যাচাই ও প্রস্তুতি ছাড়াই কেন আন্তর্জাতিক মর্যাদা
Published: 26th, October 2025 GMT
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির মাত্র ১১ দিনের মাথায় সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত মোটেই যৌক্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেচনা নয়। সমুদ্রতীরবর্তী বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার জন্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প যে জনগণের জন্য কত বড় বোঝা হতে পারে, তার বিস্তর দৃষ্টান্ত বিগত সরকার স্থাপন করে গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কেন যাচাই ও প্রস্তুতি ছাড়াই এমন ঘোষণা দেবে, যেখান থেকে তাদের সরে আসতে হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ একদিকে যেমন জাতীয় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে, অন্যদিকে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ১২ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রথম আলোকে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে আজ রোববার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ঘোষণার পর দেশি–বিদেশি কোনো এয়ারলাইন কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি।
কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোকে লাভজনক বলে মনে করছে না সংস্থাগুলো। কেননা অবকাঠামো উন্নয়ন করে একটি বিমানবন্দরকে শুধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলে ঘোষণা দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলের জন্য যথেষ্ট যাত্রী ও বাণিজ্যের পরিবেশ আছে কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয়।
প্রকল্প নেওয়ার আগে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো বিমান পরিচালনা করতে আদৌ আগ্রহী কি না, সেটা যে যাচাই করা হয়নি, সেটাই এখানে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের অটেকসই প্রকল্প নেওয়া ও জনগণের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।কক্সবাজার ঘিরে বিদেশিদের জন্য পর্যটনশিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সব সময়ই একটা উচ্চাশা দেখা যায়। কিন্তু বিদেশি পর্যটক টানার জন্য সমুদ্রসৈকতে যে ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকা দরকার, সেটা কক্সবাজারে নেই।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে একবারে বড়সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় নেওয়ার পর ধারণা দৃঢ় হয় যে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে এনজিও ও দাতা সংস্থার কর্মীদের সরাসরি যাতায়াতের সুবিধা হবে। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবসম্মত চিন্তা হতে পারে?
ফলে দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত যাত্রী আছে কি না, সেটা বিবেচনা না করেই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ‘আন্তর্জাতিক মর্যাদা’ দেওয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে অবকাঠামো ও লোকবলের ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। যেমন রানওয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হলেও এর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি, টার্মিনালগুলোর কাজ যথাযথভাবে শেষ হয়নি, নিরাপত্তাব্যবস্থাও কার্যকর করা হয়নি, যথেষ্ট লোকবলও নিয়োগ দেওয়া হয়নি, কার্গো–সুবিধা ও কার্গো নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। এত সব ঘাটতি থাকলে বিমান সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালানোর ব্যাপারে কতটা আগ্রহী হবে?
প্রধান উপদেষ্টা গত মার্চে কক্সবাজার বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন। সে সময় বেবিচকের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে। প্রতিদিন বিমানবন্দরটি থেকে ৪০–৫০টি বিমান ওঠানামা করবে। কিন্তু বেবিচকের এই পূর্বানুমানের সঙ্গে বাস্তবতার যে বিস্তর ফারাক, সেটি এখন স্পষ্ট।
প্রকল্প নেওয়ার আগে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো বিমান পরিচালনা করতে আদৌ আগ্রহী কি না, সেটা যে যাচাই করা হয়নি, সেটাই এখানে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের অটেকসই প্রকল্প নেওয়া ও জনগণের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ম নবন দরক র জন য ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমার তো রাজনীতি নাই, আমার হইল পেটনীতি’
শিরোনামটি বাংলাদেশের আপামর জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন বললে খুব একটা ভুল হবে না। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এ আর এমনকি! কিন্তু এই কথার মর্মার্থ অনেক গভীর।
বিআইজিডির ‘দুর্দিনের ডায়েরি’ নামক গবেষণায় উঠে আসে যে করোনা মহামারির পরে যাঁরা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, তাঁদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের একটি কৌশল ছিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ভাতা, অনুদান, সুলভ মূল্যে পণ্য ক্রয় ইত্যাদি সেবা নেওয়া। এই সেবা নেওয়া প্রক্রিয়ার একটি বৃহৎ অংশজুড়ে ছিল রাজনৈতিক যোগসূত্রতা।
নতুন দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্র, সবাই এই রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এর বিপরীতে অনেকে আবার সরকারি সহায়তার রাজনৈতিক বণ্টন নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, এই গবেষণার সময় ছিল ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিআইজিডি এবং আইডিএস, ‘ডেটা অ্যান্ড এভিডেন্স টু অ্যান্ড এক্সট্রিম পভার্টি (ডিইইপ)’ শিরোনামে আরেকটি যৌথ গবেষণার কাজ শুরু করে। এ গবেষণায় অংশ নেন হতদরিদ্র থেকে শুরু করে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাঁদের দারিদ্র্যের গতিপথ বুঝতে গিয়ে এক আপাতবিরোধী পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, হঠাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন রদবদল তাঁদের বিপাকে ফেলেছে। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের জন্য কার কাছে যাবেন, কার কাছে তদবির করবেন। কারণ, সিটি করপোরেশন কিংবা উপজেলায় যাঁরা বিভিন্ন পদে বা কমিটিতে দায়িত্বরত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনার পলায়নের পর পালিয়ে যান বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক জনপ্রতিনিধিও। ফলে সেবা গ্রহীতারা পড়েন ভোগান্তিতে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা যে যোগসূত্র কাজে লাগিয়ে নানান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিলেন, তার এমন আকস্মিক অনুপস্থিতি তাঁদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়।
এই দুই গবেষণা সাবেক সরকারের পতনের আগে ও পরে রাজনীতিকরণের দুটি ভিন্ন অবস্থা তুলে ধরে। সরকার পতনের আগে অনেক যোগ্য ব্যক্তিদেরও রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সেবা না পাওয়ার কারণ ছিল মধ্যস্থতা করা ব্যক্তিদের মারাত্মক পর্যায়ের হস্তক্ষেপ; কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে না পারার কারণ হলো কোনো মধ্যস্থতা করা ব্যক্তি নেই।
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে, ‘রাজনীতিকরণই কি তাহলে তাদের একমাত্র অবলম্বন? সমস্যাটা আসলে কোথায়?’ আমরা সংস্কারের কথা বলছি, রাজনীতিকরণ বন্ধ করার কথা বলছি; কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের জন্য সেটি সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কেন নয় তা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে নিম্ন আয়ের মানুষ কেন রাজনীতিকরণের শিকার হন। তাঁরা কিন্তু পুকুরচুরির উদ্দেশ্যে রাজনীতি করেন না। তাঁরা ভাতা ও চাল-ডাল—এসবের জন্য রাজনীতি করেন। ‘আমার তো রাজনীতি নাই, আমার হলো পেটনীতি।’ মানে তাঁরা রাজনীতি করেন পেটের দায়ে। তাহলে কী করলে তাঁরা আর এই রাজনীতি করবেন না বা তাঁদের এই রাজনীতি ঠিক, নাকি ভুল? একজন গবেষক হিসেবে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
নিম্ন আয়ের মানুষের রাজনৈতিক বোঝাপড়া কীভাবে রাজনীতিকরণকে টিকিয়ে রাখে এবং সে কারণে কীভাবে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ দুর্বল হয়ে পড়ে, তা বোঝা জরুরি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার বন্ধ করা বা জবাবদিহি নিশ্চিত করা শুধু সংবিধান বা নিয়মকানুন দিয়ে সম্ভব নয়। জনগণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক আচরণ অনুশাসনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
আবার অনুশাসনের ধরনও জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাধারা নির্মাণ করে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে দলীয় রাজনীতির আশ্রয় নেওয়ার দায় শুধু সাধারণ মানুষের ওপর চাপালে ভুল হবে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার এক খেলায় মেতে থাকেন। জনগণকে নানান কৌশলে অধস্তন হিসেবে রাখার এই চর্চা আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নয়। আমাদের এই পুরোনো ও বিধ্বংসী চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে জনগণের সার্বভৌমত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব আমরা নিজেরাই।
সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনমান উন্নত করা। তাই কোনো সংস্কার স্থায়ী ও টেকসই হবে কি না, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে জনগণের কাছে সেটির গ্রহণযোগ্যতার ওপর। আমাদের সংস্কারের আলোচনায়ও এই বহুমাত্রিক জটিল বাস্তবতার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রচেষ্টায় এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়।
তবে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি রাজনীতির এসব ছিদ্রপথ বন্ধ করা যায়, তাহলে মানুষের রাজনৈতিক আচরণেও পরিবর্তন আনা সম্ভব। সেটির জন্য প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক এবং প্রেক্ষাপট–উপযোগী আলোচনা, তাৎক্ষণিক গবেষণা এবং সেই অনুযায়ী নীতিমালা নির্ধারণ করা। পারস্পরিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র নিয়ে জনগণের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্কার হলো এই উদ্যোগের প্রাথমিক ধাপ।
সংস্কার একটি চলমানপ্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো জনগণ। অতএব, তাদের বাস্তবতা বিবেচনা করেই এর পরিকল্পনা করতে হবে। তা না হলে আমরা এই অনিয়ম আর তা থেকে মুক্তির পথে যে নীতিগত ত্রুটি, সেই গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাব এবং বারবার ব্যর্থ হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টা।
রাবিনা সুলতানা রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।
*মতামত লেখকের নিজস্ব