কেরানীগঞ্জে ব্যবসায়ীকে খুন—‘অনেক যন্ত্রণা ও কষ্ট দিয়ে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে’
Published: 23rd, March 2025 GMT
ঢাকার কেরানীগঞ্জে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে দিনদুপুরে নির্মাণসামগ্রী ব্যবসায়ী জুবায়ের হোসেনকে (৩৬) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। গতকাল শনিবার দিবাগত রাতে নিহত ব্যক্তির বড় ভাই মীর হামিদুল রহমান বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন।
মামলায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা তাঁতী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওমর ফারুক ঢালী ওরফে মোল্লা ফারুককে প্রধান আসামি করে ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩০ থেকে ৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। দ্রুতই তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।
গতকাল বেলা দেড়টার দিকে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকায় দিনদুপুরে নির্মাণসামগ্রী ব্যবসায়ী জুবায়ের হোসেনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বাবু খান (২৮) নামের আরও একজন গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন।
আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থল গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকার জললুল মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, মার্কেটের দ্বিতল ভবনের নিচতলায় নিহত জুবায়েরের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবু বকর সিদ্দীক এন্টারপ্রাইজ। দ্বিতীয় তলায় প্রধান আসামি মোল্লা ফারুকের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফারুক ল্যান্ড মার্ক। ঘটনার পর থেকে ওই মার্কেটের নিচতলাসহ আশপাশের কয়েকটি দোকান বন্ধ আছে। এ সময় নিহত জুবায়েরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে কয়েকজন উৎসুক জনতাকে দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন মুদিদোকানদার বলেন, ‘দুই দিন আগেও এই সময় দোকানে ক্রেতাদের ভিড় থাকত। এখন মানুষ আসতে ভয় পাচ্ছে। আমরাও আতঙ্কে আছি।’
গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকার এক গৃহবধূ বলেন, ‘জোহরের নামাজের কিছুক্ষণ পর কয়েকজন ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পাই। জানালা দিয়ে দেখি, এক রক্তাক্ত লোক দৌড়াচ্ছেন, পেছনে কয়েকজন তাঁকে তাড়া করছে। এরপর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনি। তার পর থেকে আতঙ্কে আছি, বাসা থেকেও বের হচ্ছি না।’
নিহত ব্যবসায়ী জুবায়ের ১০ বছর বয়সী আবু বক্কর সিদ্দীক নামের এক সন্তানের জনক। তাঁর সন্তানটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। ছেলের নামেই তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন। ঘটনাস্থল গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকা থেকে ৩০০ মিটার পশ্চিমে উত্তরপাড়া মসজিদপাড় এলাকায় জুবায়ের হোসেনের বাড়ি। আজ বেলা একটার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশীরা জুবায়েরের বাড়িতে ভিড় করেছেন। নিহত ব্যক্তির বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও স্বজনেরা মাতম করছেন। ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার চেয়ে তাঁর বোন হাফিজা বেগম বিলাপ করছেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নিহত ব্যক্তির বোন হাফিজা বেগম বলেন, ‘আমার ভাই জুবায়ের অনেক শান্তশিষ্ট ছিল। মোল্লা ফারুক ও তার বাহিনী আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করল। অনেক যন্ত্রণা ও কষ্ট দিয়ে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সকলের দ্রুত গ্রেপ্তার ও ফাঁসি চাই।’
নিহত ব্যক্তির স্ত্রী শাবানা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মোল্লা ফারুকের বাহিনী আমার স্বামীরে মাইরা ফালাইল। এহন আমি আমার প্রতিবন্ধী পোলারে নিয়া কেমনে থাকুম, কেমনে মানুষ করুম। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমরা মোল্লা ফারুকের ফাঁসি চাই।’
আরও পড়ুনকেরানীগঞ্জে দিনদুপুরে কুপিয়ে ও গুলি করে ব্যবসায়ীকে হত্যা২২ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনকে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মুখ্য সংগঠক মোত্তাসিন বিশ্বাস। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে এ হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের দুটি ছবি লাল দাগ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেন মোত্তাসিন। ক্যাপশনে তিনি আনোয়ার হোসেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘....সত্য লিখুন, না হলে আপনিও ছাড় পাবেন না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
মোত্তাসিন বিশ্বাসের পোস্টের পর মন্তব্যের ঘরে আনোয়ার হোসেনকে একাধিক আইডি থেকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে মোত্তাসিনের আইডি থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর পোস্টটি তাঁর ওয়ালে আবার দেখা যায়। এ হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ’।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে মোত্তাসিন বিশ্বাস আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে হলুদ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। এটি গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে থামিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘পুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েই এমন পোস্ট করেছেন বলে জানিয়েছেন মোত্তাসিন।
তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেলেছিলেন, পরে মুছে দিয়েছেন। আনোয়ার হোসেনের করা কোন সংবাদটির বিষয়ে পোস্ট করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাকে বাধা দেওয়ার সংবাদটির কথা জানান।
মোত্তাসিন বিশ্বাস আরও বলেন, প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন চব্বিশের আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সংবাদটি এভাবে কেন লিখেছেন, তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। সে জন্যই তিনি ফেসবুকে লিখেছেন।
আনোয়ার হোসেন জিডিতে উল্লেখ করেছেন, স্ট্যাটাসে তাঁর দুটি ছবি ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পোস্টে মোত্তাসিনের অনুসারীসহ আরও অনেকে খারাপ মন্তব্য করে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় জিডি করার কথা জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন। এটি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুর রাহিম বলেন, এই পোস্ট দেওয়ার পর রাতে তাঁরা এটি নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পোস্টটি ডিলিট করা হবে।
আরও পড়ুনপুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা২৭ এপ্রিল ২০২৫সাংবাদিক সমাজের নিন্দা-প্রতিবাদআনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় জরুরি সভা করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গতকাল মঙ্গলবারের সভায়। অবহিত করার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাবতীয় সংবাদ বর্জন করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিজেএ) সভাপতি রফিকুল আলম। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিটিজেএর নেতা ও সদস্যরা।
সভার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিজনক ও হুমকিস্বরূপ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব অধিকারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার অধিকার। একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ, যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করেছে।’ অবিলম্বে মোত্তাসিন বিশ্বাস তাঁর দেওয়া পোস্টটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ না করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।