তথ্য আদান-প্রদানে আন্তসংযোগের অভাবই ডিজিটাল অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ
Published: 10th, April 2025 GMT
বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল বিভাজন কাঠামো। তথ্য আদান-প্রদানে আন্তসংযোগ বা ইন্টারঅপারেবিলিটির ঘাটতির কারণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ডিজিটাল অর্থনৈতিক সেবা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা ও ডিজিটাল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে জাতীয় পর্যায়ে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও ক্লাউড নীতিমালা তৈরি এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি তথ্য সুরক্ষায় সময়োপযোগী আইনি কাঠামো ও নীতিমালার বাস্তবায়ন দরকার।
ঢাকার একটি হোটেলে চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনের শেষ দিনে আজ বৃহস্পতিবার ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’ শীর্ষক অধিবেশনে এমন অভিমত দেন বক্তারা।
সূচনা বক্তব্যে সিটির এদেশীয় পরিচালক মইনুল হক বলেন, ‘আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো প্রযুক্তি আমাদের জীবনধারা ও কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে। ব্যবসার পরিবেশকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।’
মইনুল হক আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল অর্থনৈতিক খাতে আগ্রহ বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। বিশেষ করে আইটি সেবা, ইলেকট্রনিকস, সেমিকন্ডাক্টর ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে। সে জন্য এ খাতে সুযোগ বাড়াতে বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক ও সরকারের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন গড়ে তুলে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
এই অধিবেশনে ‘নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ডিজিটাল অর্থনীতি’ বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, এই খাতে এ ধরনের বাধা কাটিয়ে উঠতে হলে ডিজিটাল পাবলিক অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার চলতি মাসেই একটি নতুন সাইবার সেফটি অর্ডিন্যান্স গেজেট আকারে প্রকাশ করবে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমরা অতীতে ব্যবসার সুরক্ষার কথা ভেবে তথ্য ভাগাভাগি করতে চাইনি। তবে এখন আমাদের সবাইকে এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বিশেষ সহকারী আরও বলেন, নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষায় ‘ডিজিটাল পারসোনাল ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ তৈরি করা হবে, যার আওতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি ‘ইন্টারঅপারেবিলিটি অথরিটি’ গঠিত হবে। এর মাধ্যমে আন্তসংযোগ তথ্য আদান-প্রদানে মানদণ্ড তৈরি করা হবে।
সম্মেলনে উপস্থিত বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের নীতিগত সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুবিধার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, উচ্চগতির ইন্টারনেট, অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি ও শুল্ক কাঠামোসহ সব সুবিধা দেওয়া হবে। তবে এর বিপরীতে আমাদের প্রয়োজনীয় ও দক্ষ কর্মসংস্থান দিতে হবে।’
এরপর কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়, যেখানে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রায়োগিক দিক ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ডিজিটাল অর্থনীতিতে সাইবার সুরক্ষা, তথ্য সুরক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতি, ক্লাউড ফার্স্ট পলিসির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
একই অধিবেশনে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অগ্রগতিতে নীতিমালা ও প্রযুক্তির প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা সঞ্চলনা করেন সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের ট্রেজারি অ্যান্ড ট্রেড সলিউশনসের পরিচালক মোহাম্মদ এ আখের। সভায় তথ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশের করণীয় বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন মেটার বাংলাদেশ ও নেপালের পাবলিক পলিসির প্রধান রুজান সারওয়ার। তিনি বলেন, তথ্য সুরক্ষায় প্রয়োজন উপযুক্ত আইন ও নীতিমালা। পাশাপাশি উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা জরুরি। এ জন্য সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা খুবই প্রয়োজন। তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়া উদ্ভাবনের পথে এগোনো সম্ভব নয়।
‘বিনিয়োগে সাফল্যের গল্প’ শীর্ষক আলোচনায় গ্রামীণফোনের বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান। তিনি বলেন, এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দরকার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই গ্রামীণফোন আজ একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। এ সময় তিনি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করা বেশ চ্যালেঞ্জের। তবে চেষ্টা ও বিশ্বাস থাকলে সবকিছু সম্ভব।
গ্রামীণফোনের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা অট্টো ম্যাগনে রিসব্যাক বলেন, তথ্য সুরক্ষায় অর্থায়ন ও দক্ষতা-এই দুইয়ের গুরুত্ব এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে এ খাতের নীতিমালা প্রণয়ন শুরু করেছে, যা বেশ ইতিবাচক। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের বাস্তবতায় বাংলাদেশকে তথ্য সুরক্ষা খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।
অধিবেশনে আরও উপস্থিত ছিলেন সিটি এশিয়ার সাউথ পাবলিক সেক্টর সলিউশনসের প্রধান রোহিত জামওয়াল, অ্যান্ট ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সরকারবিষয়ক সম্পর্কের পরিচালক ইনফান ঝাং এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়।
উবারের এশিয়া–প্যাসিফিকের পাবলিক পলিসি ও সরকারি সম্পর্কবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক মাইক ওরগিল বলেন, বাংলাদেশের ডিজিটাল ও তথ্য-সম্পর্কিত নীতিমালা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তথ্য সুরক্ষা ছাড়া কার্যকর ডিজিটাল ইকোসিস্টেম সম্ভব নয়।
ডিজিটাল পেমেন্টের ভবিষ্যৎ ও ডিজিটাল অর্থনীতির উত্থান বিষয়ে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির বলেন, বিকাশের শুরুতে নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জের। প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মূলত মুনাফাকেন্দ্রিক। প্রতিটি গ্রাহকের চাহিদা বা সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা কাস্টমাইজ করার সুযোগ ছিল না। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সেই চিত্র এখন বদলাতে শুরু করেছে। গ্রাহকেরা এখন বিকাশের মাধ্যমে সঞ্চয়ও করছেন।
অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উত্তরণ ও এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক উলকাসেমাইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এনায়েতুর রহমান বলেন, ‘আমরা শুরু করেছিলাম চারজন প্রকৌশলী নিয়ে। আমাদের পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। তবে আজ উলকাসেমাই বিশ্বের শীর্ষ সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।’
বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এনায়েতুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে বের হচ্ছেন। এই বিপুলসংখ্যক কর্মীকে প্রশিক্ষিত করে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে কাজে লাগানো উচিত আমাদের।’
এ ছাড়া অধিবেশনটিতে গ্রিনকুয়েস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা মাসহুক রহমান, বন্ডস্টেইন টেকনোলজিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম, মেটলাইফ বাংলাদেশের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর সাদেক চৌধুরীসহ দেশি–বিদেশি অনেক উদ্যেক্তা উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ত ত ম ব দ ধ মত ত কর মকর ত প বল ক আম দ র ব যবস সরক র উপস থ
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫ দিনে হিলি বন্দরে ১ লাখ মেট্রিকটন চাল আমদানি
গত ৩৫ দিনে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে দুই হাজার ২৪টি ভারতীয় ট্রাকে করে এক লাখ চার হাজার ৮৫৯ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের চালের বাজারে। খুচরা বাজারে কেজি প্রতি চালের দাম কমেছে প্রকার ভেদে ৪ থেকে ৬ টাকা।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় হিলি বন্দর ঘুরে জানা যায়, দেশের অস্থির চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১২ আগস্ট থেকে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত ২ শতাংশ শুল্কে ভারত থেকে চাল আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতি টন চাল ৫২০ থেকে ৫৩০ ডলার, কিছু ক্ষেত্রে ৫৪০ ডলার মূল্যে আমদানি হচ্ছে। এসময় সবচেয়ে বেশি আসছে শম্পা কাটারি জাতের চাল।
হিলির খুচরা ব্যবসায়ী স্বপন পাল বলেন, “ভারত থেকে চাল আসায় বাজারের অস্থিরতা কমছে। প্রতিটি জাতের চাল কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা করে কমেছে। ৫৫ টাকা কেজি দরের মোটা চাল বিক্রি করছি ৫১ থেকে ৫২ টাকা, আবার ৭৪ টাকার শম্পা কাটারি চাল খুচরা বিক্রি করছি ৬৮ কেজি হিসেবে। আশা করছি আগামীতে আরো কমবে।”
আমদানিকারক নুর ইসলাম বলেন, “২ শতাংশ শুল্কে আমরা চাল আনছি। ৫২০-৫৪০ ডলার দরে আমদানি হচ্ছে। এতে বাজারে দামের প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়ছে।”
হিলি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, গত ১২ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ৩৫ দিনে ভারত থেকে ২৪২১টি ট্রাকে এক লাখ চার হাজার ৮৫৯ মেট্রিকটন চাল এসেছে। দেশের বাজারে চালের চাহিদা থাকায় দ্রুত খালাস প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হচ্ছে।
ঢাকা/মোসলেম/এস