শুরু হলো অগ্নিঝরা মার্চ। মহান স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, অচিরেই যা জনযুদ্ধের রূপ লাভ করে। ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর সফল পরিণতিস্বরূপ জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। তাই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিনটিকে বলা যায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনার দিন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনকে বলা হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাতকাল।
১৯৫২ সালে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেলেও তার সূচনা হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতালের মাধ্যমে। অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরিণতিতে মাত্র কয়েক মাস আগে–১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট–প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে সেটিই ছিল প্রথম হরতাল। ওই আন্দোলনেই এ ভূখণ্ডের বাঙালি মুসলমান তার জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে সম্বিৎ ফিরে পায়, অনুভব করে ধর্মীয় সাজুয্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে তারা প্রায় সব অর্থেই স্বতন্ত্র। বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে যৌথ পথচলাও শুরু হয় তখন থেকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে এ দেশের মানুষ মুখোমুখি হয় ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের।
যদি বলা হয় এ নির্বাচনই ছিল অগ্নিঝরা মার্চ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বের ভিত্তি তাহলে ভুল হবে না। এই নির্বাচনটিই স্পষ্ট করে দেয় ছয় দফার ভিত্তিতে বাংলার মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে গড়তে চায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংলাপ বা লড়াইয়ে কে বা কোন দল প্রতিনিধিত্ব করবে তাও এতে নির্ধারিত হয়। ওই নির্বাচনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার স্বীকৃতি দেয়।
তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি শাসকদের হতবাক করে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয় পায়। ৩০০ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে। সংখ্যলঘু দল হয় জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি–পিপিপি, যদিও তারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।
কথা ছিল, নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, সেই দল অন্যদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের জন্য সংবিধান বানাবে। কিন্তু ইয়াহিয়ার পাশাপাশি পিপিপি সংসদের অধিবেশন নিয়ে টালবাহানা শুরু করে।
বলে রাখা দরকার, নির্বাচনটি নিয়েও সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নানা টালবাহানা করে। এটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর; কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা উপেক্ষা করে বন্যার উছিলা দিয়ে ইয়াহিয়া তাঁর নতুন তারিখ ৭ ডিসেম্বর ঠিক করেন। ডিসেম্বরে ভোলায় প্রলঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর হতাহতের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আবারও নির্বাচনটি পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শেখ মুজিবের কড়া হুঁশিয়ারির পর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়, শুধু সিদ্ধান্ত হয় দুর্গত এলাকার ভোট হবে জানুয়ারিতে।
সুতরাং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নিয়ে সরকার তথা পশ্চিম পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্টের গড়িমসি বিচিত্র কিছু ছিল না। শেখ মুজিব ১৫ ফেব্রুয়ারি পরিষদের প্রথম অধিবেশন চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া জানালেন, দুই অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে শাসনতন্ত্রের মৌলিক ধারা নিয়ে সমঝোতা না হলে তিনি অধিবেশন ডাকবেন না। শেখ মুজিব বলে দিলেন, সংসদের সভাতেই দুই অঞ্চলের সদস্যরা ওই আলোচনার সুযোগ পাবেন। ভুট্টো জানালেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে তাঁর দলের পক্ষে সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। ইয়াহিয়া এ প্রস্তাব গ্রহণ করে ৩ মার্চ সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করলেন।
কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। তাঁর যুক্তি, পিপিপি ও অন্য কয়েকটি দল এতে যোগদান করবে না বলায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ঘোষণায় পুরো ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। সেখানকার দর্শকরাও খেলা পণ্ড করে যোগ দেন পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভরত হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে। সেদিন দিলকুশার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ছিল। জনতা সেখানে গিয়ে জোরদার কর্মসূচি দাবি করেন। পূর্বাণী হোটেলেই শেখ মুজিব দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। তিনি জানিয়ে দেন, ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা হবে, যেখানে মূল ঘোষণা দেবেন।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দু–তিন দিনে পড়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য পাঁচ উপন্যাস
মুক্তিযুদ্ধের বঞ্চনা ও প্রতিরোধের মর্ম অনুধাবন ও সামষ্টিকভাবে জাতীয় চেতনাবোধ প্রজ্বালনে বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। যুদ্ধের ঘটনাশ্রয়ী বড় উপন্যাসগুলো কেবল ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দেয় না, বরং যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে পাঠককে নিবিড়ভাবে পরিচিত করায়। আজ থাকছে যুদ্ধনির্ভর অজস্র লিখিত ভাষ্যের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উপন্যাস, যেগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে আখ্যানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করতে সক্ষম এবং যুদ্ধের অভিঘাত, ত্যাগ ও প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে।
১. রাইফেল রোটি আওরাত‘রাইফেল রোটি আওরাত’ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত একটি কালজয়ী উপন্যাস। ১৮২ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ২৮ মার্চের ভোর পর্যন্ত মাত্র তিন দিনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে উদগ্র বীভৎসতায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন, যিনি সপরিবার টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর ভবনে থাকতেন। চারপাশে সহকর্মী ও ছাত্রদের লাশের স্তূপের মাঝেও সুদীপ্ত শাহীন ও তাঁর পরিবার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই বেঁচে থাকার অপরাধবোধ, ভয়াবহ গণহত্যার চাক্ষুষ বিবরণ এবং নতুন ভোরের প্রতীক্ষাই উপন্যাসটির করুণ আবেদন।
আনোয়ার পাশা (১৯২৮—১৯৭১)