২০২৭ সালের জুনের পর ‘করছাড়’ থাকবে না
Published: 29th, April 2025 GMT
২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে শুল্ক-কর সংক্রান্ত সব ধরনের কর অব্যাহতি যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কর অব্যাহতি তুলে দেওয়ার ‘উচ্চ’ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি এনবিআর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল নামে ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেখানে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রতি অর্থবছরে এনবিআরকে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো করছাড় দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এই করছাড় না দিলে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে আরও বেশি খরচ করতে পারত। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর আইন অনুসারে কিছু ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি থাকবে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া কর অব্যাহতি থাকবে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ের অন্যতম শর্ত হলো করছাড় কমিয়ে আনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে।
এনবিআরের ওই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সিংহভাগ করছাড় পান সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি ও সুবিধাপ্রাপ্ত শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। এতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লোকসান হচ্ছে। করের ভার সমাজের সব শ্রেণির ওপর যৌক্তিকভাবে পড়ছে না। এসব কারণে করছাড় যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে এনবিআর।
যা করা হবে
কর অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে আগামী দুই বছরে পাঁচ ধরনের কার্যক্রম নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এনবিআরের ওই পরিকল্পনায়। এক.
এনবিআরের করনীতি, ভ্যাটনীতি ও কাস্টমস নীতি—এই তিন বিভাগ এসব কাজ করবে। ২০২৭ সালের প্রথমার্ধেই এসব কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা আছে।
কোন খাতে কত ছাড়
এনবিআর ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে তিনটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়—আয়কর, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মিলিয়ে এক অর্থবছরে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪১০ কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি করছাড় দেওয়া হয় ভ্যাট খাতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। ওই অর্থবছরে এই খাতে এনবিআর আদায় করেছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ সেবার যত ভ্যাট আদায় হয়েছে, তার প্রায় ৮২ শতাংশের মতো ছাড় দেওয়া হয়েছে। ছাড় না দিলে ভ্যাট খাতে এই অর্থবছরে আদায় হতো ২ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। মূলত অব্যাহতি কিংবা শুল্ক-করের হার কমিয়ে ব্যবসায়ীদের এ ধরনের ছাড় দেওয়া হয়।
আয়কর খাতে আদায়ের চেয়ে ছাড়ের পরিমাণ বেশি। এনবিআরের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। ওই বছর আয়কর আদায় হয়েছিল ৮৭ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ যত আয়কর আদায় হয়েছিল, তার চেয়েও প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে। মূলত কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে এবং উৎসে করকে চূড়ান্ত কর দায় দিয়ে বিভিন্ন খাতকে আয়কর ছাড় দেওয়া হয়।
এনবিআরের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক বাবদ ৩৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা আদায় হয়।
গত পাঁচ দশকে ২০০-এর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন খাতকে করছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব করছাড় তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা বানাতে এনবিআরের একটি দল কাজ করছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৭ স ল র এসব ক করছ ড়
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।