প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, আইন কেবল নিয়মের সমষ্টি নয়, বরং এটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয়, আর ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আজ শনিবার সকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। সকাল সাড়ে নয়টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, মানবতা যখন অবিচার ও অমানবিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে, তখনই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা মানবজাতিকে নতুন এক নৈতিক চেতনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাদের কণ্ঠ রোধ করে, তখন ন্যায়ের জন্য লড়াই করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ন্যায়বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ বিনির্মাণ করতে হবে।’

সচিবালয় বিচার প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাঠামো হিসেবে কাজ করবে

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নিজে বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করেন, যার কেন্দ্রে একটি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেন, এই সচিবালয় বিচার প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাঠামো হিসেবে কাজ করবে, যেখানে ন্যায়বিচার ও বিচারব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অভিগম্যতা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হবে।

মাত্র দুই দিন আগ (২৩ অক্টোবর ২০২৫) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ বিগত ১৫ মাসের সুপরিকল্পিত কৌশলগত প্রচেষ্টা ও বহুপক্ষীয় প্রয়াসের ফল। এই ১৫ মাসে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী শাখার মধ্যে কৌশলগত বোঝাপড়া ও সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘এখন আমাদের প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা, আস্থা ও দূরদর্শিতা, যাতে বিচার বিভাগের কাঠামোগত স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।’ এই কাঠামোগত পরিবর্তনের টেকসই রূপায়ণ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

জেলা আদালতে পেশা পরিচালনাকারী আইনজীবী সমাজ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, জেলা আদালতের বিচারক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ সব অংশীজনের প্রতি এই কাঠামোগত রূপান্তরকে টেকসই করতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি।

সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, সব অংশীজনের একটি মৌলিক সত্য উপলব্ধি করতে হবে যে তারা সবাই একটি পারস্পরিক দায়বদ্ধতার সম্পর্কে দায়বদ্ধ। তাই সবার পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সহযোগিতা, যুক্তিবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা।

সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো ধরনের অবিশ্বাস বা একতরফা আচরণ গত ১৫ মাসের নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার এই ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে। তাই বিচার বিভাগীয় স্বায়ত্তশাসনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও নবীন আইন স্নাতকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনের অধ্যয়ন কেবল পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়, বরং এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাধনা। প্রত্যেক আইনজীবী ও বিচারককে মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক আইনের পেছনে আছে একটি জীবন, প্রত্যেক রায়ের পেছনে আছে একটি ভাগ্য। ন্যায়ের প্রকৃত মান নিরপেক্ষ ও মানবিক বিচারের মধ্যে নিহিত।

‘এখনো ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছি’

প্রযুক্তিনির্ভর ন্যায়বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছি। তাই ডেটানির্ভর ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল সংযোগ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয়তার যুগে আমাদের বিচারব্যবস্থাও সময়োপযোগী হতে হবে।’

দেশের আইনাঙ্গনের সমৃদ্ধিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য প্রাজ্ঞ আইনবিদ তৈরি করেছে। বিশ্বাস করি, এখান থেকে ভবিষ্যতেও এমন আইনজ্ঞ তৈরি হবে, যাঁরা কেবল জ্ঞানে নয়, মানবিকতাতেও আলোকিত হবেন।’

ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণ এখন সময়ের আহ্বান

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণ এখন আমাদের সময়ের আহ্বান। সংবিধানের যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার রয়েছে, তা যেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, সেটিই আমাদের দায়িত্ব।’ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে আহ্বান জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো.

শফিকুল ইসলামের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে হাইকোর্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তারা, বিশিষ্ট আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও নবীন আইন স্নাতকেরা উপস্থিত ছিলেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অ শ জন র অন ষ ঠ ন স ব ধ নত ব যবস থ আইনজ ব আহ ব ন ম নব ক আম দ র সমন ব

এছাড়াও পড়ুন:

আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা, কিশোরগঞ্জের সেই নেতাকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার

আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া কিশোরগঞ্জের সাবেক বিএনপি নেতা ও আইনজীবী ফয়জুল করিমকে জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় প্রাথমিক সদস্যপদসহ ফোরামের জেলা যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

আজ শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কিশোরগঞ্জ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্যসচিব শরীফুল ইসলাম বিষয়টি জানান। এ সময় ফোরামের সদস্য শফিউজ্জামান, শেখ মাসুদ ইকবাল, জাহাঙ্গীর মোল্লা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গত বুধবার ফেসবুক লাইভে বক্তব্য দেন ফয়জুল করিম। পরে ২ মিনিট ১২ সেকেন্ডের সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ফেসবুকে তাঁর দলে যোগদানের খবর প্রচার করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ফয়জুল করিম দলবদলের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

ফয়জুল করিম কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদপ্তর সম্পাদক, পৌর বিএনপির সদস্য ও জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা বিএনপির সম্মেলনে আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ এখনো চলমান। এর মধ্যে আজ তাঁকে আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও ৫ অক্টোবর নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি পৌর বিএনপি ও আইনজীবী ফোরামের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আইনজীবী ফোরামের সদস্যসচিব শরীফুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও গঠনতন্ত্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় ফয়জুল করিমকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কিশোরগঞ্জের যুগ্ম আহ্বায়ক ও প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।

এ বিষয়ে কথা বলতে ফয়জুল করিমের মুঠোফোন নম্বরে কল করলেও বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুনকিশোরগঞ্জের বিএনপির সাবেক নেতা ফয়জুল করিম যোগ দিলেন আওয়ামী লীগে২৩ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ন্যায় ব্যর্থ হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে: প্রধান বিচারপতি
  • রাবিতে বিচারপতিদের মিলনমেলা
  • আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা, কিশোরগঞ্জের সেই নেতাকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার
  • আ.লীগে যোগ দেওয়া মুবিনকে আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার 
  • চরফ্যাশনে গাছিরখাল লঞ্চঘাটে আইনজীবী ছিদ্দিক উল্লাহের চেষ্টায় পন্টুন স্থাপন
  • সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রাজনৈতিক আটক
  • শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় কবে, জানা যাবে ১৩ নভেম্বর
  • শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় কবে
  • কিশোরগঞ্জের সাবেক বিএনপি নেতা যোগ দিলেন আওয়ামী লীগে