ইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো
Published: 12th, April 2025 GMT
দুই দশক আগে, রাশান বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী আলেক্সি ইউরচাক প্রথম ‘হাইপারনরমালাইজেশন’ (অতিস্বাভাবিকীকরণ) পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দুই দশকের উদ্ভট ও পরাবাস্তব পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
নাগরিকেরা ও সরকারি লোকেরা সবাই জানতেন যে সোভিয়েত ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে এবং সেটা আর বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। কিন্তু সবাই এমনভাবে চলতেন যেন কোথাও কোনো সমস্যা নেই।
বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়বে অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা গমের ওপর রাশিয়াকে নির্ভর করতে হবে—সেটা খুব কম লোকই তখন কল্পনা করতে পেরেছিলেন।
অতীতে ফিরে তাকালে, সোভিয়েত ব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়েছিল, সেটা চিহ্নিত করা আমাদের সবার জন্যই সহজ।
কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বোঝা কতটা সহজ। সম্প্রতি গাজায় ১৫ জন চিকিৎসাকর্মীকে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। একজন সেই ঘটনার মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করেন। ফলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে বর্ণনা দিয়েছে, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিশ্ব এ ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
আরও পড়ুনইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে০৮ এপ্রিল ২০২৫যাহোক, এ ঘটনা ইসরায়েলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসরায়েলের জনগণের মধ্যে এ ঘটনা খতিয়ে দেখার কোনো আগ্রহ নেই। তাদের কোনো নৈতিক আত্মদর্শন নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম জিম্মিদের পরিবারের বেলায়। কিন্তু তারা শুধু তাদের প্রিয়জনদের কথায় বলছে। অথচ সেই মানুষগুলোর নামে গাজার ২০ লাখ মানুষের জীবনে যে প্রলয়ংকর দুর্দশা নেমে এসেছে, সেটা বেমালুম চেপে গেছে।
গাজায় চিকিৎসাকর্মীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা আমাদের কোনো কাল্পনিক সিনেমার গল্প বলেই মনে হয়। ইসরায়েলি সমাজ এমনভাবে চলছে যেন এসব ঘটনা ভিনগ্রহে ঘটছে।
ইসরায়েলি একজন রাজনীতিবিদও এ ঘটনার নিন্দা জানাননি অথবা প্রশ্ন তোলেননি। ইসরায়েলি সমাজ একটা জ্ঞানীয় অসংগতি দশায় বাস করছে। বাস্তবতা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।
গত বছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইসরায়েলি শাখা গাজায় গণহত্যা নিয়ে সংস্থাটির নিজস্ব প্রতিবেদন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অথচ গাজায় হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ৫০ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। সেখানে ব্যাপকভাবে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, তখন নেতানিয়াহু আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মরিয়া। কয়েক দিন আগেই নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। সেই সফরে তিনি বারবার ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থে সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন।সহিংসতার প্রতি ইসরায়েলি সমাজের গ্রহণযোগ্যতা অতিস্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
হাঙ্গেরি সফরের সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বুদাপেস্টের ইউনিভার্সিটি অব পাবলিক সার্ভিস সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। গণহত্যার স্থপতি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সমন জারি করা ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়ার জন্য স্পষ্টতই যোগ্য ব্যক্তি! আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এমন একটি ইনস্টিটিউটে দাঁড়িয়ে তিনি ‘ডিপ স্টেটের’ ক্ষমতা নিয়ে ইসরায়েলের আমলাতন্ত্রকে আক্রমণ করেন।
ডিপ স্টেট পরিভাষাটি ১৯৯০-এর দশকে তুরস্কে প্রথম চালু হয় বলে মনে করা হয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোর আড়ালে জেনারেল ও আমলাতন্ত্রের পদস্থ কর্মকর্তাদের গোপন নেটওয়ার্ক বোঝাতে এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। যাহোক, নেতানিয়াহু খুব ভালো করেই জানেন যে ইসরায়েলে ডিপ স্টেট বলে কিছু নেই। কারণ, এর প্রয়োজনই সেখানে নেই।
সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উচ্চ আদালত—ইসরায়েলের এই তিনটি মূল প্রতিষ্ঠানের কথা ধরা যাক। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে একটা ওলট–পালট চলছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ব্যর্থতার পর বিশালসংখ্যক কমান্ডার হয় পদত্যাগ করেছেন অথবা তাঁদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীতে উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভিরের প্রভাব খতিয়ে দেখছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত।
উচ্চ আদালতকে মাঝেমধ্যেই বামপন্থী ও উদারপন্থী এজেন্ডা প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যখন সামনে আছে, তখন উচ্চ আদালত কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা না করেই এর আইনি বৈধতা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বিতর্কিত জাতি-রাষ্ট্র আইনের কথা বলা যায়। এ আইন পাসের কারণে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের চেয়ে ইহুদি নাগরিকদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। এই আদালতই পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপনকারীদের ভূমি দখলের বৈধতা দিয়েছে।
ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তারা পেশাগতভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোজে দায়ান থেকে শুরু করে আইজ্যাক রবিন, অ্যারিয়েল শ্যারনসহ আরও অনেকে সামরিক বাহিনী থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন।
নেতানিয়াহু যখন আমলাতন্ত্রকে ধমক দিচ্ছেন, তখন আবার তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠছে।
ইসরায়েলে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, তখন নেতানিয়াহু আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মরিয়া। কয়েক দিন আগেই নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। সেই সফরে তিনি বারবার ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থে সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন।
বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় বিপজ্জনক হুমকি তৈরি হবে এই বিবেচনায় আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তীব্র বিরোধিতা করে এলেও নেতানিয়াহু গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার কথা বারবার বলে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলে এখন যা কিছু ঘটছে, তার কোনোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উন্মাদনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না।
নেতানিয়াহুর বেপরোয়া আঞ্চলিক অভিযাত্রা শুধু মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করছে না, সেটা ইসরায়েলি সমাজকেও ভেতর থেকে ভেঙে ফেলছে।
আবেদ আবু শাহদেহ জাফার রাজনৈতিক কর্মী
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র র জন য এ ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথমবার ঢাকায় জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটি
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের দুই সদস্য বাংলাদেশে এসেছেন। রোববার চার দিনের সফরে গ্রুপের ভাইস চেয়ার গ্রাজিনা বারানোস্কা ও আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ ঢাকা পৌঁছান।
প্রায় এক যুগ ধরে গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য বাংলাদেশ সফরের অনুরোধ জানিয়ে আসছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্স অর ইনভলেন্টারি ডিসাপিয়ারেন্স– ডব্লিউজিইআইডি। ২০১৩ সালের ১২ মার্চ সফরের জন্য প্রথম চিঠি দিলেও সাড়া দেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর পর একাধিকবার অনুরোধ করলেও রাখা হয়নি। ২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল শেষবার সফরের অনুমতি চেয়েছিল ডব্লিউজিইআইডি। কিন্তু দেয়নি তৎকালীন সরকার।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। এর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানালে সাড়া দেয়। এরই অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এলো গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। ১৮ জুন প্রতিনিধি দলের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়, সফরে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পররাষ্ট্র সচিব, গুম কমিশনের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করবে প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া নীতিবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেবেন দুই সদস্য।
ঢাকায় জাতিসংঘ কার্যালয়ের এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, প্রতিনিধি দল এবার গুমের ঘটনা তদন্ত করবে না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তার ভিত্তিতে সুপারিশ করবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়ে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে সই করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক ‘গুম প্রতিরোধ দিবস’-এর এক দিন আগে ৭৬তম দেশ হিসেবে চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গুমবিরোধী সনদ গৃহীত হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে যুক্ত হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে সনদে যুক্ত হওয়া নিয়ে বরাবর অনাগ্রহ দেখিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এ সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ তারা অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হিসেবে নিয়েছে। আর ভারত শুধু সই করেছে।
ডব্লিউজিইআইডির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনও ৭০টি গুমের ঘটনা অনিষ্পত্তি রয়েছে। জাতিসংঘ মোট ৮৮ ব্যক্তির গুমের বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়েছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজন আটক ও ১০ ব্যক্তি মুক্ত অবস্থায় আছেন।