Samakal:
2025-11-02@19:06:46 GMT

গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ‘মব’

Published: 27th, February 2025 GMT

গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ‘মব’

ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিজমের বিনাশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একনায়তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং ভিন্নমত দমনপীড়নকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে ফুঁসে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণ।

নিজেদের অপরাজেয় মনে করা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত অনুভব নিয়ে রাজপথে নেমে পড়া মানুষের আনন্দ আর উল্লাস জানিয়ে দেয়, কতটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হয়েছে সেদিন। 

কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! এই মুক্তির আনন্দ বিষাদে পরিণত হয় নব্য ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। এরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুটপাট করে ও জ্বালিয়ে দেয়। হিজড়া পল্লির সবকিছু লুট ও ভস্মীভূত করে। দরিদ্র, উপায়হীন যৌনকর্মীদের ওপর আক্রমণ করতে থাকে। অনেক মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এই সব কিছু জায়েজ করার জন্য সামনে টেনে আনে ধর্মকে। 

অনুমান ছিল, এসব থেমে যাবে। কারণ নিষ্পেষিত মানুষের ক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশিত হয়। এই সহিংসতা খুব অস্বাভাবিক নয় হয়তো। দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। কিন্তু ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সমর্থক বাংলাদেশি কমই দেখা যায়। ধারণা ছিল, শত শত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আর কেউ এখানে আগের মতো মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতেই প্রতিষ্ঠা করবে। বহুত্ববাদই হবে এই রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র। অর্থাৎ এখানে বহু মত-পথ, দল-গোষ্ঠীর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত এবং ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণু হবে। মতপ্রকাশের কারণে কাউকে সন্ত্রস্ত বোধ করতে হবে না; গ্রেপ্তার হতে হবে না। অথচ ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের ছয় মাস পরও ফ্যাসিজম তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে। জনসাধারণের মুখাবয়বে ভীতি ও উদ্বেগের চিত্র স্পষ্ট ও ক্রমবর্ধমান। যখন জাতি অপেক্ষা করছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত, বহুত্ববাদী বাংলাদেশের জন্য, তখন একটি মহল ‘তৌহিদি জনতা’র পরিচয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। 

এদের রোষের শিকার কেবল মাজারপন্থি, নারী ও জেন্ডার বৈচিত্র্যের মানুষই নয়; এরা মূলত আক্রমণ করতে শুরু করেছে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী, আত্মপরিচয় প্রকাশক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর। সম্প্রতি মধুপুর উপজেলায় একটি গোষ্ঠীর চাপে বন্ধ করতে হয়েছে লালন উৎসব। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসে ফুল বিক্রি করায় তারা ভাঙচুর করেছে ফুলের দোকান। ভয় ও ত্রাসে গোপালপুর উপজেলায় বন্ধ হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব। এর আগে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করতে আক্রমণ চালানো হয়েছে খেলার মাঠে। অথচ সাম্প্রতিক ক্রীড়াঙ্গনে নারী ফুটবল দলই দেশের জন্য গৌরব ছিনিয়ে এনেছে। 

এসব ঘটনা মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ফলে নানা অজুহাতে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা সংঘবদ্ধ জনতার সন্ত্রাস আশকারা পেয়েছে। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডের শড়াতলা ইউনিয়নে গ্রামজুড়ে নোটিশ দিয়ে বাদ্যযন্ত্র এবং ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল! এ নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তির হুমকিও দেওয়া হয়েছে। একই এলাকার দৌলতপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামেও গান-বাজনার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সেখানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংগীতচর্চা কেন্দ্রের কার্যক্রম। 

নারীদের স্বাধীন ও নিরাপদ চলাফেরায় বাধা দেওয়ার মতো মব সন্ত্রাসের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি স্কুলের সামনে চায়ের দোকানে নারীদের কাছে চা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঘটনাও ঘটছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, বহুত্ববাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত নায়ক যে ছাত্রসমাজ, তারা সবকিছু দেখেশুনে নীরব ভূমিকা পালন করছে। 

এ রকম আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর উত্থান নতুন– তা বলা যাবে না। ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার প্রশ্রয়েই এরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ ধরনের গোষ্ঠীগত আধিপত্যবাদ গণতন্ত্রের জন্য সুবিশাল হুমকি; বহুত্ববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া পর্যন্ত এই ‘মব’ প্রভাবিত। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পেছনের দিনগুলো মনে রাখতে হবে আমাদের। এ দেশের মানুষ সহনশীল। শান্তিকামী মানুষ প্রথমে মেনে নেয়, পর্যবেক্ষণ করে। তারপর কিন্তু ঠিকই রুখে দাঁড়ায় অন্যায় ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। দেশবাসী আর এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি কামনা করে না। 

বর্তমান পরিস্থিতি শুধুই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট নয়; দেশকে অধিকতর রাজনৈতিক সংকটের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে; বিশেষত ভারতীয় প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। বহুত্ববাদের পথে এগোতে চাওয়া বাংলাদেশকে পথচ্যুত করার গভীর ফাঁদ হিসেবেই দেখতে হবে এসব আধিপত্যবাদী তৎপরতাকে। বৃহত্তর সমাজে বহুত্ববাদী ভাবনার সুরক্ষা দিতে না পারলে প্রকৃত মুক্তি আসবে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদেরও সক্রিয় হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, গভীর পঠন-পাঠন থেকে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নিশ্চয় উপলব্ধি করেন, এ অঞ্চলে ধর্মকে ব্যবহার করে অপরাজনীতি যতটা করা হয়েছে, ধর্ম ততটা প্রয়োগ করা হয়নি দুর্নীতিমুক্ত, বাজার সিন্ডিকেটমুক্ত, মুনাফাখোরমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত সাম্য ও শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠায়। এ দেশে আজও রমজান মাস আসে বাজারের দুশ্চিন্তা নিয়ে। কারও পাতের ইফতার উপচে পড়ে, কেউ ক্ষুধা নিবারণে পর্যাপ্ত ইফতার পায় না। 

ধর্মের গভীর মানবিক অনুভবের চেয়ে ধর্মের বাহ্যিক অনুভূতিকে ইস্যু বানানোর বিপদ নিশ্চয় সবাই উপলব্ধি করেন। নতুন প্রজন্ম যারা প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে, বিকলাঙ্গতা মেনে নিয়ে ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছে, তারাই বাংলাদেশকে এমন ভয়ানক বিভাজনের পথ থেকে সরিয়ে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ঐক্যের পথে পরিচালিত করবে।

নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, ফোকলোর গবেষক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র ননব শ ন ত গণঅভ য ত থ ন গণতন ত র পর স থ ত র জন য র ওপর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান

ঢাকা-৮ আসনে দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান। তিনি বলেন, “ভোটের অধিকার জনগণের পবিত্র আমানত, এটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জননেতা সাইফুল হক-এর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন।

গণসংযোগের শুরুতে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাকের সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়। 

সেখানে আকবর খান বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অবিলম্বে ভোটের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে—২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে—ঢাকা-৮ আসনের বহু নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে তরুণের এখন বয়স ২৫ বা ২৬, তারা কখনো ভোট দিতে পারেনি, ভোট কী তা জানে না- এটি গণতন্ত্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি আরো বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের নেতা সাইফুল হক জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রাম করে আসছেন। এর জন্য জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটাধিকার গণমানুষের দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের ফসল। এই অধিকার ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”

আকবর খান বলেন, “জননেতা সাইফুল হক গণমানুষের পরীক্ষিত নেতা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের জনগণ যেন তাকে ভোট দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ও দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস সংসদে তুলে ধরার সুযোগ করে দেন- এটাই আমাদের আহ্বান।”

গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কালভার্ট রোড হয়ে বিজয়নগরে এসে শেষ হয়। এতে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিকদার হারুন মাহমুদ, মীর রেজাউল আলম, কবি জামাল সিকদার, ফাইজুর রহমান মুনির, বাবর চৌধুরী, মহানগর নেতা যুবরান আলী জুয়েল, সালাউদ্দিন, রিয়েল মাতবর, আরিফুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম রাজিব, মাহমুদুল হাসান খান, ফয়েজ ইবনে জাফর, নান্টু দাস, শিবু মহন্ত ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

ঢাকা/এএএম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
  • গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
  • এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না: সাকি
  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ 
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান