২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর বারবার একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সরকার, সংস্কার কমিশন, টাস্কফোর্স, এমনকি পাবলিক আলোচনায় নারীদের অংশগ্রহণ কম কেন? এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অস্বস্তিতে পড়ে অনেক ক্ষেত্রে  প্রতিনিধি হিসেবে এক–দুজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীরা যোগ্য হলেও কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে, কোনো ক্ষমতা না দিয়ে টোকেন হিসেবে তাঁদের রাখা হয়েছে।

নারীরা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নীতিনির্ধারণে বা রাজনীতিতে অংশ নিলেও তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক ক্ষেত্রেই অবমাননাকর। তবে আশার বিষয়, এসব সত্ত্বেও আমাদের দেশের নারীদের অনেকেই এ ধরনের কটূক্তি উপেক্ষা করে চলেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারী ক্ষমতায়নের প্রশ্ন এলে এই যে শহুরে নাগরিক সংস্কৃতিতে নারীর আধিক্যকে নারী ক্ষমতায়ন হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই আধিক্যকে কি সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন বলা যাবে?

আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থান সফল হলেও নারীর লড়াই এখনো থামেনি১৬ ঘণ্টা আগে

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রংপুরে বাংলাদেশ কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের আয়োজনে কৃষক কনভেনশনে আলোচক হিসেবে গিয়েছিলাম। আসন গ্রহণ করতে গিয়ে দেখি, সমাবেশে অধিকাংশই নারী। একজন নারী হিসেবে যেকোনো জায়গায় নারীদের উপস্থিতি যে একাত্মবোধ তৈরি করে, সেই বোধ আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। ফেসবুকে সমাবেশের ছবি দিয়ে যখন লিখি ‘অধিকাংশই নারী’, অনেকেই আমার
মতো ভেবেছিলেন, কৃষিতে নারীরা অগ্রসর ভূমিকা পালন করছেন।

এর আগেও রংপুরে আখচাষিদের সমাবেশে গিয়েছি, কিন্তু এত নারী কৃষক দেখিনি। এবার উপস্থিতি ছিল ভিন্নধরনের কৃষকদের। এর ফলে মনে প্রশ্ন জাগে, কৃষিকাজে এত নারী কোথা থেকে এলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, দেশজুড়ে কৃষি খাত যে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, তাতে কাজের সন্ধানে ভূমিহীন পুরুষ কৃষক ও খেতমজুরেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে বা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এনজিও ও মহাজনদের কাছে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে কেউ কেউ পরিবার রেখে পালিয়ে গেছেন। অথবা ঋণ পরিশোধ করতে কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে রিকশা চালাতে বা দিনমজুরের কাজ করতে চলে গেছেন। আর বাড়িতে রয়ে গেছেন নারীরা।

সভা–সমিতিতে নারীর সংখ্যা গুনে নারীর ক্ষমতায়নের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। কতজন নারী কাজের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন, একই কাজ করে পুরুষের সমান বেতন পাচ্ছেন কি না, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন থেকে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন কি না—এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

এই নারীরাই একই সঙ্গে সন্তান লালন–পালন করছেন, আবার নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে খেতমজুরের কাজ করছেন। দেখা হলো কুঁজো হয়ে যাওয়া এক প্রৌঢ় নারীর সঙ্গে; ১০ থেকে ১১ বছর বয়সী এক নাতনির কাঁধে ভর দিয়ে মিছিলে হাঁটছেন। জানা গেল, তাঁর ছেলেও কাজের সন্ধানে অন্যত্র গিয়েছেন। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য টাকা পাঠাতে পারছেন না।

বাধ্য হয়েই এই নারীরা এসেছেন কৃষিকাজে। আমরা মনে করি, নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াই উচিত। তবে কৃষকসমাবেশে দূরদূরান্ত থেকে আসা এই নারীদের পেছনের কাহিনি প্রশ্ন তৈরি করে, শুধু অংশগ্রহণ বাড়াই কি নারীর ক্ষমতায়ন? নারী ক্ষমতায়ন বলতে তাহলে আমরা কী বুঝব? 

কৃষি ও শিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ

নারীর শ্রমকে সস্তায় কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা কাঠামোগতভাবে তৈরি করা হয়েছে কৃষি খাতকে অবহেলার মধ্য দিয়ে। প্রায়ই শোনা যায়, খেতমজুরের মজুরি বেশি, তাই ফসল উৎপাদনের খরচ বেশি। অথচ বিদ্যুতের খরচ, সারের দাম, সেচের খরচ বেড়েছে, ঋণের সুদও বেশি। হিমাগারের (কোল্ডস্টোরেজ) প্রভাবশালী মালিকেরা ভাড়া দ্বিগুণ করেছেন। এসব ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।

সেচ, সার, বীজ, কোল্ডস্টোরেজের খরচ বাড়ায় উৎপাদনের খরচ কমানোর দায় এখন মজুরের ঘাড়ে এসে পড়েছে; এর ফলে নিরুপায় পুরুষ শ্রমিকেরা কম মজুরিতে কাজ না করে কাজের খোঁজে অন্যত্র তো যাবেনই। আর তাঁরা চলে গেলে সস্তা শ্রম আর কে দেবেন নারীরা ছাড়া?

সারা বিশ্বে যখন কৃষকের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশের কৃষির টাস্কফোর্স প্রতিবেদনে কৃষকের ফসলের মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারপ্রদত্ত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কোনো কথা নেই। বেসরকারি মালিকানার কোল্ডস্টোরেজে প্রতি কেজি আলু রাখতে খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে, কিন্তু টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কোল্ডস্টোরেজ চালুর কোনো প্রস্তাব নেই; বরং বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর ভরসা করার সুপারিশ এসেছে।

আরও পড়ুননারীকে ট্রমাগ্রস্ত করার দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে১৯ ঘণ্টা আগে

গ্রামে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যেসব কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠেছিল—যেমন পাট, চিনি ও খাদ্যশিল্প—সেগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেক কৃষক ও মজুর। আশির দশক থেকে কলকারখানাগুলো বন্ধ হওয়ায় তখন থেকে শ্রমিকদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীরা কাজের খোঁজে দলে দলে শহরের দিকে আসতে থাকেন। এই সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল গার্মেন্টসশিল্প।

অন্যদিকে আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের জন্য খেলার মাঠে এখন র‍্যাব-২–এর হেড কোয়ার্টার, কলোনি ও বাগানবাড়িতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের আঞ্চলিক কার্যালয়। শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন—এগুলো নির্মূল করে দিয়ে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে অনিশ্চয়তার দিকে। আর এই অনিশ্চিত জীবিকার সফরে তাঁরা পেয়েছেন নামমাত্র মজুরি।  

২০২০ সালের ৯টি পাটকল বন্ধের আগে ৫০ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল নারী। পুরুষেরা রিকশা চালিয়ে, সবজি বিক্রি করে, বিভিন্ন পেশায় কাজ করার সুযোগ পেলেও নারীরা পড়েছেন বিপদে। ভঙ্গুর দশায় পড়ে নারীরা বাধ্য হয়েছেন কম মজুরিতে দিনমজুরের কাজ করতে। এখন বেসরকারি পাটকলে মজুরি দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় পাটকলের তিন ভাগের এক ভাগ। সেখানেও নারীরা বৈষম্যের শিকার।

সত্যি বলতে কি, নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো দৃশ্যমান চেষ্টা নেই। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী আলাপ চলছে এমন আইন প্রবর্তনের, যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা থাকে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার, একীভূতকরণের অথবা বেসরকারীকরণের।

করোনাকালে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন–জীবিকায় আঘাত হানা হয়েছিল। সেসব অঞ্চলে কৃষকেরা আগে জানতেন, সরকার নির্ধারিত দামে তাঁরা আখ বিক্রি করতে পারবেন। এখন নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। অন্য সব ফসলের দাম ফসল তোলার মৌসুমে কমে যায়। কৃষকেরা পড়েন বিপদে। এসবের ভার এসে শেষ পর্যন্ত পড়ে নারীদের ওপর। ঘরে–বাইরে নারীদের কাজ করাকে মহিমান্বিত করা হলেও বাস্তবে তাঁদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। 

গার্মেন্টসে নারী শ্রমিকের আধিক্যের কারণ, কম মজুরিতে তাঁদের দক্ষতার চাহিদা রয়েছে। বছরের পর বছর কম মজুরি দিয়ে, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার না দিয়ে, ন্যায্য মজুরির আন্দোলনে শিল্প পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বড়াই করা হচ্ছে। শ্রমিকদের আপত্তি সত্ত্বেও শ্রম কমিশনের সুপারিশ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে শ্রম আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ তহবিল ও গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক না করে, স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দিয়ে, মাতৃত্বকালীন ছুটি, চাকরির নিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতকালে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের দায় নিশ্চিত ছাড়াই এ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে—এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।  

এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ কমানোর নামে অস্থায়ীভাবে যেসব নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরাও মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে বঞ্চিত। ‘কাজ নাই মজুরি নাই’ ভিত্তিতে কাজ করেন অল্প মজুরিতে। যেমন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মরত অস্থায়ী নারী কর্মীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না, সংসারের প্রয়োজনে ছুটি নিতে হলে মজুরি ছাড়া কাজ করতে হয়।

নারীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ

সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের যেটুকু নিশ্চয়তা ছিল, সেটাও মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ কোটার কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
নার্সিং ও শিক্ষকতা পেশায় নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ছিল বলে এত দিন এসব পেশায় নারীদের আধিক্য লক্ষ করা গেছে। ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক কোটা আরোপ করা হলে শ্রমবাজারে নতুন করে রদবদল হবে।

দীর্ঘদিন ধরে এসব পেশায় নারীদের অংশগ্রহণের পেছনে কিছু আর্থসামাজিক কারণ ছিল। নারীরা বাস্তব কারণেই অনেক পেশা বেছে নিতে পারেন না। যেমন ফায়ার সার্ভিস, পরিবহন খাত, প্রতিরক্ষা খাত, ভারী শিল্পকারখানা, নির্মাণ খাতসহ অনেক খাতেই নারীদের অংশগ্রহণ কম।

সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। এত দিন প্রাথমিক শিক্ষক পদে নারীদের জন্য ৬০ শতাংশ চাকরি নির্ধারিত ছিল। ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক কোটা নির্ধারণের পর এখন থেকে নতুন নিয়মে নিয়োগ দেওয়া হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারীদের আধিক্য বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি আর্থসামাজিক কারণ ছিল। যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুরা নারীদের সঙ্গে যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, নারীরা সংবেদনশীলতার কারণে শিশুদের প্রতি অধিক যত্নবান হন, মেয়েশিশুদের মাসিকের সময় তারা নারী শিক্ষকদের সঙ্গে সমস্যার কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এখন প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাভিত্তিক নিয়োগের প্রভাব কেমন হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্য যেসব পেশায় নারীদের আধিক্য ছিল, সেসব ক্ষেত্রেও সুযোগ সংকুচিত হবার আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণে নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন এ দেশের নারীরা। 

নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে বুঝব

শ্রমবাজারে অধিক নারী শ্রমিকের উপস্থিতি আমাদের চাওয়া হলেও সব সময় তা নারীর ক্ষমতায়ন ঘটায় না। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণকে মহিমান্বিত করার পেছনে থাকে সস্তা শ্রম কাজে লাগানোর আকাঙ্ক্ষা। নীতিনির্ধারণ ও রাজনীতিতেও নারীদের অধিক অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সব সময় তা নারীর অধিকার নিশ্চিত করবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই; বরং নারী হোক, পুরুষ হোক, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁকে কতটুকু স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন নারী। তাঁর আমলে নারী মন্ত্রীদের হাত ধরেই কৃষি ও শিক্ষায় জনস্বার্থবিরোধী নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে চারজন নারী উপদেষ্টা রয়েছেন। এ সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে মানসিক নিপীড়ন যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গেছে। পাবলিক পরিসরে নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। সাইবার স্পেসে নারীদের হেয় করার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা পথে বসেছেন।

এটা স্পষ্ট, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু রাজনৈতিক দল বা সভায় নারীদের অংশগ্রহণ দিয়েই নিশ্চিত হয় না, বরং তাঁদের ভূমিকা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, বাস্তবায়নে কতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়, দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এবং তাঁরা কার স্বার্থে কাজ করেন—এগুলো নারীর স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রশ্ন তোলার মানে এই নয় যে সব পুরুষের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এসব প্রশ্ন তোলার অর্থ, কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, খাদ্যনীতি, সামাজিক নিরাপত্তানীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিনীতি থেকে শুরু করে শ্রমনীতি, সমাজকল্যাণনীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষানীতি—সব ক্ষেত্রেই নারীর মঙ্গল জড়িত।

সভা–সমিতিতে নারীর সংখ্যা গুনে নারীর ক্ষমতায়নের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। কতজন নারী কাজের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন, একই কাজ করে পুরুষের সমান বেতন পাচ্ছেন কি না, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন থেকে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন কি না—এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ক ক ষ ত র শ রমব জ র দ র জন য র ক জ কর ব সরক র ন শ চয়ত সব ক ষ মন ত র অন শ চ সব প র জন ন র প টকল র খরচ গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামে ২৭ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ পাঠানো হয় ২৮ জুলাই।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকল্পটি নিয়ে করা প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে যে ‘অভিযোগ ও ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ মন্তব্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ফয়েজ আহমদের মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরুদ্ধ।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিবাদপত্রে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে। নিচে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

আরও পড়ুনদুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের২৭ জুলাই ২০২৫

এক. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ফয়েজ আহমদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানাধীন একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ‘এগিয়ে নিতে’ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাস্তবতা হলো, বিটিসিএলের ৫–জি রেডিনেস প্রকল্পে ২৯০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চূড়ান্ত হয়েছে। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই। এবং এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ অর্থই রাষ্ট্রের অপচয়ে পরিণত হবে।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরও বলেছে, ফয়েজ আহমদ শুধু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে দুদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেছেন, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও তিনি তুলে ধরেছেন। এটি দুর্নীতির ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সতর্ক করে দেয় যে তদন্তাধীন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

দুদক চিঠি দিয়ে বিটিসিএলকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫) যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না। দুদক তাদের মতামত জানানোর পরও ফয়েজ আহমদ আবার (২২ জুন) সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

দুদকের নেতিবাচক মতামতের পরও কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের (প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা) দাবিকে সমর্থন করে না। ফয়েজ আহমদ দুদককে দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করার অনুরোধ করতে পারতেন। অনুসন্ধান শেষ হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চলবে না। কেনাকাটায় আর কিছুদিন দেরি হলে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, এ দাবি যৌক্তিক নয়।

‘দুর্নীতি সহায়ক’ বক্তব্যটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতামত, প্রথম আলোর নয়।

দুই. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয়ের চেষ্টার অভিযোগ অসত্য। প্রতিবাদপত্রে কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। সেসব বিবেচনায় নেওয়া হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা ২৬ টিবিপিএস (টেরাবাইট পার সেকেন্ড) নয়, ১২৬ টিবিপিএসের প্রয়োজন হবে। ফাইভ-জি প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ক্ষমতা ‘রিডান্ডেন্ট’সহ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ নেই।

প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ২০২১ সালে প্রণীত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় মতামত দেয় যে শুধু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ যদি ২৬ টিবিপিএস হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ‘সিস্টেমের লাইন ক্যাপাসিটি’ ১২৬ টিবিপিএস প্রয়োজন হবে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এই প্রকল্প নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুই হলো ‘দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘনপূর্বক শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ (যোগ্য) ঘোষণা করাসহ নন-রেসপনসিভ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ ‘অভিযোগ’ই শুধু তুলে ধরা হয়েছে।

তা ছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ২৬ টিবিপিএস চাহিদা নিরূপিত হয়েছিল, কিন্তু কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট—এটা ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বিটিসিএলের ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে রয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে টেলিকম যন্ত্রপাতিও অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ কারণে দীর্ঘ সময় যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য থাকে না। সাধারণভাবে টেলিকম যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল সাত বছর ধরা হয়। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও কারিগরি নির্দেশে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল সাত বছর নির্ধারিত রয়েছে। তিনি সাবধান করেছিলেন যে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণে বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি চাওয়া হলেও বাস্তবে তা সচল থাকার নিশ্চয়তা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি কেনা হবে, তার একটি বড় অংশই ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না এবং ব্যবহারের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্র কেনার অনুমোদন না দেওয়ার কারণেই আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

তিন. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, দুদকের ওপর প্রভাব বিস্তারের দাবি তথ্যভিত্তিক নয়। দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা এবং চিঠি পাঠানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অংশ। এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই সংস্থাটির ওপর ‘প্রভাব বিস্তার’ করা হয়নি; বরং তদন্তকাজ চলমান রাখতে এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ সহকারীর দুদকে প্রেরিত আধা সরকারি পত্রের বক্তব্যকে প্রকল্পের কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটা অপসংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক নম্বর পয়েন্টেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানেই প্রতিবেদকের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ বিভাগের এই বক্তব্য আবার উল্লেখ করা হলো। এখানে বলে রাখা দরকার, দুদকের স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পরও চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেওয়া এবং অভিযোগকে ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করা স্বাধীন সংস্থাটিকে প্রভাবিত করারই চেষ্টা। দুদকের মতামত যাতে কেনাকাটার পক্ষে পরিবর্তিত হয়, সে জন্যই ফয়েজ আহমদ দ্বিতীয় দফা আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে দুদক চেয়ারম্যানের ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা’ কামনা করেন।

চার. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কারখানা পরিদর্শন ও জিও (সরকারি আদেশ) জারির প্রেক্ষাপট চেপে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই জিও অনুমোদন না হওয়ায় চীনে কারখানা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী, যখন কারখানা পরিদর্শন সম্ভব নয়, তখন পণ্য সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাহাজীকরণ করা যেতে পারে—বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের নিয়মানুযায়ী কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বিটিসিএলের চারজন প্রকৌশলীর। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীনে যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে নির্দেশনার ৯ নম্বরে কেনাকাটা, জাহাজীকরণের আগে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রেরণের বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি একসেপটেন্সের’ জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। আরও উল্লেখ্য যে এই কেনাকাটার জন্য কারখানায় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জিও গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তা বাতিল করা হয়। ২৪ অক্টোবর (২০২৪) বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ প্রকল্প নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বছরের ৬ জানুয়ারি সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠাতে বলে।  

পাঁচ. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফয়েজ আহমদের চীন সফর নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এতে চীন সফরের ব্যাখ্যা এবং এর সরকার অনুমোদিত বৈধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এটিকে ‘অপরিচিত সংস্থার অর্থে’ পরিচালিত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এটি ছিল সরকারি অনুমোদিত সফর, যার উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা পর্যালোচনা।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এ সফর সরকারের অনুমোদনহীন, তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে, জিওতে উল্লিখিত ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি অপরিচিত। তবে ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই সফরে বিশেষ সহকারীর একান্ত সচিব সফরসঙ্গী ছিলেন, যা সরকারের বিদেশ ভ্রমণবিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নির্দেশনায় একান্ত সচিবদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত সঙ্গে নেওয়া পরিহার করতে বলা হয়েছে।

ছয়. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে শুধু প্রাক্তন আমলাদের বক্তব্য, বাতিল হওয়া দরপত্র এবং অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে ফয়েজ আহমদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের অবস্থান গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার কিছু অংশ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রতি উত্তরের অনুপস্থিতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। ২০ জুলাই আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। তিনি পাঠাননি। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য। উল্লেখ্য, ফয়েজ আহমদের আগের বক্তব্যের চুম্বক অংশ প্রতিবেদনে রয়েছে। পাশাপাশি ৭ জুলাই তা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনুমাননির্ভর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

সাত. টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দুজন কারিগরি ও দুজন ক্রয় বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) কমিটি গঠন করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে কি না, সেটা প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।

আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, প্রথম আলোর প্রতিবেদন মোটেও ‘ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ নয়, এটা ‘বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ও নয়; বরং প্রথম আলোর প্রতিবেদন সঠিক এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ