লাল মাংস আমাদের অনেকের প্রিয় খাবারের তালিকায় শীর্ষে। লাল মাংস বলতে আমরা খেয়ে থাকি গরু, খাসি, ভেড়া কিংবা মহিষের মাংস।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রান্নায় বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে এসব লাল মাংস। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে লাল মাংস তো খেতেই হবে। সারা বছরের তুলনায় এ সময় বরং লাল মাংস খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।

পশু কোরবানির কারণে প্রায় প্রতিটি ঘরে মাংস রান্না হয় এবং অনেকেই একসঙ্গে অনেক পরিমাণে লাল মাংস গ্রহণ করে থাকেন।

অনেকে আবার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে লাল মাংস খেতে ভয় পান বা বেশি খাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে থাকেন।

প্রশ্ন হলো লাল মাংস কি আসলেই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়? নাকি এটি কেবল অপব্যবহার ও অতিরিক্ত গ্রহণের ফল? আসুন, বিজ্ঞানের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি।

লাল মাংস প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস। এতে রয়েছে আয়রন (বিশেষ করে হিম আয়রন), জিংক, ভিটামিন বি-১২ ও অন্যান্য বি-ভিটামিন।

হিম আয়রন শরীরে সহজে শোষিত হয় এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া প্রোটিন আমাদের পেশি গঠনে সহায়তা করে এবং শরীরের বিভিন্ন কার্যাবলি সুষ্ঠু রাখতে অপরিহার্য।

তবে সমস্যা কোথায়? বিপত্তি শুরু হয় অতিরিক্ত বা নিয়মিত ভাজাভুজি, বারবিকিউ অথবা প্রক্রিয়াজাত লাল মাংস খাওয়া থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাত লাল মাংস, যেমন সসেজ, সালামি, হটডগ ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়া কোলন ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশেষ করে যখন মাংস উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা হয় (যেমন: গ্রিল, বারবিকিউ বা তেলে ভাজা), তখন এতে হেটারোসাইক্লিক অ্যামাইন এবং পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন নামে দুটি ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হয়। এই যৌগগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসার সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত।

লাল মাংসে সাধারণত উচ্চমাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। এটি শরীরে এলডিএল বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’-এর মাত্রা বাড়ায়, যা হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যাঁরা নিয়মিতভাবে লাল মাংস খান, তাঁদের মধ্যে হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি।

সব লাল মাংস কিন্তু সমান নয়। প্রক্রিয়াজাত মাংসে যেমন সসেজ, বেকন, হটডগ ইত্যাদিতে প্রিজারভেটিভ, অতিরিক্ত লবণ ও রাসায়নিক উপাদান যোগ করা হয়, যা ক্যানসার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে তাজা ও স্বাস্থ্যকরভাবে রান্না করা মাংস তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ।

লাল মাংস আমাদের শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির উৎস—যেখানে রয়েছে প্রোটিন, আয়রনসহ অনেক উপকারী উপাদান। তবে এই উপকারী খাবারটি যদি অতিরিক্ত বা ভুল উপায়ে খাওয়া হয়, তাহলে তা পরিণত হতে পারে এক নীরব ঘাতকে—বাড়িয়ে দিতে পারে হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ক্যানসারের ঝুঁকি।

তবে কি লাল মাংস একেবারে বাদ? না, একেবারে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরিমিত এবং সঠিকভাবে গ্রহণ করাই শ্রেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, সপ্তাহে ৩-৪ বার ৭০-১০০ গ্রাম লাল মাংস খাওয়া নিরাপদ। তা–ও হতে হবে কম চর্বিযুক্ত ও স্বাস্থ্যকরভাবে রান্না করা।

বাংলাদেশে মাংস খাওয়ার প্রবণতা ঈদ কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য আনতে হবে। প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, পরিমিত চর্বি ও লবণ কমানো খাদ্যাভ্যাস দীর্ঘ মেয়াদে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে পারে।

লাল মাংস আমাদের শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির উৎস—যেখানে রয়েছে প্রোটিন, আয়রনসহ অনেক উপকারী উপাদান।

তবে এই উপকারী খাবারটি যদি অতিরিক্ত বা ভুল উপায়ে খাওয়া হয়, তাহলে তা পরিণত হতে পারে এক নীরব ঘাতকে—বাড়িয়ে দিতে পারে হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ক্যানসারের ঝুঁকি। তাই আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা।

কোরবানির সময় লাল মাংস পুরোপুরি বাদ না দিয়ে; বরং পরিমিত পরিমাণে এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না করে খাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

কোমল, রসালো, চর্বিহীন ও নিরাপদভাবে প্রস্তুত মাংস শরীরের পুষ্টিচাহিদা পূরণে যেমন সহায়ক, তেমনি সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবনের পথেও এগিয়ে রাখে। তাই এবারের কোরবানিতে হোক অঙ্গীকার—পরিমিতি, সচেতনতা আর পুষ্টির মধ্য দিয়ে গড়ে তুলি স্বাস্থ্যকর জীবন।

ড.

এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স) এবং পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র পর ম ত ক রব ন উপক র

এছাড়াও পড়ুন:

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন

চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।

লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্‌যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।

চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।

লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।

প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।

লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’

তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্‌যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?

সম্পর্কিত নিবন্ধ