জাহিদুর রহিম অঞ্জন: সিনেমা যাঁর জীবন
Published: 27th, February 2025 GMT
জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদ, সবশেষ জাহিদুর রহিম অঞ্জন। অকালপ্রয়াণ যেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক অমোঘ নিয়তি। এই দেশ তার সবচেয়ে মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের হারিয়েছে বারবার। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বল্পপ্রজ। কিন্তু তাঁদের চলচ্চিত্র বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের মানুষকে ধারণ করেছে পরম যত্নে।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন সেই স্বল্পসংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাতার একজন, যিনি একাধারে চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক, শিক্ষক, নির্মাতা ও বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের সামনের সারির মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং একাধিকবারের সভাপতি। পাশাপাশি ফোরাম আয়োজিত আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালকও ছিলেন। শর্ট ফিল্ম ফোরাম ছিল তাঁর নিজের বাড়ির মতো।
বাংলাদেশের অনেক তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকর্মী জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ছাত্রছাত্রী। তাঁদের কাজ, চিন্তা ও আলাপে পাওয়া যায় তাঁর ভাবনার প্রতিফলন। দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন চলচ্চিত্র আন্দোলন এবং এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেই সঙ্গে ছিল অসাধারণ হিউমার ও স্যাটায়ার করার ক্ষমতা।
জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ছাত্রমাত্রই স্বীকার করবেন, তাঁর চলচ্চিত্রের ইতিহাস পড়ানোর কায়দা কতটা উপভোগ্য ছিল। বহু বছরের পুরোনো শতচ্ছিন্ন একটা নোটবুক নিয়ে ক্লাসে আসতেন। খুব যত্ন করে একটা একটা করে পৃষ্ঠা ওলটাতে থাকতেন আর সবাইকে নিয়ে যেতেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসের আঁতুড়ঘরে; সেখান থেকে নিওরিয়েলিজম, নিওজার্মান, সুররিয়ালিস্ট, সোভিয়েত, জাপানি, আফ্রিকান, ফরাসি, ইরানি বা ভারতীয় নবতরঙ্গের ইতিহাসের কতশত অলিগলির ভেতরে। বেরিয়ে আসত কত চমকপ্রদ গল্প, ঘাত–প্রতিঘাতে চাপা পড়া কত চলচ্চিত্রের কাহিনি!
জাহিদুর রহিম অঞ্জনের বর্ণনায় একেকটি চলচ্চিত্র কল্পদৃশ্যে প্রতিফলিত হতো অবলীলায়। নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এ ছিল পরম পাওয়া। তিনি বলতেন, ‘পর্দায় সিনেমা নিছক বিনোদন নয়; বরং মানুষের জীবনের নানা বাস্তবতা, ঘাত–প্রতিঘাত কিংবা শিল্পচর্চার একটি আধুনিক ও শক্তিশালী মাধ্যমও।’
নির্মাতা হিসেবেও জাহিদুর রহিম অঞ্জনের প্রাপ্তি ছিল ঈর্ষণীয়। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়াকালে ১৯৯০ সালে তিনি তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘মর্নিং’ নির্মাণ করেন। আন্তন চেখভের গল্প অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবি তখন পুনেতে সাড়া ফেলে দেয়। তাঁর ছবিটি অনেক দিন পরবর্তী ব্যাচগুলোয় ডিপ্লোমা ছবির রেফারেন্স হিসেবেও পড়ানো হয়েছে।
অনেক বছর বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালে জাহিদুর রহিম অঞ্জন নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের আমাবস্যা’ অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সর্বশেষ নির্মাণ ‘চাঁদের আমাবস্যা’। দীর্ঘদিন ধরে ছবিটি নির্মাণ করছিলেন তিনি। ছবিটি সম্প্রতি শেষ হয়েছে, ছাড়পত্রও পেয়েছে। কিন্তু ছবিটি মুক্তির আগে তিনি নিজেই মুক্তি নিলেন পৃথিবী থেকে।
জাহিদুর রহিম অঞ্জনের এই মৃত্যুতে কোনো অপ্রাপ্তি ছিল কি? সম্ভবত না। যে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা আর সৃজনকর্মে এক সার্থক জীবন কাটিয়েছেন তিনি, তাতে কোনো অপ্রাপ্তি থাকার কথা নয়। মৃত্যুর ঠিক কয়েক দিন আগেই ফেসবুকে বলেছিলেন, ‘দ্য আইডিয়া অব রিডিম্পশন ইজ অলওয়েজ গুড নিউজ, ইভেন ইফ ইট মিনস স্যাক্রিফাইস অর সাম ডিফিকাল্ট টাইমস।’
জাহিদুর রহিম অঞ্জন প্রায়ই বলতেন, সিনেমাকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখা যায় না, সিনেমা যাপিত জীবনেরই অংশ। তিনি নিজে সে জীবন যাপন করেছেন; তাঁর বন্ধু, অনুজ ও ছাত্রছাত্রীদের সেই জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রয়াণে শ্রদ্ধা।
জোবায়ের রায়হান চলচ্চিত্রকর্মী
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র ন র ম ত ন চলচ চ ত র চলচ চ ত র র
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্বামীকে হত্যা, ফাঁদ পেতে ধরা হলো প্রেমিককে
পাবনার চাটমোহর উপজেলার কাটেঙ্গা গ্রামে ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
দশদিন পর ঘটনা জানাজানি হলে অভিযুক্ত স্ত্রী শারমিন খাতুন ও তার প্রেমিককে আটক করে পুলিশ। শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেলে পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে ঘটনাটি জানায়।
এর আগে গত ৩০ নভেম্বর চাটমোহরের দক্ষিণপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মৃত স্বামী শের আলী (৩৫) দক্ষিণপাড়া গ্রামের ভোলা প্রামানিকের ছেলে। শারমিন খাতুন (২৬) কাটেঙ্গা গ্রামের শাহ আলমের মেয়ে। এবং তার প্রেমিক অনিক (২২) একইগ্রামের মহাজন সরকারের ছেলে।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ নভেম্বর শের আলীর মৃত্যু হয়। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর বিষয়টি স্বাভাবিক হিসেবে শুরুতে মেনে নিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকে ঘিরে পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।
জানা যায়, শের আলীর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ইউটিউবারদের মাধ্যমে চিকিৎসা সহায়তার অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সেই অর্থের একটি বড় অংশ শারমিন অনিককে দিয়েছেন।
মৃত শের আলীর ফুপাতো ভাই এনামুল হোমেনের দাবি, শারমিন ও অনিকের মধ্যে ফেসবুক মেসেঞ্জারে হওয়া কথোপকথন ঘেঁটে টাকা লেনদেনের একাধিক তথ্য পাওয়া গেছে। সেখান থেকেই প্রথম সন্দেহের সূত্রপাত।
এরপর ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পরিবারের সদস্যরা কৌশল অবলম্বন করেন। শারমিনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে অনিককে টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আসতে বলে মেসেজ পাঠানো হয়। অনিক এই ফাঁদে পা দেন।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অনিকে টাকা নিতে এলে স্থানীয়রা তাকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে অসংলগ্ন বক্তব্য ও পরস্পরবিরোধী তথ্য দিলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। পরে অনিক ও শারমিন স্বীকার করেন, প্রায় চার মাস ধরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে।
শারমিন এ সময় জানান, গত ৩০ নভেম্বর একসঙ্গে দশটি ঘুমের ওষুধ শের আলীকে তিনি খাইয়েছিলেন। এতে শের আলীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
শের আলীর মা শিরীনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘‘আমার অসুস্থ ছেলেকে ওর বউ ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে। সে সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে এসে দেখি আমার ছেলে আর বেঁচে নেই। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’’
চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘মৃত ব্যক্তির পরিবারে পক্ষ থেকে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি বা মামলা করেনি। যেহেতু ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে আটক করা হয়েছে, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ আইনগত প্রক্রিয়া শেষে তাদের পাবনা আদালতে সোপর্দ করেছে।’’
ঢাকা/শাহীন//