প্রায় ৩৫ বছরের অধিককাল বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দেখেছি, বাংলাদেশে অধিকতর মন্দ ঋণ, দুর্বল সেবাপণ্য, অতি দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, বুদ্ধিদীপ্ত ও রূপান্তরকামী কর্মকর্তার অভাব এবং ব্যাংকের দুর্বিনীত মালিকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপই এখানকার স্বাভাবিক চিত্র। তার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যোগ হতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল বা একপেশে নজরদারি। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। তবে সেটা এখনো বেশ কম।

অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, ভোক্তাদের চাহিদার পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাত নাটকীয়ভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিছু ব্যাংক যেখানে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সেখানে অন্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতের ব্যাংকিং কেমন হবে? কীভাবে আমাদের ব্যাংকগুলো পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকবে?

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয়করণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে, যা ব্যবসার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে। ভালো কেন্দ্রীয়করণের সঙ্গে সার্বিক সুশাসনের উন্নতি ঘটেছে। বড় করপোরেট ও রিটেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা শাখাগুলোকে মূল পরিচালনাকারী কেন্দ্রের আওতায় নিয়ে আসার ফলে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহকসেবার মান উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংকিং পরিষেবার বিস্তার গ্রাহকদের জন্য লেনদেন সহজতর করছে।

তা ছাড়া ব্যাংকিং খাত এখন কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্টের (সিআরএম) দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংক প্রযুক্তিসহ সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যে বেশ বিনিয়োগ করেছে। আরও করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এই ব্যাংকগুলোর সম্মানিত গ্রাহকেরা প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও এখন তাঁরা সুবিধা উপভোগ করছেন। একজন গ্রাহকের সামগ্রিক আর্থিক চাহিদা বুঝে তাঁকে উপযুক্ত সেবা প্রদান করা হচ্ছে। রিলেশনশিপ ম্যানেজারদের (আরএম) দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে করপোরেট লেনদেন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও ব্যক্তিগত ব্যাংকিংয়ের সমন্বয় করতে, যাতে গ্রাহকেরা একক প্ল্যাটফর্ম থেকেই সব ধরনের আর্থিক সহায়তা পান।

ব্যাংকগুলো যদি প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্বই টিকে থাকা অসম্ভব হবে

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঋণের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। ব্যাংকগুলো বুঝতে পারছে, শুধু ক্যাশ ক্রেডিট বা ঐতিহ্যবাহী ঋণপদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক নয়; বরং স্বল্পমূল্যের আমানত সংগ্রহ করে করপোরেট ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন মুনাফা বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন দ্রুত অর্থ সংগ্রহ ও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বাড়াতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, বিগ ডেটা অ্যানালিটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেনস (এআই) এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির মতো উদ্ভাবনগুলোর ওপর জোর দিচ্ছে। এআই প্রযুক্তি, যেমন জেনএআই, আর্থিক পরিষেবাগুলোয়, বিশেষত ব্যাংকিংয়ে, কাস্টমাইজড পরামর্শ ও মার্কেট ইনসাইট প্রদানের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে। রোবো-অ্যাডভাইজারগুলো জেনএআই ব্যবহার করে বাজারের ট্রেন্ড, গ্রাহকের পছন্দ ও সোশ্যাল মিডিয়া ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি ব্যক্তির প্রোফাইলের ঝুঁকি ও পছন্দ অনুসারে কাস্টমাইজড আর্থিক সুপারিশ প্রদান করে।

ব্যাংকগুলোয় এআই গ্রাহকসেবাকে উন্নত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যেমন এআইচালিত চ্যাটবট, যা সাধারণ প্রশ্ন, যেমন অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা লেনদেনের ইতিহাস পর্যালোচনা করার মতো সহজ কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারে। জেনএআই আর্থিক বিবৃতি ও পেটেন্ট বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে। যার ফলে আর্থিক পরামর্শদাতারা আরও তথ্যভিত্তিক, ডেটাভিত্তিক পরামর্শ প্রদান করতে পারেন। এই এআই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নের উত্তর দেয়, প্রশাসনিক কাজের সময় সাশ্রয় করে এবং গ্রাহকসেবার মানে উন্নতি ঘটায়।

তা ছাড়া এআই গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কাজ, যেমন রিপোর্ট তৈরি করা, ক্রেডিটের ঝুঁকি মূল্যায়ন, জালিয়াতি শনাক্ত করা, গ্রাহক অনবোর্ডিং, স্বয়ংক্রিয় ঋণ অনুমোদন, কাস্টমারের ৩৬০° বিশ্লেষণ, ট্যাক্স ফাইলিং ও রিপোর্টিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নির্ভুলভাবে সম্পূর্ণ করতে পারে। ব্যাংকগুলোয় এআই মডেলগুলো রিয়েল টাইমে লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে সম্ভাব্য জালিয়াতি কার্যকলাপ শনাক্ত করে, যাতে সেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোধ করা সম্ভব হয়। অভ্যন্তরীণ ডেটা বিশ্লেষণ করে এআই রেগুলেটরি রিপোর্ট লেখার প্রক্রিয়া সহজতর করতে সাহায্য করে, সেই সঙ্গে আর্থিক সমস্যা চিহ্নিত করে। ব্যাংকগুলোও গ্রাহকের আর্থিক ইতিহাসের ভিত্তিতে ক্রেডিটের ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে এবং ব্যক্তিগত ঋণ প্রস্তাব তৈরি করতে এআই ব্যবহার করে। কোডিং থেকে শুরু করে আইনি এবং আইটি কাজ স্বয়ংক্রিয়করণ—প্রতিটি ধাপে এআই দ্রুত প্রোটোটাইপিং ও সলিউশন ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরকে আজকের পরিবর্তনশীল আর্থিক খাতে ফ্লেক্সিবল, কমপ্লায়েন্ট ও উদ্ভাবনী থাকতে সহায়তা করে। একটি সফল ব্যাংকের সুদ ও ফি আয়ের অনুপাত ৫০:৫০ হওয়া উচিত।

 একটি স্মার্ট ব্যাংক সব সময় চেষ্টা করবে সুদের বদলে ফি আয় বৃদ্ধির এবং এভাবে ধীরে ধীরে ব্যালান্স শিট ঝুঁকি এড়াবে। একটি ভালো ব্যাংক সব সময় চেষ্টা করবে করপোরেট পরামর্শ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, কাঠামোবদ্ধ অর্থায়ন বা সিন্ডিকেশন থেকে নিজেদের জন্য বেশির ভাগ অর্থ আয় করতে, যেখানে তারা অন্যদের সঙ্গে দায় শেয়ার করার মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে পারবে। ভালো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই সুদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না থেকে এখন করপোরেট পরামর্শ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, কাঠামোবদ্ধ অর্থায়ন বা স্ট্রাকচার্ড ফাইন্যান্স ও সিন্ডিকেশন ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ফি আয় বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এতে ঝুঁকি কমছে এবং ব্যালান্স শিট আরও স্থিতিশীল হচ্ছে।

ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজারের সুদহারের অস্থিরতার প্রভাব এড়াতে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি আমানতের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি ও স্বল্প ব্যয়ের আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দিচ্ছে; পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর জন্য মানসম্মত ঋণনীতি নির্ধারণ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যাতে তারা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে পারে।

ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে প্রযুক্তির ব্যবহার, বাজারের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা। আগামী দিনে ব্যাংকগুলো শুধু আমানত ও ঋণসেবা নিয়ে কাজ করবে না, বরং তারা ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ফিনটেক একীকরণ এবং ব্লকচেইনভিত্তিক নিরাপদ লেনদেনের মতো নতুন সেবা দেবে।

বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির এই যুগে ব্যাংকিং খাতের টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত পরিবর্তন জরুরি। আজকের ব্যাংকগুলো যদি প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্বই টিকে থাকা অসম্ভব হবে। পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো এবং উদ্ভাবনকে গ্রহণ করাই হবে ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূল চাবিকাঠি।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ র হক র করপ র ট ক স টম আর থ ক ল নদ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘নয়া মানুষ’

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রান্তিক চরের মানুষের জীবনযাপন, মানবিকতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের চিত্র নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’। প্রশংসিত এই চলচ্চিত্র জায়গা করে নিয়েছে ‘কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর পঞ্চম আসরে। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে আজ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের এই আলোচিত চলচ্চিত্রটি। 

৭ দিনব্যাপী এ উৎসবে মিসর, জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ভারতের নির্বাচিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রদর্শিত হবে ‘নয়া মানুষ’, যা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছে উৎসবে। 

আরো পড়ুন:

দুই গায়িকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, দ্বন্দ্ব চরমে

সমালোচনা নিয়ে মুখ খুললেন ভাবনা

২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘নয়া মানুষ’ দর্শক ও সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ায়। আ. মা. ম. হাসানুজ্জমানের লেখা ‘বেদনার বালুচরে’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেন মাসুম রেজা। 

চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, মৌসুমী হামিদ, আশীষ খন্দকার, ঝুনা চৌধুরী, শিখা কর্মকার, নিলুফার ওয়াহিদ, বদরুদ্দোজা, মাহিন রহমান, নাজমুল হোসেন, স্মরণ সাহা, সানজানা মেহরান ও শিশুশিল্পী ঊষশী। 

উৎসবে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গল্পকার ও অভিনেতা আ. মা. ম. হাসানুজ্জমান বলেন, “আমি যখন গল্পটি লিখি, তখন এত কিছু ভাবিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রটি দর্শক দেখার পর যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তা সত্যিই অকল্পনীয়। ‘নয়া মানুষ’ ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করছে, শান্তির বার্তা দিচ্ছে, ধর্মের প্রকৃত দর্শন তুলে ধরছে—এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।” 

চলচ্চিত্রটির নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি বলেন, “আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিচ্ছে—এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। কাশ্মীর ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ‘নয়া মানুষ’ অংশ নিচ্ছে, যা দেশের চলচ্চিত্রের জন্যও একটি বড় সাফল্য।” 

চাঁদপুরের দুর্গম কানুদীর চরে চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটির। চিত্রগ্রহণ পরিচালনা করেছেন কমল চন্দ্র দাস। সিনেমাটির সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাউল শফি মণ্ডল, চন্দনা মজুমদার, বেলাল খান, অনিমেষ রয়, মাসা ইসলাম ও খাইরুল ওয়াসী। সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী, মুশফিক লিটু ও শোভন রয়। 

মানবতার বার্তা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও জীবনবোধের অনন্য মেলবন্ধন নিয়ে ‘নয়া মানুষ’ এবার বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিচ্ছে শান্তি ও সহমর্মিতার বার্তা।

ঢাকা/রাহাত/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ