অমর একুশে বইমেলার ৭০ ভাগ বই প্রকাশিত হয় লেখকের অর্থায়নে। বই ছাপার যাবতীয় খরচ বহন করেন লেখক; অথবা তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যক বই কিনে নেন। লেখক-প্রকাশকরা বলছেন, এই ব্যবস্থায় দোষের কিছু নেই। সারা পৃথিবীতে নিজের উদ্যোগে বই প্রকাশের (সেলফ পাবলিকেশন) প্রচলন রয়েছে। তবে এ দেশে অপেশাদার প্রকাশক টাকা পেলে যেনতেন বই ছাপেন। এতে তিনি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হলেও ভালো বইয়ের বদলে প্রকাশ হচ্ছে ‘জঞ্জাল’।
আবার বছর বছর বইয়ের বিক্রি বাড়লেও সম্মানী পান মাত্র ১০ শতাংশ লেখক। প্রকাশকদের ভাষ্য, বাকি ৯০ শতাংশ লেখকের বই সেই পরিমাণ বিক্রি হয় না, যাতে তাদের সম্মানী দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝি হওয়ায় লেখক প্রকাশককে দায়ী করেন। বই বের করার আগে লেখক-প্রকাশকের লিখিত চুক্তি হলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয় না।
অন্বেষা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন সমকালকে বলেন, লেখকের টাকায় বই বের করার পরিমাণটা এত বেশি, তার ভিড়ে ভালো বই হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মেলার চার-পাঁচ হাজার বইয়ের মধ্যে ৫০০টিও মানসম্পন্ন না হওয়ার বড় কারণ এমন প্রকাশনা। একজন প্রকাশকের ৫০টি বইয়ের ৪৫টিই যদি এই প্রক্রিয়ায় বের হয়, তাহলে বাকি পাঁচটি ভালো বই তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি প্রতি মেলায় এক হাজার মানসম্পন্ন বই বের হতো, তখন প্রতিটিই এক-দুই হাজার বা তার চেয়ে বেশি কপি বিক্রি হতো। এটা প্রকাশনার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ যদি পত্রিকা বের করার জন্য নিবন্ধন নিতে চান, তাঁকে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু একটা প্রকাশনীর জন্য সেটা অনেক সহজ। এ কারণে যে কেউ হুটহাট একটি প্রকাশনা খুলে স্টল নিয়ে বসে যান। আমার মনে হয়, প্রকাশক হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বিধিবিধান ও যোগ্যতার শর্ত থাকলে ভালো হতো। দেশে দুই হাজার তথাকথিত সৃজনশীল প্রকাশক আছেন। কিন্তু বাস্তবে ২০০ মৌলিক প্রকাশক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
একটি শীর্ষ প্রকাশনা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, লেখকের টাকায় বই বের করাটা সমস্যা নয়। কিন্তু আমাদের এখানে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রকাশক লেখকের কাছে ৫০ বা ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। লেখক খুশি মনে তা দিচ্ছেন না, দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাহলে তো এটা জিম্মি করার মতো হয়ে গেল। আবার পরে দেখা যায়, প্রকাশক প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখছেন না। যত কপি বই দেওয়ার কথা, তা দিচ্ছেন না। ঠিকঠাক বাজারজাত করছেন না। এ নিয়ে লেখক-প্রকাশক পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেন, সম্মানীর ক্ষেত্রে প্রকাশকদের অসততা তো আছেই, সেই সঙ্গে অপেশাদারিত্বও আছে। তারা সেইসব লেখকের সঙ্গে অসততা করেন, যাদের বই প্রচুর বিক্রি হয়। কোনো লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, তাঁর বই কত কপি ছাপা হলো। হয়তো চুক্তিতে একটা থাকল, ছাপা হলো বেশি। নতুন লেখক হোক বা পুরোনো, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি থাকা উচিত।
তিনি বলেন, আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন সম্মানী দেওয়া হতো ১৫ শতাংশ। পরে সেটা কমিয়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ করা হলো। এখন ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
লেখকের অর্থায়নে বই প্রকাশে কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন বলেন, বইয়ের দামে অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে লেখকের সম্মানীর অংশটিও যুক্ত থাকে। তাই যত কপি বই-ই বিক্রি হোক না কেন, সম্মানী দেওয়া উচিত। লেখককে যদি শুধু লিখে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দেওয়া হয়; তাহলে তিনি যে বইয়ে এক মাস সময় দেন, সেখানে ছয় মাস দেবেন। তিনি আরও ভালো লিখবেন, সেটি আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাবে, পাঠক তাঁকে গ্রহণ করবেন। এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। এতে লেখক-প্রকাশক-পাঠক সবাই উপকৃত হবেন।
এ ক্ষেত্রে প্রকাশকদের মত অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। একাধিক প্রকাশক জানান, যে লেখকের বইয়ের দুই-তিনটি সংস্করণ বের হয়, প্রকাশক তাদের সম্মানী দিতে উদ্গ্রীব থাকেন। তবে যখন প্রথম সংস্করণ শেষ হয় না বা বিক্রি হতে তিন-চার বছর লেগে যায়; তখন প্রকাশকের খরচ ওঠানো কঠিন। আর সম্মানী না পেয়ে লেখক অভিযোগের আঙুল তোলেন। এটার সহজ সমাধান হলো, চুক্তি ছাড়া বই বের করা যাবে না। চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে, নির্দিষ্ট সংখ্যক বই বিক্রি হলে তিনি সম্মানী পাবেন। এই প্রক্রিয়ায় বই বের হলে কারও দায় থাকে না, অভিযোগও ওঠে না।
সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও প্রকাশকদের তথ্য মতে, প্রতি বছর বই প্রকাশ হয়– এমন লেখক প্রায় এক হাজার। তাদের সঙ্গে প্রতি মেলায় আরও প্রায় দুই হাজার অনিয়মিত বা নতুন লেখকের বই প্রকাশ হয়। এই তিন হাজার লেখকের মধ্যে আনুমানিক ৩০০ জন সম্মানী পান।
কথাসাহিত্যিক ইমন চৌধুরী বলেন, প্রকাশকরা অনেক নিয়মিত লেখকের সঙ্গেও চুক্তি করেন না। ৮০ ভাগ বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক-প্রকাশকের চুক্তি হয় না। চুক্তিতে দেড় হাজার বই বের করার কথা থাকলেও প্রকাশক যদি দ্বিগুণ ছাপেন, সেটা তদারকির সুযোগ নেই। চুক্তি হলেও সবাই ঠিকঠাক সম্মানী দেন না। হয়তো মোট প্রকাশনা সংস্থার ৫ শতাংশ লেখকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন।
এ বিষয়ে অনলাইনে বই বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান রকমারি ডটকমের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ সমকালকে বলেন, ‘আমাদের ওয়েবসাইটে লেখক ও প্রকাশকদের আলাদা প্যানেল রাখা হয়েছিল। সেখানে লেখক ও প্রকাশকরা বই বিক্রির তথ্য দেখতে পেতেন। পরে কিছু প্রকাশকের আপত্তির কারণে লেখক প্যানেল বন্ধ রাখা হয়।
এখন যেসব প্রকাশক অনুমতি দিয়েছেন, শুধু তাদের প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট লেখকের প্যানেল উন্মুক্ত আছে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয়। রকমারি প্রায় আট হাজার প্রকাশনীর সঙ্গে কাজ করলেও দুই হাজার প্রকাশনীর সঙ্গে নিয়মিত লেনদেন হয়।’ লেখকের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে রকমারি ভাবছে বলে জানান তিনি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল ব র কর র বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর চেষ্টা সিনেটে ব্যর্থ
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যে, ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি আটকাতে মার্কিন সিনেটে তোলা একটি বিল পাস হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থ হলেও, বুধবারের ভোটে দেখা গেছে, মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা জোরদার হয়ে উঠেছে।
আজ বৃহস্পতিবার কাতারভিত্তিক আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর প্রচেষ্টায় এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ডেমোক্র্যাট যোগ দিয়েছেন।
ইসরায়েলের কাছে ২০ হাজার স্বয়ংক্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল বিক্রি বন্ধ করার প্রস্তাবের পক্ষে ২৭ জন ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন, আর ৬৭৫ মিলিয়ন ডলারের বোমার চালান বন্ধ করার পক্ষে ২৪ জন ভোট দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ভোটদারকারী সব রিপাবলিকান সিনেটররা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির দুটি চুক্তি আটকে দিতে প্রস্তাবগুলো সিনেটে আনেন ভার্মন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি প্রগতিশীল ঘরানার স্বতন্ত্র সিনেটর।
ভোটের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে স্যান্ডার্স বলেন, “ওয়াশিংটন ইসরায়েলের ‘বর্ণবাদী সরকার’কে এমন অস্ত্র সরবরাহ করা চালিয়ে যেতে পারে না, যা নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে একজন ‘জঘন্য মিথ্যাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে স্যান্ডার্স ‘এক্স’ পোস্টে আরো বলেন, “গাজায় শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।”
প্রথমবারের মতো স্যান্ডার্সের প্রস্তাবকে সমর্থনকারী আইন প্রণেতাদের মধ্যে, ওয়াশিংটন রাজ্যের সিনেটর প্যাটি মারে বলেছেন, প্রস্তাবগুলো ‘নিখুঁত’ না হলেও, তিনি গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অব্যাহত দুর্ভোগকে সমর্থন করতে পারেন না।
মারে এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিচ্ছি এই বার্তা দিতে: নেতানিয়াহু সরকার এই কৌশল চালিয়ে যেতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছেন। আমরা গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করছি- সীমান্তের ওপারে যখন প্রচুর পরিমাণে সাহায্য ও সরবরাহ পড়ে আছে, তখন শিশু এবং পরিবারগুলোর অনাহার বা রোগে মারা যাওয়া উচিত নয়।”
মার্কিন জনগণের মধ্যে গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা ক্রমবর্ধমান হওয়ার পাশাপাশি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আকারে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ আমেরিকান বলেছেন, তারা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সমর্থন করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৪২ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েলের অভিযান সমর্থন করেছিলেন।
গ্যালাপের মতে, পরিচয় প্রকাশ করে মাত্র ৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বলেছেন যে তারা ইসরায়েলের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যেখানে ৭১ শতাংশ রিপাবলিকান বলেছেন জানিয়েছেন যে, তারা ইসরায়েলি পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।
ঢাকা/ফিরোজ