সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রাজনৈতিক আটক
Published: 24th, October 2025 GMT
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কারাবন্দী আছেন। তাঁর গ্রেপ্তার ও চলমান কারাবাস হাসিনা-পরবর্তী বিচারব্যবস্থার জন্য একটি বড় কালো অধ্যায়।
এ ধরনের গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ আমলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এভাবেই তখন আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ আর বিচার বিভাগ রাজনৈতিক হুকুমের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছিল। এমন স্বৈরাচারী ব্যবস্থার কারণেই আইনের শাসনের ওপর কোনো আস্থা ছিল না।
আজ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের অনেকেই একসময় এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অপব্যবহারের কঠোর সমালোচক ছিলেন; কিন্তু তাঁরা এখন হয় নিজেরাই এই অন্যায়ের সহযোগী হয়েছেন, নয়তো সব দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। যে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে তাঁরা আগে নিন্দা করতেন, এখন সেটিকেই তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন।
২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন বলে আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। সিনহাকে চাপ দেওয়ার অংশ হিসেবে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গুম করেছিল এবং হুমকি দিয়েছিল, সিনহা যদি পদত্যাগ করে দেশ না ছাড়েন, তাহলে তাঁকে গুম করে রাখা হবে।
আরও পড়ুনজুলাই হত্যাকাণ্ড: যত গুম–খুনের বিচার আইসিটির মাধ্যমেই যুক্তিযুক্ত২৪ আগস্ট ২০২৪এটা ঠিক, বর্তমান সরকার সেই পর্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করেনি। কিন্তু আরেক দিক থেকে তারা আবার আরও বেশি চরম মাত্রায় গেছে। তারা একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগে কারাগারে পাঠিয়েছে। আওয়ামী লীগ পর্যন্ত তাদের দমন-পীড়নের চরম সময়েও এমন করেনি।
নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও কাঠামোগত দুর্নীতির মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। যেখানে এসব অপরাধের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও শক্ত প্রমাণ আছে, সেসব ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত।
অন্তর্বর্তী সরকার যাঁদের গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক মামলাই যথার্থভাবে হয়েছে বলা যায়। বিশেষত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের যেসব মামলা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান, সেসব মামলার যথার্থ ভিত্তি আছে বলে প্রতীয়মান হয়।
কিন্তু এসব সত্যিকারের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও গ্রেপ্তার চলছে। এমনকি হতে পারে, এগুলোর সংখ্যা হয়তো প্রমাণভিত্তিক মামলার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে তাঁর অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার করার ঘটনা এই নতুন বিচারিক প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতির নিদর্শন।
হত্যা মামলা২০২৫ সালের ২৪ জুলাই খায়রুল হককে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরদিন তাঁকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আবুল কাইয়ুম আহাদ হত্যার ঘটনায় করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই মামলায় তাঁর সঙ্গে আরও ৪৮৬ জনের নাম রয়েছে।
এফআইআরে (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) খায়রুল হকের নাম থাকলেও সেখানে তাঁর সঙ্গে এই অপরাধের সম্পর্ক কীভাবে আছে, তার কোনো ব্যাখ্যা বা প্রমাণ নেই। গ্রেপ্তারের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখানোও হয়নি।
গত ২৫ জুলাই ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে স্পষ্টভাবে এই গ্রেপ্তারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্বীকার করে নেওয়া হয়। মামলার বাদীপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা বার ইউনিটের সভাপতি খোরশেদ আলম আদালতে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বানানোর প্রধান কারিগর হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বিচার বিভাগের কলঙ্ক। উনি বিচার বিভাগের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। আওয়ামী লীগের একজন কর্মীর মতো আচরণ করেছেন।’
খোরশেদ আলম তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোনো আইনি ভিত্তি দেখাননি। তাঁর বক্তব্য ছিল একেবারেই রাজনৈতিক। এমনকি তিনি এ কথা পর্যন্ত বলেন যে, যেহেতু হাসিনা সরকার আন্দোলনের সময় নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে, তাই সেসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি মামলায় খায়রুল হককেও আসামি করা উচিত।
খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা মনে করি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাঁর পেটোয়া বাহিনী নির্বিকারে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। আমরা মনে করি, প্রত্যেকটি হত্যা মামলায় সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে আসামি করা উচিত।’
প্রসিকিউশন যখন খায়রুল হককে রিমান্ডে পাঠানোর আবেদন করে, তখন তদন্ত কর্মকর্তা সেখানে ‘বারবার বিশ্বাসভঙ্গ’, ‘জালিয়াতি’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ’ ইত্যাদি অভিযোগের কথা বলেন, যার সঙ্গে এই হত্যা মামলার বিষয়াদির কোনো সম্পর্কই নেই। সেদিন খায়রুল হক জামিনের আবেদন করেননি। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, বিএনপি-ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা তাঁকে আইনজীবী নিয়োগ করতেও বাধা দিয়েছেন।
এক সপ্তাহ পরে খায়রুল হক জামিনের আবেদন করার সুযোগ পান। সেখানে তিনি লেখেন, সেদিন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের ডিউটি-লগ অনুযায়ী তিনি যাত্রাবাড়ীর কাছে কোথাও যাননি; তিনি সেদিন কেবল একবার বাসা থেকে বের হয়ে আইন কমিশনের অফিসে গিয়েছিলেন। তারপরও আদালত তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
আরও পড়ুনতৌফিক-ই-ইলাহীর মামলায় আইসিটির আটকসংক্রান্ত বিধি প্রশ্নের মুখোমুখি২৭ আগস্ট ২০২৫কোয়াশমেন্ট শুনানিতে সরকারের কাণ্ডএরপর খায়রুল হকের আইনজীবীরা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা কোয়াশ (ভিত্তিহীন বিবেচিত হলে উচ্চ আদালত দ্বারা বিচারের আগেই মামলা প্রক্রিয়া বন্ধ করার) আবেদন করেন। তাঁরা যুক্তি দেন, অভিযোগগুলো ‘মিথ্যা, বানানো ও হাস্যকর’; এগুলো শুধু তাঁকে ‘অপমান করার জন্য’ সাজানো হয়েছে এবং এই মামলা আদালতের ‘আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার’।
১০ আগস্ট শুনানির তারিখ ছিল; কিন্তু সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের আইনজীবীর অনুরোধে শুনানি পেছানো হয়। পরদিন বেলা তিনটার কিছু পরে শুনানি আবার শুরু হলে সাবেক প্রধান বিচারপতির পক্ষে আইনজীবী এম কে রহমান দাঁড়িয়ে বিচারকদের সামনে বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের একজন সিনিয়র আইনজীবী আদালতে এসে বিচারকদের বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল এখন অনুপস্থিত এবং তিনি যাতে নিজে উপস্থিত থাকতে পারেন, সে জন্য শুনানি আরও এক সপ্তাহ পেছাতে হবে। এই হস্তক্ষেপের ফলে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে আদালতকক্ষে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও হাতাহাতির পরিস্থিতি তৈরি হয়। শেষে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের সময় আবেদন মঞ্জুর করেন।
এই বিলম্ব সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। যেকোনো আইনজীবী মামলার এফআইআরটি দেখে বুঝবেন যে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সেখানে অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই মামলাটি তৎক্ষণাৎ কোয়াশ হওয়া উচিত ছিল এবং খায়রুল হককে বন্দী রাখার কোনো আইনি যুক্তি ছিল না। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের এই সময় প্রার্থনার আবেদন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। আসলে খায়রুল হকের প্রমাণবিহীন ও বেআইনি আটককে আরও দীর্ঘায়িত করাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ভয়ভীতি ও চাপ সৃষ্টিএরপরের ঘটনাকে আইনের মাধ্যমে মাস্তানি ছাড়া অন্য কিছু বলা মুশকিল। অকস্মাৎ ১৩ আগস্ট শাহবাগ থানায় একটা এফআইআর করা হয়। সেখানে খায়রুল হকের প্রধান আইনজীবী এম কে রহমান এবং আরেকজন সহকারী আইনজীবীর বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে গোলযোগের অভিযোগ করা হয়। অথচ সেই সময়ের মূল মামলায় তাঁদের নাম ছিল না। খুব স্বাভাবিক কারণেই এ থেকে ধারণা জন্মে যে খায়রুল হকের আইনজীবীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। গত ৭ আগস্ট, অর্থাৎ মামলাটির কোয়াশমেন্ট শুনানির কয়েক দিন আগে ঢাকা ট্রিবিউন–এ আইনজীবী কল্লোল কিবরিয়ার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতির গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেন। তিনি লেখেন, ‘বিচারিক সিদ্ধান্ত যত বিতর্কিতই হোক, তা কোনো অপরাধ নয়। যদি আসলেই কোনো অনিয়ম থাকে, তবে তা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, প্রমাণের ভিত্তিতে এবং আইনের নিয়ম মেনে বিচার করা উচিত। কিন্তু যখন রাজনৈতিক প্রতিশোধকে হত্যা মামলার নামে সাজানো হয়, সেটি বিচার নয়, সেটি আইনের মুখোশে প্রতিহিংসা।’
১১ আগস্ট, হাইকোর্টে শুনানি হওয়ার ঠিক পরদিন কল্লোল কিবরিয়াকে ঢাকায় তাঁর চেম্বারের সামনে কয়েকজন ব্যক্তি মারধর করেন। তাঁরা তাঁকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে গালি দেন এবং লেখালেখি বন্ধ করার হুমকি দেন। এক সপ্তাহ পর যখন হাইকোর্টে আবার শুনানি শুরু হয়, তখন এই রাজনৈতিক ভয়ভীতি এবং উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে খায়রুল হকের আইনজীবীরা শুনানি দুই মাস পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন।
‘জালিয়াতি’ ও ‘প্রতারণা’জুলাই ২০২৫–এর শেষে, খায়রুল হকের প্রথম গ্রেপ্তারের এক সপ্তাহ পর তাঁকে দ্বিতীয় এক মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই মামলা ছিল আপিল বিভাগের ২০১১ ও ২০১২ সালের কিছু আদেশ। এ সময়ে তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সেই আদেশে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক। এই আদেশের ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাদ দেয়। এর আইনি অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ পরপর তিনটি অন্যায্য নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকে।
কোনো বিচারককে তাঁর দেওয়া রায়ের জন্য বিচার করার বিধান নেই। তাই খায়রুল হকের বিরুদ্ধে এই ফৌজদারি মামলাটির ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে অন্যভাবে। মামলার অভিযোগ সাজানো হয়েছে ২০১১ সালের সংক্ষিপ্ত আদেশ এবং ২০১২ সালের পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যের ওপর ভিত্তি করে।
২০১১ সালের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়—তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অসাংবিধানিক হলেও পরবর্তী দুটি নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায় ‘হতে পারে’; কিন্তু এই ‘হতে পারে’ কথাটি পরের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ছিল না। এফআইআরে অভিযোগ করা হয়েছে, এই শব্দ বাদ দেওয়ার মাধ্যমে খায়রুল হক পেনাল কোডের অধীনস্থ অপরাধ ‘জালিয়াতি’, ‘প্রতারণা’ করেছেন এবং ‘তিনি জানতেন, এটি আইনের পরিপন্থী’, তারপরও ‘দুরভিসন্ধি বা দুর্নীতির উদ্দেশ্যে’ ওই আদেশ দিয়েছেন, যা পেনাল কোডের ২১৯ ধারার অপরাধ।
কিন্তু ‘জালিয়াতি’ বা ‘প্রতারণা’র অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই খাপ খায় না, বরং অভিযোগগুলো নিখাদ আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনায়।
অপর দিকে, ২১৯ ধারার অভিযোগ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এফআইআরে উল্লেখ করা হয়নি। তা হলো, ২০১২ সালে যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, তার আগেই সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ধারা বাতিল করে ফেলেছিল। অর্থাৎ বাদ দেওয়া অংশটি আইনি দিক থেকে ওই সময় আর কোনো গুরুত্বই বহন করছিল না। আইনি ভাষায় সেটি ‘আনফ্রাকচুয়াস’ বা অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল।
কাজেই যৌক্তিকভাবে বলা যেতে পারে, আদেশের সেই অংশ বাদ দিয়ে তিনি ‘আইনের পরিপন্থী’ কাজ করেননি। আর একই কারণে ‘দুরভিসন্ধি বা দুর্নীতির উদ্দেশ্য’ নিয়ে এই কাজ করেছেন সেই দাবিরও ভিত্তি থাকে না। এত কিছুর পরও যদি ধরেও নেওয়া হয়, রাষ্ট্রপক্ষ সত্যিই এই অভিযোগে বিশ্বাস করে, তারপরও খায়রুল হককে কারাগারে পাঠানোর যৌক্তিকতা ছিল না। তিনি পালিয়ে যাবেন ঝুঁকি নেই এবং তাঁর বন্দী থাকা তদন্তের স্বার্থেও প্রয়োজন নেই। পুরো বিষয়টাই রায়ের আগে শাস্তি দেওয়া। সোজা ভাষায়, রাজনৈতিক প্রতিশোধ। এর মধ্যে দেশের দুই স্থান থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একই রকম আরও দুটি মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে চলমান অবিচারকে আরও বীভৎস করে তোলা হয়েছে।
জমির মামলাসেপ্টেম্বরে খায়রুল হককে তৃতীয় এক মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলাটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলা রাজউকের পক্ষ থেকে পূর্বাচলে একটি প্লট বরাদ্দের বৈধতা এবং ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার সুদ পরিশোধ না করার অভিযোগকে ঘিরে করা হয়েছে। অভিযোগগুলো খুবই টেকনিক্যাল ও জটিল। খায়রুল হকের পরিবার এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত জবাবও প্রস্তুত করেছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো মামলাটি করার বা গ্রেপ্তার দেখানোর আগে দুদক খায়রুল হকের পক্ষের বক্তব্য জানার প্রয়োজন মনে করেনি। এতে বোঝা যায়, শুধু তাঁর আটককাল বাড়ানোই ছিল এই মামলার উদ্দেশ্য। যদি ধরে নেওয়া হয় যে দুদকের কিছু অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হবে (খায়রুল হকের পরিবার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একটি অভিযোগেরও প্রমাণ নেই), তাহলেও প্রিট্রায়াল বা বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাঁকে বন্দী করে রাখার কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলার মূল অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার সুদ পরিশোধ না করা। এ ধরনের অর্থবিষয়ক বিবাদ সিভিল আদালতেই যাওয়ার কথা, বিশেষায়িত সংস্থা দুদকের কাছে নয়।
থামেনি অবিচারখায়রুল হককে আটক করা হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে, আইনি বা তদন্তের ওপর ভিত্তি করে নয়। এ ধরনের রাজনৈতিক আটক আগেও সমালোচিত হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে, এখনকার সরকারে থাকা ‘উপদেষ্টারা’, তাঁদের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এবং বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করতেন।
পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন তাঁরা এমন একটি ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দমনমূলক প্রকৃতি সেখান থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকেই জিইয়ে রাখছে। তাঁরা এই অন্যায়কে উপড়ে ফেলতে কোনো পদক্ষেপ তো নেনইনি, অনেকে এই অন্যায়কে জিইয়ানোর অংশীদার হয়ে গেছেন।
হয়তো তিক্ত পরিহাসের মতো শোনাবে, কিন্তু এসব অন্যায় চলা অবস্থাতেই জুলাই সনদকে ঘিরে ‘সংস্কার’ নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে আহ্বান করেছেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে যেন জুলাই সনদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ‘বর্বরতা থেকে সভ্যতায়’ এসেছে তার প্রমাণ রাখা যায়। অথচ বাংলাদেশ সরকার আর জুলাই সনদকে সমর্থন করা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চোখের সামনে ঘটমান অন্যায় ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আটক বন্ধে লেশমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
ডেভিড বার্গম্যান দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিষয়ে লেখালেখি করছেন। তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করা যাবে এখানে: david.
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ওপর ভ ত ত র উদ দ শ য র র জন ত ক হত য ক ণ ড র আইনজ ব আইনজ ব র প রক র য় ব যবস থ এ ধরন র অন য য় হয় ছ ল কর ছ ন য গ কর র জন য অপর ধ আগস ট আইন র তদন ত ক আটক র আইন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
আত্মসমর্পণকারী সেনা কর্মকর্তারা নির্দোষ, অপরাধীরা পালিয়েছেন: আইনজীবী
মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলায় যে ১৫ জন সেনা কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরা নির্দোষ বলে দাবি করেছেন তাঁদের আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন। তিনি বলেছেন, এই মামলার মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন।
আজ বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামি হিসেবে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির করার পর শুনানি শেষে আইনজীবী সরোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। ট্রাইব্যুনাল কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে এই সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সেনানিবাসের সাবজেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৫ আসামির আইনজীবী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী সরোয়ার হোসেন পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এর আগে সেনা সদরের আদেশে সংযুক্তকৃত ১৫ জন অফিসার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আজকে স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সারেন্ডার করেছেন। তাঁরা অনেক সিনিয়র অফিসার, অভিজ্ঞ অফিসার। আন্তর্জাতিক বাহিনীতেও অনেকে চাকরি করেছেন। তাঁরা সবাই আশা করেন, তাঁরা এই আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন।’
প্রসিকিউশন এই সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছিল। সে বিষয়ে প্রশ্নে আসামিদের আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি তাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু সেটা পুলিশের মাধ্যমে কোর্টে সারেন্ডার করেছেন, সেটাকে তাঁরা বলেছেন যে তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা কখনোই গ্রেপ্তার ছিলেন না। আগে সেনা সদর ব্রিফিং করেছিল, সেখানে তারা বলেছে, তাঁরা আর্মি হেফাজতে আছেন।’
এই সেনা কর্মকর্তারা হলেন মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম।
আরও পড়ুন১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে নেওয়া হলো সেনানিবাসের সাবজেলে ১ ঘণ্টা আগেবিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা একটি মামলায় মোট ২৫ জন সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই এই তিন মামলায় ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছিল প্রসিকিউশন। এরপর ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৫ জন কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
এই মামলাগুলোয় বাকি আসামিদের দিকে ইঙ্গিত করে আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই অফিসাররা অত্যন্ত আত্মবলে বলিয়ান এবং তাঁরা নির্দোষ। তাঁরা কোর্টের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নির্দোষ প্রমাণিত হবেন বলে আশাবাদী। যাঁরা সত্যিকারের অপরাধ সংঘটন করেছেন, তাঁরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন। জেনারেল কবির, জেনারেল আকবর, জেনারেল তারিক সিদ্দিকী, জেনারেল মুজিব পালিয়ে গেছেন।’
এই মামলাগুলোয় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনও আসামি। এর মধ্যে আল–মামুন গ্রপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অ্যাপ্রুভার। তিনি বলেছেন, যা কিছু হয়েছে, তা শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের নির্দেশে হয়েছে। এখানে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাদের এই ঘটনার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।’