সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : হৃদয়বান সৎ শিল্প উদ্যোক্তার বিদায়
Published: 13th, March 2025 GMT
অনুসরণ করার মতো মানুষ বাংলাদেশে এমনিতেই কম, তার মধ্যে যখন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মতো একজন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, মানবিক শিল্প উদ্যোক্তা চলে যান, তখন একটা শূন্যতা আমাদের ঘিরে ধরে। সততার সঙ্গে ব্যবসা করে যে সফল হওয়া যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী।
জন্মেছিলেন কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি স্যার সৈয়দ নাসিম আলী। মঞ্জুরের বড় ভাই সৈয়দ এস এ মাসুদও ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও একসময় বিশ্বভারতীর কোষাধ্যক্ষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর সক্রিয় সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল। ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করেছিল।
মঞ্জুর এলাহী কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাস করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন পাকিস্তান টোব্যাকো কোম্পানিতে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর বরাবরের স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার এবং এ দেশে চামড়াশিল্পের বিকাশে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। আজকের এপেক্স ট্যানারি, এপেক্স ফুটওয়্যার, এপেক্স ফার্মা, এপেক্স ইনভেস্টমেন্টস—সবই তাঁর সততা ও দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তোলার কীর্তি বহন করছে।
তিনি যে কেবল শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্য লাভ করেছেন, তা নয়। তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ডও ছিল বিভিন্নমুখী। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই সোসাইটি, ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যবসায়ীদের নানা শীর্ষ সংগঠনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের অন্যতম সুশৃঙ্খল ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
বিত্তের সঙ্গে চিত্তেরও ঔদার্য ছিল মঞ্জুর এলাহীর। বন্ধুরা সব একে একে পরপারে চলে যাচ্ছেন। আবার হয়তো আমাদের দেখা হবে সমুখে, যেখানে শান্তি পারাবার। মঞ্জুর এলাহীর স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দুবার—১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আমাদের দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। দেশের জন্য কর্তব্য পালনের আহ্বানকে তিনি উপেক্ষা করেননি।
মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৭ সালে করাচিতে আমাদের বন্ধু আবু তালেবের মাধ্যমে। মঞ্জুর এলাহীর করাচির বাসায়ই নৈশভোজে একদিন আলাপ হলো কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা তাঁর বড় ভাই বিচারপতি মাসুদের সঙ্গে। তিনি তখন বিশ্বভারতীর কোষাধ্যক্ষ। তাঁর সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে আমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত আলমগীর কবির সম্পাদিত সাপ্তাহিক এক্সপ্রেসে রবীন্দ্রসংগীতবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাঠিয়েছিলাম।
১৯৭২ সালে বাসা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একদিন রাস্তায় মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে দেখা। আমার বাসা খোঁজার বিষয় জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাজেট কত?’
আমি যখন পাঁচ শ টাকার কথা জানালাম, তিনি বললেন, ‘ইন্দিরা রোডে আমার শ্বশুরের একটা বাড়ি আছে। আমরা পরিচিত কাউকে খুঁজছিলাম, তোমার পছন্দ হলে নিতে পারো।’ পরদিনই আমরা গিয়ে উঠলাম ২ ইন্দিরা রোডের সেই বাড়িতে।
করোনাকালে তাঁর স্ত্রী চলে যাওয়ার পর তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। ছেলে-মেয়ে সকালে নিজেদের কাজে বেরিয়ে যায়, তারপর একা একা বাসায় ভালো লাগে না। আমাকে বলতেন, আমি অফিসে এসে কাজকর্ম কিছু করি না। চা খাই, পত্রিকা পড়ি, লোকজন এলে কথাবার্তা বলি। আমি মাঝেমধ্যেই তাঁর অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে আসতাম। তাঁর সঙ্গ সব সময়ই উপভোগ্য ছিল।
বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। বারবার নিউমোনিয়া হচ্ছিল। প্রতিবারই তিনি সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা নিতে কিছুদিন থেকেছেন। এবারের আগেরবার তাঁকে চিকিৎসক তিন মাস সিঙ্গাপুরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে তারাপদ রায়ের বই পাঠিয়েছিলাম, যাতে সরস লেখাগুলো পড়ে তাঁর মনটা হালকা হয়।
তাঁর ছেলে নাসিম ও মেয়ে মোনা তাদের বাবার যে যত্ন নিয়েছে, তা তুলনাহীন। পালা করে করে তারা সিঙ্গাপুরে বাবার কাছে ছিল। এবার দুজনই তাঁর চলে যাওয়ার সময় সেখানে ছিল। নাসিমের স্ত্রী, তাদের পুত্র–কন্যাদের শোকে আমরাও অংশী।
বিত্তের সঙ্গে চিত্তেরও ঔদার্য ছিল মঞ্জুর এলাহীর। বন্ধুরা সব একে একে পরপারে চলে যাচ্ছেন। আবার হয়তো আমাদের দেখা হবে সমুখে, যেখানে শান্তি পারাবার। মঞ্জুর এলাহীর স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।
রামেন্দু মজুমদার নাট্যব্যক্তিত্ব
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।