প্রচুর উৎপাদন, ভালো দাম। তবু ঘাম ঝরানো ফসল হাতে নিয়ে হতাশ কৃষক। সরকার নির্ধারিত মূল্যে গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না তারা। মুনাফা গিলছেন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, মিলার ও কিছু সরকারি কর্মকর্তা। কৃষকের নামে কার্ড; কিন্তু সরকারি গুদামে ধান দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা ও মিল মালিক। কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে বাড়তি লাভ নিচ্ছে ফড়িয়া সিন্ডিকেট। এভাবেই প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারের দেওয়া সুযোগ থেকে। 

চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ৩৬ এবং চালের মূল্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৪৪০ টাকা, যা বাজারমূল্যের চেয়ে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতি বছরই কৃষক পর্যায় থেকে সরকারিভাবে ধান কেনার খবর ছড়িয়ে দিতে চেষ্টার কমতি থাকে না খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের। তবে বাড়তি দাম কৃষকের মধ্যে আশা জাগালেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে শুরু করে শেরপুর, ফেনী, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষকের পরিবর্তে দালাল ও মিলাররা সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছে।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শ্রীরামকাঠি খাদ্যগুদামে চলতি বোরো মৌসুমে ৯৬৫ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বিএনপি নেতারা সরবরাহ করেছেন ৬০০ টন, জামায়াত নেতারা ৩০০ টন। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬৫ টন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কার্ডধারী কোনো কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন পর্যন্ত ধান সংগ্রহের কথা। কিন্তু বাস্তবে কৃষকের কার্ড ও পরিচয় ব্যবহার করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা ধান সরবরাহ করে বিল উঠিয়ে নিচ্ছেন। তারা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ টাকায় কিনে সরকারি গুদাম থেকে ১ হাজার ৪৪০ টাকা বিল তুলছেন। 

কৃষকদের অভিযোগ, যারা ভালো মানের শুকনো ধান নিয়ে গুদামে যান, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নেতাদের সরবরাহ করা ভেজা, পচা ধানও গ্রহণ করে গুদাম। এতে প্রকৃত কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে না পেরে বাজারে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় আদিবাসী ও দরিদ্র কৃষকদের নামে ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে সরকারি ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ‘সাথী চালকল’ নামে একটি ক্ষুদ্র মিলের মাধ্যমে সরকারকে ৪৬ টন চাল সরবরাহ করেছেন। অথচ তাঁর মিলের উৎপাদন ক্ষমতা এত নয়। বিষয়টি স্বীকার করে আতাউর বলেন, ‘আমি বাইরে থেকে ধান কিনে স্থানীয় কৃষকের নামে গুদামে দিই। বিনিময়ে তাদের ৫০০ টাকা করে দিই।’ আদিবাসী অনুকূল সরদার বলেন, ‘আমাদের এলাকার ৩০-৪০ জনকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে চেক বইয়ের পাতায় আগেভাগেই সই করিয়ে নিয়েছে। এর পর এই নামেই চাল সরবরাহ করা হয়েছে।’

সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষককে আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। তারপর গুদামে ধান দিয়ে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় টাকার জন্য। অনেক সময় এই টাকা পৌঁছাতে আরও বেশি সময় লেগে যায়। তাই কৃষকরা স্থানীয় বাজারে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে দেন। এতে প্রকৃত কৃষকের প্রতি মণে অন্তত ২৪০ থেকে ৪৪০ টাকা ক্ষতি হয়। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা গরিব কৃষকদের নাম ব্যবহার করে সরকারিভাবে ধান জমা দিচ্ছেন এবং বড় অঙ্কের মুনাফা করছেন।

গোদাগাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে নাজিরপুরের খাদ্য কর্মকর্তাদের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে কৃষক সারাবছরে শুধু একবার বোরো ফসল ঘরে তোলেন। সেখানে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে চাষিদের গুনতে হচ্ছে ঘুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অষ্টগ্রামের খাদ্য পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া একজন কৃষকের কাছ থেকে প্রতি টন ধানে ২ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করছেন। কৃষকরা জানান, ঘুষ না দিলে ধান ‘ভেজা’ বা ‘অনুপযুক্ত’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অষ্টগ্রাম খাদ্যগুদামের প্রহরীও কাগজ তৈরির নামে প্রতি টনে ২৭০ টাকা করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 

শুধু ঘুষই নয়, প্রকৃত কৃষকদের না জানিয়েই তাদের নাম ব্যবহার করে অন্যরা ধান দিচ্ছে। কৃষক জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান দিতে পারিনি, অথচ আমার নামে কেউ স্লিপ নিয়েছে।’ কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ধানে আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের কম হলেও তা নেয়নি গুদামের লোকজন। কারণ আমি ঘুষ দেইনি।’

শেরপুর জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফার্মার সিন্ডিকেট’। সরকারি অ্যাপে আবেদন করে যারা ধান দেওয়ার অনুমতি পান, তাদের অনেকেই ধান দেন না। এতে সুযোগ নেয় গুদামের দালাল চক্র। ৪০০ জন সাধারণ নারী-পুরুষকে দিয়ে ৪০০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। পরে সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রতিজনের নামে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা জমা হয়। ওই চক্র প্রত্যেককে মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়ে বাকি অর্থ তুলে নেয়।

এ ঘটনায় দুই দালালকে আটক করে পুলিশ, তবে অভিযোগকারী না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। শেরপুরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক ভূঁইয়া বলেন, এত সংখ্যক কৃষকের নামে হিসাব খোলাটা সন্দেহজনক। বিষয়টি তদন্ত করা হবে।

ফেনীর দাগনভুঞা উপজেলার কৃষকদের দাবি, সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে গেলে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে ধান ফেরত দেওয়া হয়। দালালরা কৃষকের কার্ড কিনে নিজেরাই ধান দিয়ে মুনাফা করছে। কৃষক সাদেক হোসেন বলেন, আমরা ধান নিয়ে গেলে ঘুষ চাওয়া হয়, দালালের ধান ঠিকই নেয়। 
দাগনভুঞার ১৬ জন কৃষক লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, কৃষকের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে খাদ্য উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো কৃষকদের অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রতি টন ধানে ১ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বেশি আর্দ্রতার ধান গ্রহণ করছেন গুদামের কর্মকর্তারা। এ কাজে সহায়তা করছে স্থানীয় দালাল সিন্ডিকেট, যারা কৃষকদের কার্ড কিনে চেকে স্বাক্ষর করিয়ে দিচ্ছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
নওগাঁয় চাল ও ধান মজুত করে বাজার অস্থির করার অভিযোগে জেলা খাদ্য বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, বাজারে দাম বাড়ার পেছনে মজুতদারির অভিযোগ ছিল। নিয়ম না মেনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

তাহিরপুর উপজেলার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা নুরুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষক আশরাফুল আলম, ঝিনুক তালুকদারসহ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন, খাদ্যগুদামে ধান দিতে গিয়ে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর্দ্রতার অজুহাতে তাদের ধান না নিয়ে ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের ধান গুদামে তোলা হচ্ছে। এ নিয়ে উপজেলার মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় খাদ্য ও কৃষি বিভাগের কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং দালালের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ধান সংগ্রহ সিন্ডিকেট। কৃষকদের অভিযোগ, যাচাই-বাছাই ছাড়া কৃষি বিভাগ তালিকা তৈরি করেছে এবং গোপনে লটারির মাধ্যমে নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। কৃষকরা নতুন তালিকা করে ধান সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের প্রতি কৃষকের আস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড.

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ধানের দাম বাড়িয়ে সরকার এটিকে কৃষকের জন্য ‘সুবর্ণ সুযোগ’ ভেবেছিল, বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে দুর্নীতির উৎসে। কৃষক নয়, লাভবান হচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও দলীয় শক্তি। এখনই কঠোর নজরদারি ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না নিলে ন্যায্য দামে ধান বিক্রির স্বপ্ন কৃষকের কাছে রয়ে যাবে অধরাই।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, সারাদেশে এবার কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। তার পরও কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ধ ন স গ রহ অ য ক উন ট খ ল ধ ন স গ রহ র ব যবহ র কর কর মকর ত ব যবস য় উপজ ল র ক ষকদ র ন ত কর ম বল ন র বল ন ক ষকর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন মাদক এমডিএমবি জব্দ, চক্রের হোতাসহ গ্রেপ্তার ৪

দেশে প্রথমবারের মতো নতুন ধরনের মাদক এমডিএমবির চালান জব্দ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। ভেপ বা ই-সিগারেটের মধ্যে গোপনে এই মাদক সরবারহ করা হতো।মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করা এই মাদকের হোতাসহ চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত খন্দকার তৌকিরুল কবির তামিম (২৬), মেহেদী হাসান রাকিব (২৬), বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেলস ও মার্কেটিং কর্মকর্তা মাসুম মাসফিকুর রহমান ওরফে সাহস এবং সম্প্রতি ভারতে পড়ালেখা করে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা আশরাফুল ইসলাম।

আরো পড়ুন:

টেকনাফে বিজিবির অভিযানে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার

উখিয়ায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার

তাদের কাছে পাওয়া গেছে, ৩৪০ মিলিলিটার এমডিএমবি, গাঁজার চকলেট, ভেপ ডিভাইস, ই-লিকুইড ও এমডিএমবি বিক্রির জন্য প্রস্তুত খালি ক্যানিস্টার।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসির মহাপরিচালক হাসান মারুফ বলেন, “সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে তরুণ সমাজের মধ্যে ই-সিগারেট ও ভেপের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের (ভেপ) ভেতরে ইদানিং নতুন সাইকোঅ্যাকটিভ পদার্থসহ (এনপিএস) এমডিএমবির ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইএনসিবি বিশ্বব্যাপী একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এমডিএমবির বিস্তার রোধে নজরদারিতে নামে ডিএনসি ঢাকা গোয়েন্দার একটি চৌকস দল। তাদের তৎপরতায় উন্মোচিত হয় ভয়ংকর মাদক এমডিএমবি-পিনাকা ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব চিত্র।”

অনলাইন-ডার্ক ওয়েবে নজরদারি 
আইএনসিবির নির্দেশনার পর ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ বদরুদ্দীনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঢাকার গোয়েন্দা দল অফলাইন ও অনলাইন মার্কেটপ্লেস, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডার্ক ওয়েবে নজরদারি শুরু করে। এ সময় ভেপের মাধ্যমে গোপনে ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের সিনথেটিক মাদক এমডিএমবির সন্ধান পাওয়া যায়।খুচরা বিক্রেতা হিসেবে তামিমকে চিহ্নিত করা হয় এবং সোর্স ব্যবহার করে তার কাছে স্যাম্পল অর্ডার করা হয়। অর্ডারকৃত মাদক ডেলিভারির মুহূর্তে ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে, ঢাকা মেট্রো উত্তর ও ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের একটি সমন্বিত দল ১০ ডিসেম্বর পল্লবীতে ২০ মিলি এমডিএমবিসহ প্রথম সরবরাহকারী তামিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও তার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বিশ্লেষণ করে এই ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট মেহেদী হাসান রাকিবের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে গোয়েন্দা নজরদারি ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে ১০ মিলি এমডিএমবিসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হত এমডিএমবি
রাকিবের জবানবন্দি ও ডিভাইস বিশ্লেষণে উদঘাটিত হয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা একটি এমডিএমবি–সাপ্লাই নেটওয়ার্ক। সেই সঙ্গে শনাক্ত করা হয় দেশে এমডিএমবি আনা দুই হোতার নাম- আশরাফ ও সাহস।

পরবর্তীতে সমন্বিত অভিযানে চক্রের দুই প্রধানকে গ্রেপ্তার করে তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালালে উদ্ধার হয়-৩১০ মিলিলিটার এমডিএমবি-পিনাকা (৫টি কন্টেইনারে), সিবিডি ইনফিউজড গাঁজার চকলেট, এমডিএমবি গ্রহণে ব্যবহৃত ৫টি ভেপ ডিভাইস, ই-লিকুইড এবং খালি ক্যানিস্টার।

সেগুনবাগিচায় ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

মিরপুর সেনপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে সমাজের এলিট শ্রেণির মাঝে সে এই ধরনের মাদক সরবরাহ করত। সে মূলত ই-সিগারেট ও ভেপ ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে তার সহযোগী সাহসের সমন্বয়ে এমডিএমবির মার্কেট তৈরির প্রচেষ্টা করছিল। বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করায় সেখান থেকে সে এই মাদক সংগ্রহ করে দেশে সরবরাহ করত।

এমডিএমবির ক্ষতিকর দিক
এমডিএমবির কয়েক ফোটাই মানুষের স্নায়ুতন্ত্র বিপর্যস্ত করতে সক্ষম। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ভেপ ডিভাইসকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে এই মাদক দ্রুত নেশা ধরায়, হ্যালুসিনেশন, আক্রমণাত্মক আচরণ থেকে শুরু করে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হওয়ার মতো মারাত্মক শারীরিক ঝুঁকি তৈরি করে। সাধারণ ফ্লেভারড লিকুইডের মতো দেখতে হওয়ায় এটি চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। ফলে ব্যবহারকারীরা বুঝতেই পারে না যে তারা আসলে গ্রহণ করছে এক উচ্চমাত্রার প্রাণঘাতী মাদক, যা আন্তর্জাতিকভাবে নেক্সট জেনারেশন সিনথেটিক ড্রাগ হিসেবে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচলিত নিকোটিন সম্বলিত ভেপ লিকুইডের সঙ্গে শুধু ১-২ ফোটা এমডিএমবি যুক্ত করে এই মাদক সেবন করা হয়।

বিক্রয় কৌশল
চক্রটি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুককে পুরোপুরি ‘অদৃশ্য বাজার’ হিসেবে ব্যবহার করত। ফেসবুকের ক্লোজড গ্রুপ, রিভিউ পেজ ও ভুয়া অ্যাকাউন্টে গোপন সংকেতভিত্তিক পোস্ট দিত তারা—যেখানে সাধারণ ফ্লেভার, গেমিং টুল বা ‘পোর্টেবল ডিভাইস’–এর আড়ালে বোঝানো হতো আসল পণ্য। আগ্রহী ক্রেতা ইনবক্সে মেসেজ পাঠালে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে, যেখানে কোডওয়ার্ডে দাম ঠিক করা হতো। অবস্থান শেয়ার, লাইভ ট্র্যাকিং এবং নির্দিষ্ট ইমোজি ব্যবহার করে সরবরাহ নিশ্চিত করা হতো—যা দেখে সাধারণ ব্যবহারকারী বুঝতেই পারত না যে এটি আসলে এমডিএমবির গোপন ডিজিটাল বিক্রয় নেটওয়ার্ক।

ঢাকা/এমআর/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল সরবরাহ করবে পুলিশ
  • ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোয় রাশিয়ার হামলা, ১০ লাখ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই
  • আলু দিয়ে রসমালাই, পায়েস, পেঁয়াজুসহ আরও কত কিছু বানানো যায়
  • কেপিএমে চার দিন বাদে ফের ‌‘ব্যালটের কাগজ’ ছাপা শুরু
  • নতুন মাদক এমডিএমবি জব্দ, চক্রের হোতাসহ গ্রেপ্তার ৪
  • কমেছে সবজির দাম, বেড়েছে মাছের দাম
  • বাজারে বাড়তি পেঁয়াজ ও সয়াবিন তেলের দাম