৭ হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয় কমাবে যবিপ্রবির ন্যানো ইউরিয়া
Published: 29th, April 2025 GMT
দেশের কৃষি খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) একটি গবেষণা প্রকল্প। প্রচলিত ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব ও খরচ-সাশ্রয়ী ‘ন্যানো ইউরিয়া’, যা ব্যবহার করলে ইউরিয়া সারের খরচ ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
এ প্রযুক্তি শুধু কৃষিকেই নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকে আরো টেকসই করার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন এ ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবন করেছেন যবিপ্রবির কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ল্যাবরেটরি অব ন্যানো বায়ো অ্যান্ড অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (নেম ল্যাব) প্রধান গবেষক ড.
আরো পড়ুন:
ডিএপি সার ও ফসফরিক কিনতে ব্যয় ৩০৭ কোটি টাকা
উৎপাদনে ফিরল আশুগঞ্জ সার কারখানা
ন্যানো ইউরিয়া সরাসরি গাছের পাতায় স্প্রে করে প্রয়োগ করা হয়। এ সারের কণাগুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে, গাছ তা দ্রুত শোষণ করতে পারে। ফলে অপচয় ও কম হয় এবং মাটির গুণগত মানেও কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না।
ড. জাভেদ হোসেন খান বলেন, “এই ন্যানো ইউরিয়া প্রচলিত ইউরিয়ার চেয়ে ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত খরচ সাশ্রয়ী হবে। এক বিঘা জমিতে যেখানে প্রচলিত ইউরিয়া সারের জন্য প্রায় ৪ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়, সেখানে এই ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে খরচ হবে মাত্র ২৩০ টাকা।”
এ প্রযুক্তির মাঠপর্যায়ের কার্যকারিতা এরই মধ্যে বগুড়ার শেরপুর, যশোরের আব্দুলপুর ও ঢাকার গাজীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে। কৃষকদের দাবি, চাষাবাদে এ ন্যানো ইউরিয়া প্রয়োগের ফলে প্রচলিত ইউরিয়ার চেয়ে বিঘাপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া খরচ কমেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ।
ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল যবিপ্রবির ল্যাবরেটরি অব ন্যানো বায়ো অ্যান্ড অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোলাবায়ো এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কোলাবায়োর পক্ষে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ফ্রেডেরিক কেন্ডিরগি এবং যবিপ্রবির পক্ষে ড. জাভেদ হোসেন খান।
এ চুক্তির আওতায় কোলাবায়ো যবিপ্রবির উদ্ভাবিত প্রযুক্তি গ্রহণ করবে এবং নিজেদের জৈব সারবিষয়ক প্রযুক্তিও নেম ল্যাবেরর সঙ্গে বিনিময় করবে। আগামী ৫ বছর এই দুই প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে গবেষণা ও উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহৃত হয়, যার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি নির্ভর। শুধু ২০২৪ অর্থবছরেই ইউরিয়া আমদানিতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ন্যানো ইউরিয়া ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে এই খাতের ব্যয় ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবও অনেকাংশেই কমবে। অতিরিক্ত সার জমিতে না পড়ার ফলে জমির দূষণও রোধ হবে।
গবেষক ড. জাভেদ হোসেন খান জাপানের ওয়াসিদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তার ১৩০টিরও বেশি গবেষণাপত্র ও ছয়টি পেটেন্ট রয়েছে। এছাড়া গবেষণার সম্মাননাস্বরূপ ২০২২ সালে তিনি জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
ঢাকা/ইমদাদুল/মেহেদী
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’