দুই দশক আগে, রাশান বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী আলেক্সি ইউরচাক প্রথম ‘হাইপারনরমালাইজেশন’ (অতিস্বাভাবিকীকরণ) পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দুই দশকের উদ্ভট ও পরাবাস্তব পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

নাগরিকেরা ও সরকারি লোকেরা সবাই জানতেন যে সোভিয়েত ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে এবং সেটা আর বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। কিন্তু সবাই এমনভাবে চলতেন যেন কোথাও কোনো সমস্যা নেই।

বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়বে অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা গমের ওপর রাশিয়াকে নির্ভর করতে হবে—সেটা খুব কম লোকই তখন কল্পনা করতে পেরেছিলেন।

অতীতে ফিরে তাকালে, সোভিয়েত ব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়েছিল, সেটা চিহ্নিত করা আমাদের সবার জন্যই সহজ।

কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বোঝা কতটা সহজ। সম্প্রতি গাজায় ১৫ জন চিকিৎসাকর্মীকে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। একজন সেই ঘটনার মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করেন। ফলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে বর্ণনা দিয়েছে, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিশ্ব এ ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

আরও পড়ুনইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে০৮ এপ্রিল ২০২৫

যাহোক, এ ঘটনা ইসরায়েলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসরায়েলের জনগণের মধ্যে এ ঘটনা খতিয়ে দেখার কোনো আগ্রহ নেই। তাদের কোনো নৈতিক আত্মদর্শন নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম জিম্মিদের পরিবারের বেলায়। কিন্তু তারা শুধু তাদের প্রিয়জনদের কথায় বলছে। অথচ সেই মানুষগুলোর নামে গাজার ২০ লাখ মানুষের জীবনে যে প্রলয়ংকর দুর্দশা নেমে এসেছে, সেটা বেমালুম চেপে গেছে।

গাজায় চিকিৎসাকর্মীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা আমাদের কোনো কাল্পনিক সিনেমার গল্প বলেই মনে হয়। ইসরায়েলি সমাজ এমনভাবে চলছে যেন এসব ঘটনা ভিনগ্রহে ঘটছে।

ইসরায়েলি একজন রাজনীতিবিদও এ ঘটনার নিন্দা জানাননি অথবা প্রশ্ন তোলেননি। ইসরায়েলি সমাজ একটা জ্ঞানীয় অসংগতি দশায় বাস করছে। বাস্তবতা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।

গত বছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইসরায়েলি শাখা গাজায় গণহত্যা নিয়ে সংস্থাটির নিজস্ব প্রতিবেদন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অথচ গাজায় হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ৫০ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। সেখানে ব্যাপকভাবে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে।

ইসরায়েলে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, তখন নেতানিয়াহু আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মরিয়া। কয়েক দিন আগেই নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। সেই সফরে তিনি বারবার ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থে সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন।

সহিংসতার প্রতি ইসরায়েলি সমাজের গ্রহণযোগ্যতা অতিস্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

হাঙ্গেরি সফরের সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বুদাপেস্টের ইউনিভার্সিটি অব পাবলিক সার্ভিস সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। গণহত্যার স্থপতি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সমন জারি করা ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়ার জন্য স্পষ্টতই যোগ্য ব্যক্তি! আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এমন একটি ইনস্টিটিউটে দাঁড়িয়ে তিনি ‘ডিপ স্টেটের’ ক্ষমতা নিয়ে ইসরায়েলের আমলাতন্ত্রকে আক্রমণ করেন।

ডিপ স্টেট পরিভাষাটি ১৯৯০-এর দশকে তুরস্কে প্রথম চালু হয় বলে মনে করা হয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোর আড়ালে জেনারেল ও আমলাতন্ত্রের পদস্থ কর্মকর্তাদের গোপন নেটওয়ার্ক বোঝাতে এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। যাহোক, নেতানিয়াহু খুব ভালো করেই জানেন যে ইসরায়েলে ডিপ স্টেট বলে কিছু নেই। কারণ, এর প্রয়োজনই সেখানে নেই।

সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উচ্চ আদালত—ইসরায়েলের এই তিনটি মূল প্রতিষ্ঠানের কথা ধরা যাক। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে একটা ওলট–পালট চলছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ব্যর্থতার পর বিশালসংখ্যক কমান্ডার হয় পদত্যাগ করেছেন অথবা তাঁদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

পুলিশ বাহিনীতে উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভিরের প্রভাব খতিয়ে দেখছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত।

উচ্চ আদালতকে মাঝেমধ্যেই বামপন্থী ও উদারপন্থী এজেন্ডা প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যখন সামনে আছে, তখন উচ্চ আদালত কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা না করেই এর আইনি বৈধতা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বিতর্কিত জাতি-রাষ্ট্র আইনের কথা বলা যায়। এ আইন পাসের কারণে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের চেয়ে ইহুদি নাগরিকদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। এই আদালতই পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপনকারীদের ভূমি দখলের বৈধতা দিয়েছে।

ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তারা পেশাগতভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোজে দায়ান থেকে শুরু করে আইজ্যাক রবিন, অ্যারিয়েল শ্যারনসহ আরও অনেকে সামরিক বাহিনী থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন।

নেতানিয়াহু যখন আমলাতন্ত্রকে ধমক দিচ্ছেন, তখন আবার তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠছে।

ইসরায়েলে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, তখন নেতানিয়াহু আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মরিয়া। কয়েক দিন আগেই নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। সেই সফরে তিনি বারবার ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থে সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন।

বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় বিপজ্জনক হুমকি তৈরি হবে এই বিবেচনায় আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তীব্র বিরোধিতা করে এলেও নেতানিয়াহু গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার কথা বারবার বলে যাচ্ছেন।

ইসরায়েলে এখন যা কিছু ঘটছে, তার কোনোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উন্মাদনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না।

নেতানিয়াহুর বেপরোয়া আঞ্চলিক অভিযাত্রা শুধু মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করছে না, সেটা ইসরায়েলি সমাজকেও ভেতর থেকে ভেঙে ফেলছে।

আবেদ আবু শাহদেহ জাফার রাজনৈতিক কর্মী

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র র জন য এ ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ