ঈদ উৎসবকে বর্ণিল করে তুলতে একের পর এক সৃষ্টি নিয়ে মেতে উঠেছেন গানের ভুবনের বাসিন্দারা। কণ্ঠশিল্পী, গীতিকবি, সুরকার, সংগীত আয়োজক, মিউজিক ভিডিও নির্মাতা, প্রযোজক, প্রকাশক সবার লক্ষ্য একটাই– নতুন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দর্শক-শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ।
ঈদ ঘিরে তৈরি করা বেশকিছু গান এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বাকি সব আয়োজন প্রকাশ পাবে উৎসব উদযাপন পর্ব শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে। যেখানে থাকছেন তরুণ থেকে শুরু করে তারকা শিল্পী ও সংগীত আয়োজকরা। কয়েক বছরের পরিক্রমায় যা চোখে পড়েছে তা হলো, ভিন্ন স্বাদের আয়োজনের মধ্য দিয়ে সময়কে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। যা অডিও-ভিডিও ছাড়াও নাটক, সিনেমার গানে বৈচিত্র্য যোগ করে চলেছে। এবারের ঈদ আয়োজনেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা করেছেন সংগীতবোদ্ধারা। এবার একনজরে দেখা নেওয়া যাক, কী থাকছে এবারের উৎসবের সুরেলা আয়োজনে।
কয়েক বছর ধরে সিনেমার গানে নতুনত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। এবারের ঈদের সিনেমাগুলোতে এর ব্যতিক্রম হয়নি। সদ্য প্রকাশিত ‘তাণ্ডব’ সিনেমার ‘লিচুর বাগানে’ গানটি রীতিমতো আলোড়ন তুলতে শুরু করেছে। এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গানের নতুন সংস্কার। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রীতম হাসান, জেফার রহমান, মঙ্গল মিয়া ও আলেয়া বেগম। ‘লিচুর বাগানে’-এর পাশাপাশি ইমরান মাহমুদুল ও আতিয়া আনিসার গাওয়া ‘টগর’ সিনেমার ‘ও সুন্দরী’ গানটিও শ্রোতার মনোযোগ কাড়তে শুরু করেছে। একই সিনেমায় কামরুজ্জামান রাব্বি ও কর্ণিয়ার গাওয়া ‘১০০% দেশি’ গানটিও সংগীতপ্রেমীর মাঝে সাড়া ফেলেছে। ঈদে ইমরান ও কোনালের গাওয়া ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ সিনেমার ‘তোমাকে চাই’ গানটি নিয়েও অনেকের কৌতূহল লক্ষ্য করা গেছে। বহুদিন পর পপতারকা মিলাকেও পাওয়া গেছে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে। ‘ইনসাফ’ সিনেমায় এই শিল্পী নতুন করে গেয়েছেন নব্বই দশকে ‘কুলি’ সিনেমার আলোড়ন তোলা গান ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’। যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘আকাশেতে লক্ষ তারা ২.
গানে মিলার সহশিল্পী ব্ল্যাক জাং। সংগীত আয়োজন করেছেন শওকত আলী ইমন। ‘নীলচক্র’ সিনেমায় গাওয়া র্যাপার জালালী শাফায়েতের ‘এই অন্ধকারের শহরে’ গানটি নিয়ে চলছে আলোচনা। শিল্পী শাফায়াতের লেখা এই গানের সংগীত আয়োজন করেছেন শিল্পী ও সংগীত আয়োজক বালাম। ‘উৎসব’ সিনেমায় লেভেল ফাইভ ব্যান্ডের সংগীত আয়োজনে শিল্পী আইদিদ রশিদের গাওয়া ‘তুমি’ অনেকের প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নেওয়া শুরু করেছে। এর বাইরেও ঈদ সিনেমার আরও কিছু গান দু-এক দিনের মধ্যে প্রকাশ পাবে।
এদিকে নাটক, ওয়েব সিরিজ ও সিনেমার গান নিয়ে শ্রোতার মাঝে তৈরি হয়েছে বাড়তি আগ্রহ। যে কারণে বেশির ভাগ নাটক, ওয়েব সিরিজ ও সিনেমায় যোগ করা হয়েছে ভিন্ন ধাঁচের কিছু গান। সে তালিকায় আছে ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’, ‘আতা লতা’সহ আর বেশকিছু নাটক ও ওয়েব সিরিজ এবং সিনেমার গান।
অডিও-ভিডিও আকারে প্রকাশিত বিভিন্ন শিল্পীর একক ও দ্বৈত গানের আয়োজনের কমতি দেখা যায়নি এবারের ঈদ আয়োজনে। নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি উৎসবকে রাঙিয়ে দিতে প্রকাশ করেছেন একক গান ‘কথা দিয়ে’। তরুণ মুন্সির কথা ও সুরের এই গানটির সংগীত আয়োজন করেছেন সেতু চৌধুরী। শিল্পী কর্ণিয়া প্রকাশ করেছেন ভিন্ন ধাঁচের গান ‘জামদানি শাড়ি’। এর কথা লেখার পাশাপাশি সুর করছেন তানভীর আহমেদ। একই সঙ্গে গানের একটি অংশ সহশিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া কর্ণিয়ার দ্বৈত গান ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’ অনেকের মনে ছাপ ফেলতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে প্রকাশ পাওয়া শিল্পী বাঁধন সরকার পূজার একক গান ‘ভালোবাসি তারে’, আর্বোভাইরাস ব্যান্ডের ‘ক্রোধ’ গানগুলো উৎসব আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। এদিকে, একক গানের জোয়ারেও কিছু শিল্পী ও ব্যান্ডের সদস্যরা অ্যালবাম প্রকাশনার ধারা বজায় রেখে চলেছেন। যার সুবাদে নেমেসিস ব্যান্ডের চতুর্থ অ্যালবাম ‘ভিআইপি’, চিরকুট ব্যান্ডের চতুর্থ অ্যালবাম ‘ভালোবাসা সমগ্র’, শিল্পী মিফতা জামানের তৃতীয় অ্যালবাম ‘এক পশলা বৃষ্টি’-এর গানগুলো ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। সদ্য অনুষ্ঠিত ‘নজরুল কনসার্ট’-এ পরিবেশিত জাতীয় কবির কালজয়ী ১০টি গান বিভিন্ন ব্যান্ডের পরিবেশনায় অ্যালবাম আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। কাজী নজরুলের ইসলামের কালজয়ী গান থেকে নির্বাচিত ১০টি গানের মধ্যে সোলস পরিবেশন করেছে ‘শিকল পরার ছল’, ওয়ারফেজ ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’, দলছুট ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, শিরোনামহীন ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’, মিজান এন ব্রাদার্স ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’, রেবেল ‘বাজিছে দামামা’ গানগুলো। এ ছাড়াও আর্ক, ডিফারেন্ট টাচ, ব্ল্যাক ও এফ মাইনরের পরিবেশনায় থাকছে ‘পরদেশী মেঘ’ ‘জয় হোক জয় হোক’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গানগুলো।
ঈদের একক ও দ্বৈত তালিকায় আছে শিল্পী কিশোর দাস ও লিজার দ্বৈত গান ‘ও প্রিয় ভালোবাসা নিও’, অবসকিওর ব্যান্ডের টিপু ও দূর্বাদল বিশ্বাসের ‘শান্তি নিকেতন’, ইমরান ও কনার ‘এমন একটা দিন আসে নাই’, শুভ ও তাসরিফের ‘পাহাড়ে যাব’, মাহতিম সাকিব ও তারান্নুম আফরিনের ‘তোমার টানে’। বিপ্লবের ‘চেনা অচেনা সুখ’, নাফিস কামালের একক ‘পাখিরে’, লুৎফর হাসানের ‘সন্ধ্যা নেমে আসুক’, সংগীতার কাভার করার শাহনাজ রহমতুল্লাহর কালজয়ী গান ‘পারি না ভুলে যেতে’, রূপঙ্কর বাগচীর ‘কেমন আছো তুমি’, এস এম শরতের ‘শাজাহান গইড়া ছিল মমতাজ মহল’, সালমার ‘কালা পাখি’, অবন্তি সিঁথির ‘সুখের মুহূর্ত’, পারভীন লিসার ‘দুঃখ বন্দনা’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘কিছু মন দেওয়া নেওয়াতে’, নিশাত আর রহমান যোনেক্সের ‘হয়তো’সহ আরও বেশকিছু গান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রক শ প পর ব শ কর ছ ন র একক
এছাড়াও পড়ুন:
উৎসবের যত রং
আমার কৈশোর কেটেছে সিলেটে। শহরটা ছিল নিরিবিলি, ছিমছাম সুন্দর। মানুষগুলোও। এ শুধু বয়ঃপ্রাপ্তির আগের নিষ্পাপ চোখের দেখা না, সমাজ ইতিহাসের পাতাতেও লেখা। আমার স্কুলে যাওয়ার পথে মন্দির পড়ত, একটা ছবির মতো গির্জাও। যে যার মতো ধর্ম পালন করত। কোনো হুজ্জত-হাঙ্গামা হতো না। সেসব উৎসবে চাকচিক্য ছিল না, আধিক্য অথবা দেখানোর মহড়া ছিল না। আনন্দটাই প্রধান ছিল। নির্মল আনন্দ।
দুই ঈদে আমরা উৎসব করতাম। ঈদুল আজহাকে বলা হতো ‘বকরা’ অথবা ‘বকরি’ ঈদ। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা সেই সময় এমন ছিল না যে ঘরে ঘরে পশু জবাই হবে। অনেক সময় তাই ‘ভাগে’ গরু কেনা হতো। আজকের গল্পটা সেই রকম ‘ভাগে’ কেনা গরু হারিয়ে যাওয়ার, যথাসময়ে খুঁজে না পাওয়ার এবং সেই অপ্রাপ্তির সঙ্গে একজনের সুবর্ণ এক প্রাপ্তির। ভাগের সঙ্গে ভাগ্যের এই রকম সংযোগ আর ঘটেছে কিনা, আমার জানা নেই।
আমার এক বন্ধুর বাবা একটা গরু কেনার সাধের সঙ্গে সাধ্যের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে দেরি করে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত সাধ-কে পরের বছর পর্যন্ত মুলতবি রেখে ভাগে কিনতে গিয়ে দেখলেন, পাড়ায় তাঁর জন্য কেউ বসে নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি শহরের আরেক পাড়ায় এক পরিচিতজনের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করলেন। তাতে তিনি স্বস্তি পেলেও অস্বস্তিতে পড়ল আমার বন্ধু। কারণ কোরবানির সকাল-দুপুর তাকে কাটাতে হবে ওই পাড়ায়, যে পাড়ার ক্রিকেট টিমকে আমরা শুধু আমাদের পাড়াতে নয়, তাদের পাড়াতেও, হোমগ্রাউন্ডেই হারিয়েছি। এই শেষ পরাজয়টা অপমানেরও অধিক। ফলে আমার বন্ধু ওই পাড়ায় অবাঞ্ছিত। এবার যদি তাকে একা পেয়ে পরাজয়ের শোধ মেটায়?
আমার বন্ধু, তার বাবার মতোই, আরেক দোটানায় পড়ল। তাকে উদ্ধার করলেন আমাদের প্রতিবেশী পাড়ার ফুটবল নায়ক মুরাদ ভাই। মুরাদ নামটা, এই উপমহাদেশের অনেক ফিল্মি নায়কের নামের মতো, নকল। আসল নামটা তাঁর ঊহ্য থাকল, প্রাইভেসি প্রটেকশনের বিধান অনুযায়ী, যদিও গল্পের ঘটনাটা দুই পাড়াতে ঊহ্য থাকেনি। আমার বন্ধুকে তিনি জানালেন, তার বাবাকে তিনিই ওই পাড়ায় ভাগে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিজেও ভাগে আছেন। তার বাবা কিছুদিন ধরে শয্যাশায়ী। অসুস্থ। পরিবারের সামর্থ্যে টান পড়েছে। ঈদের দিন কোরবানিতে তিনিও থাকবেন।
আমার বন্ধুর দোটানা-পর্ব শেষ হলো। এই দোটানায় থাকাটা সেই সময়ে মানুষের বেশ পছন্দের ছিল। তাতে বেশ একটা দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ মিলত। সময়টা ছিল দর্শনের, প্রদর্শনের নয়। যাক সে কথা।
মুরাদ ভাইকে ভাগে পেয়ে আমার বন্ধু হাতে চাঁদ পেল। পাওয়ারই কথা। তাঁর অল-সিলেট ফেইম তাকে কোনো পাড়াবন্দি করেনি। তদুপরি তিনি সুদর্শন মানুষ, চোখে রোদচশমা পরেন, কায়দা করে ক্যাপস্টান সিগারেট খান, রমরমা এক ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজারি করেন। তাঁর সঙ্গে ওই পাড়ায় আমার বন্ধু নিরাপদ।
ঈদের দিন নামাজ শেষে মুরাদ ভাইয়ের চকচকে র্যালি সাইকেলের পেছনে বসে আনন্দভরা মন নিয়ে আমার বন্ধু চলল ওই পাড়ায়। পাড়ায় পৌঁছে তার সব আনন্দ উবে গেল, অথবা ডুবে গেল।
কেন? না, কোরবানির গরুটা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে, সবাই যখন ঈদগাহতে কোলাকুলি করছেন।
গরু পালালে বুদ্ধি বাড়ে না, কষ্ট বাড়ে। যে লোকের জিম্মায় গরুটা ছিল, সেও গিয়েছিল নামাজে। সেজন্য কেউ তাকে জবাবদিহি করার কথা ভাবল না, বকাঝকাও দিল না, শুধু দুঃখ প্রকাশ করে মুরব্বিরা বললেন, ‘ইতা কিতা অইল বা! অখন যাও। তুকাও।’ তুকাও অর্থাৎ তালাশ করো। ফলে সবাই মিলে গরু-খোঁজায় নামা হলো। মুরাদ ভাই দেখলেন, তালাশকারীদের মনোযোগ রাস্তায়, মাঠে, বাড়িঘরের সামনের আঙিনায়। কিন্তু তিনি তো ফরওয়ার্ডে খেলেন না, পেছনটা সামলান, দলের পেছনের স্তম্ভ, ব্যাক পজিশনে খেলেন, যাকে সিলেটে বলা হতো ‘বেকি’। তিনি ভাবলেন, তাঁর মনোযোগ থাকবে দৃশ্যের পেছনে। তাঁর ধারণা হলো, গরুটা পেছনলভ্য তাজা ঘাস আর কচি পাতার সন্ধানে থাকবে। এ বাসা-ও বাসার কোনাকাঞ্চিতে, যতটা সম্ভব পেছনে, তিনি উঁকি দিলেন। হঠাৎ একটা বাড়ির পেছন থেকে একটা গম্ভীর হাম্বা ধ্বনি শুনে উল্লসিত মনে নিজেকে বললেন, ইউরেকা! পাওয়া গেছে। গরুটা বলছে, আমি এখানে।
দ্রুত পা চালিয়ে তিনি গরুর কাছে গেলেন।
গরুটা একটা গাছের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সামনে একটা টুকরি, কিছু ঘাস টুকরিতে দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আহারে তৃপ্ত গরুটা তার হাম্বারবে সন্তোষ প্রকাশ করছে।
মুরাদ ভাই কী করবেন, ভেবে নিতে একটু সময় নিলেন। কিন্তু এক নারীকণ্ঠের চিৎকার তাতে যবনিকা টানল। চিৎকারটা প্রথমে আর্ত, তারপর ভয়ার্ত, তারপর বিস্মিত। শেষে একটা প্রশ্ন, কে আপনি?
নারীকণ্ঠে এমন অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন শুনে মুরাদ ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন, নিশ্চয় বহুদিন পর। আপনি কে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
নিজের বাড়িতে ঢুকে একটা অপরিচিত, উটকো লোক– গরুচোরও হতে পারে– এ রকম প্রশ্ন তাঁকে করতে পারে তা ভেবে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার কথা সেই নারীর। যুদ্ধ লাগাবেন কি, যুদ্ধের একটা আয়োজন তৈরির দিকেও তিনি গেলেন না যখন তাঁর চোখ পড়ল মুরাদ ভাইয়ের ওপর, সেই বিস্মিত পর্যায়ের শুরুতে। মুরাদ ভাইয়ের ঈদের পাঞ্জাবিটা দারুণ, তাঁর চুলের অবিন্যস্ত বিন্যাসটাও অটুট। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াজনিত কিছু গোলাপি রং তাঁর ফর্সা গালে। তার ওপর তাঁর চোখে লন্ডন থেকে আনানো চকচকে রে-ব্যান রোদচশমা। যুদ্ধের আয়োজনের দিকে না যাওয়ার একটা বড় কারণ: দিনটা ঈদের।
নারীর গলা নামল, কোমল হলো। তিনি বললেন, গরুটাকে তিনি খুব আদর করেন। গরুর নাম নিম্মি। নিম্মির দিকে তিনি যেন দয়া করে হাত না বাড়ান।
মুরাদ ভাই জিব কেটে বললেন, এসব কী বলেন। আমি এসেছি আমাদের কোরবানির হারানো গরুর খোঁজে।
জিব কাটার কারণ: নারীর মুখে তাঁর চোখ পড়েছে। অপূর্ব সেই মুখটা দেখে হাছন রাজার একটা গান এলোমেলো তাঁর মনে বাজল– রূপ দেখিলাম রে নয়নে!
সিলেটের ওই সময়ের সমাজে এই যে মুরাদ ভাই এবং নারী– নারী মানে কলেজপড়ুয়া অথবা পাস করা ছাত্রী– কিছুক্ষণ কথা বললেন, তা ওই কয়েকটা ক্ষণই বটে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো দুই মিনিট। এই দুই মিনিটের শেষে পাগলা ঘণ্টার মতো পুরুষদের পদধ্বনি শোনা গেল। নারী/ছাত্রী পালালেন অকুস্থল থেকে। ততক্ষণে মুরাদ ভাই বুঝে ফেলেছেন, যত কড়া ডিফেন্ডারই তিনি হোন না কেন, তাঁকে ফাঁকি দিয়ে ওই নারী/ছাত্রী একটা গোল করে বসেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার পুরুষদের ভালো ট্যাকল দিতে হবে। তিনি তাদের সামনাসামনি হলেন। পুরুষরা কঠিন কিছু বলবেন কি, তাঁর মতো সেলিব্রেটিকে বাড়িতে পেয়ে– বাড়ির যে ভূগোলেই তাঁর অবস্থান হোক না কেন– বিগলিত হয়ে গেলেন। তার ওপর আবার ঈদের দিনে! আদর আপ্যায়ন হলো। গরু খোঁজায় তাদের কাজের একটি ছেলেকেও পাঠানো হলো। মুরাদ ভাই সব ভুলে উদার আনন্দে সেই আপ্যায়ন গ্রহণ করলেন, কিন্তু সারাক্ষণ তিনি উন্মুখ হয়ে রইলেন সেই নারী/ছাত্রীকে দর্শন, নিদেনপক্ষে শ্রবণের জন্য।
সেই নারী/ছাত্রী দুইটি শোকে কাতর হলেন– এক. কেন তিনি নিম্মিকে মুরাদ ভাইয়ের হাতে তুলে দেননি; দুই. কেন তাঁর ওপর মুরাদ ভাইয়ের চোখ পড়ার আগে তিনি ঈদের সাজে সাজেননি।
মুরাদ ভাই যখন ভাগের আয়োজকের বাড়ি ফিরলেন, কতগুলো উৎকণ্ঠিত মুখের ভিড়ে আমার বন্ধুর করুণ মুখটি দেখে বুঝলেন, কতটা সময় তিনি ওই বাড়িতে কাটিয়েছেন। তাঁর অপরাধবোধ প্রবল হলো যখন তিনি শুনলেন, গরুটাকে পাওয়া যায়নি।
গল্পটা শেষ করতে হয়।
গরুটা পাওয়া গিয়েছিল, একটা বাড়ির পেছনে জংলা মতো জায়গায়, বুনো ঘাসের সাম্রাজ্যে। ভাগ্য ভালো কোরবানি দেওয়া যায় পরের দিনও। কাজেই আমার বন্ধুকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে তিনি গেলেন ওই পাড়ায়। অবশ্য আরও একদিন বন্ধুকে নিয়ে তিনি ওই পাড়ায় গেলেন, একটা হিলম্যান মিনক্স গাড়ির পেছনে তাকে গাদাগাদি বসিয়ে, বৈরাতির দলে। তিনি ছিলেন বরের সাজে।
তাঁর বিয়ের শামিয়ানা টানানো হয়েছিল ওই বাড়ির সামনের আঙিনায়। নিম্মি ছিল যথারীতি বাড়ির পেছনে। তার মালকিন যে তাকে মুরাদ ভাইয়ের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেকেই দিয়েছেন, এ কথা ভেবে সে পরম সুখে জাবর কাটছিল।