালো বহ্নি এই অনন্ত অম্বরে কবিতায় চোখের সামনে তুলে ধরেন ফেলে আসা ইতিহাস। রক্তঝরা ’৫২ ও ’৭১ পেরিয়েও যে জাতি হিসেবে আমরা বিষকাটালির ঝোপে পড়ে আছি সেই বিষাদময় দৃশ্য ও দৃশ্যান্তর। শিশু হত্যার দেশে লাটিমের মতো ঘুরি পরীমনির দেশে জেগে থাকে রোজিনা। রিমোট হাতে গেলে লুণ্ঠিত গণতন্ত্র অপহৃত বিজয় রোগটা যদিও তুমি। কোলবালিশের কষ্ট তুমিই দায়ী বোমা হামলার পেছনে প্রেমিকা। প্রেমিকা ও বর্ণমালা বন্ধুর জন্য কয়েক পঙ্ক্তি একটি অদৃশ্য হাত গোধূলি লালিমায় কার রক্ত শকুনরা মরে বিরান হবে জল...। এভাবেই যদি কবিতার শিরোনামগুলো পাশাপাশি বসিয়ে দেই সৃষ্টি হতে থাকবে অর্থময় বিভিন্ন দৃশ্য কিংবা সাদৃশ্য। প্রেম অপ্রেম যুদ্ধ জিঘাংসা আহাজারি পেরিয়ে কবিতাগুলো যে অভিন্ন সুতোয় গাথা সেটাও পেয়ে যাই এমনতর অসম্ভবের খেলায়।

কবি নিজেই দিগন্তবিস্তারী আ-চুল প্রেমিক সেটা উৎসর্গপত্র থেকে আঁচ করতে পারি। চারটি চমৎকার বাক্যে সাজিয়েছেন উৎসর্গ আমার মা/ আমার দেশ/ আমার প্রেমিকা। আমার অন্তঃদহনের তিন উৎসমূল।
প্রেমিকারা বোকা হোক তবে পাঠকরা না হোক! পাঠকরা চালাক হলে কাব্যগ্রন্থটি অবশ্যই কিনে পড়বেন। বাজারে অনেক অকবিতার ভিড়ে ভালো মানের এক পশলা কবিতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে বইটি। তবে একটা উদ্বেগ না জানিয়ে পারছি না এত বানান ভুল কেন? মাত্রাপ্রকাশ আগামীতে পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখিয়েই পাঠকের হাতে তুলে দেবে প্রত্যাশাটুকু জানিয়ে রাখলাম।

প্রেমিকাদের কিছুটা বোকা হতে হয়
শামীম পাটোয়ারী
প্রকাশক : মাত্রাপ্রকাশ
প্রচ্ছদ : নাওয়াজ মারজান
মূল্য : ২২০ টাকা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকা/লিপি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 

মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।

কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।

আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।

এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না

শুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।

২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।

বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।

এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?

যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।

তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।

এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

সম্পর্কিত নিবন্ধ