জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে প্রথমে একটি বিশেষ আদেশ জারি, এরপর গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আজ সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই সুপারিশ জমা দেওয়া হতে পারে।

ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সূত্র জানায়, সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে। গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠন করার সুপারিশ করা হতে পারে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৭টি প্রস্তাব সংবিধান-সম্পর্কিত। মূলত এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। এ প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এর মধ্যে ৭টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বিএনপির।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশের খসড়া তৈরির কাজ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার বাস্তবায়ন না করলে কী হবে, তা নিয়ে একটি উপায় এবং আগামী সংসদে কীভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা যায়—এ দুটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত আজ সকালে চূড়ান্ত করা হবে। আজ সকালে কমিশন আবার বৈঠক করে সুপারিশ চূড়ান্ত করে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের রূপরেখা অনুযায়ী, প্রথমে একটি আদেশ জারি করা হবে। এই আদেশের ভিত্তি হবে গণ-অভ্যুত্থান। আদেশটির নাম হবে ‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’। সেটার অধীনে গণভোট নিয়ে একটি অধ্যাদেশ করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট।

আদেশের পরিশিষ্টে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর উল্লেখ থাকবে। গণভোটে প্রশ্ন হবে এমন—জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করেন কি না এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। গণভোটে পাস হওয়া সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এ সময় সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। বাস্তবায়নের পুরো প্রক্রিয়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে উল্লেখ থাকবে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, আদেশ জারির পর এর কিছু অংশ তাৎক্ষণিক এবং কিছু কিছু বিষয় পরবর্তী সময়ে কার্যকর হবে। আদেশের কোন ধারা কবে কার্যকর হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকছে। জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো আদেশের পরিশিষ্টে উল্লেখ থাকবে। তবে সেখানে কোনো দলের ভিন্নমতের বিষয় উল্লেখ থাকবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়নের আরেকটি বিকল্প পদ্ধতিও সুপারিশ করবে। তবে সেটাও প্রায় একই। সেখানে শুধু গণভোটের বিষয়টি আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে একটি বিল আকারে উপস্থাপন করে তার ভিত্তিতে গণভোট করার বিকল্প সুপারিশ করা হতে পারে।

দুই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে সরকার

গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলেও গণভোট কবে হবে, এর ভিত্তি কী হবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—এসব ক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতবিরোধ আছে। ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে—এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কি রাষ্ট্রপতি জারি করবেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।

আগামী সংসদেই হতে পারে উচ্চকক্ষ

গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করা হতে পারে। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সূত্র জানায়, কমিশন চায় এটি আগামী সংসদেই বাস্তবায়ন হোক। কিন্তু সংবিধান সংস্কার হওয়ার আগে সেটা কীভাবে হবে, সে প্রশ্নের পুরোপুরি সুরাহা হয়নি। কারণ, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে হবে। অন্যদিকে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে গৃহীত হওয়ার পর।

কমিশন–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বিষয়ে গতকাল বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, এটি আগামী সংসদেই করা যাবে। সংসদে ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবগুলো গৃহীত হওয়ার পর উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। সংসদে এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে দলগুলো উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে।

সূত্র জানায়, যেহেতু গণভোটে ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না, সেহেতু গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে পিআর পদ্ধতিতেই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। অর্থাৎ একটি দল জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।

বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা

সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ মূলত আটকে ছিল বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা প্রশ্নে। ২৭০ দিনের মধ্যে আগামী সংসদ সনদ বাস্তবায়ন না করলে কী হবে, এ নিয়ে কমিশন নানা বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, গণভোটে সংস্কার প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে। তা ছাড়া সনদে ইতিমধ্যে দলগুলো সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। কমিশন এটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এর বাইরে কোনো নিশ্চয়তা বিধান করা যায় কি না, সেটা এখনো কমিশনের বিবেচনায় আছে।

কমিশনের একটি সূত্র জানায়, ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত করা বা এ ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হবে না। তবে ইতিবাচক একটি বিকল্প নিয়ে তাঁরা ভাবছেন। সেটা আজ সকালে চূড়ান্ত করা হতে পারে।

ঐকমত্য কমিশনের গতকালের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন। তাঁরা হলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন।

কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো.

এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। জাতীয় ঐকমত্য গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছি। কমিশন আশা করছে, আজকের মধ্যে সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সম্ভব হবে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব চ ড় ন ত কর জ ল ই সনদ ভ ন নমত গঠন কর ব কল প প স হল হওয় র গণভ ট গতক ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, জড়িতদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম

ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথকভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারী ও নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তারের সময় বেঁধে দিয়েছে।

আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় ডাকসু, বিকেলে ‘সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পৃথক কর্মসূচি পালন করে।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ডাকসু। সমাবেশ থেকে ডাকসুর সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার ভেতরে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং এই ন্যক্কারজনক ঘটনার নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তার করে বিচার কার্যকর করতে হবে।’

ডাকসুর এজিএস আরও বলেন, ‘যারা এ ধরনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত, তাদের যদি এই সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে না পারে, তাহলে এই সরকার জনতার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে।’

ডাকসুর পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ার করতে চাই—যদি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের শনাক্ত করা না হয় এবং এর পেছনের রাঘববোয়ালদের গ্রেপ্তার করা না হয়, তবে বাংলাদেশে দাবানল জ্বলবে।’

এর আগে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দর ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। এতে সংগঠনের আহ্বায়ক রিয়াদুস জুবাহ ওসমান বলেন, ‘এই হামলার সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। যারা এ ঘটনার নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী, সেই মাস্টারমাইন্ডদেরও দৃশ্যমান আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই এখন একমাত্র পথ।’

এদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেছে। বিকেলে ছাত্রদল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি শিববাড়ি ও জগন্নাথ হল এলাকা ঘুরে আবার জরুরি বিভাগের সামনে এসে শেষ হয়।

বিক্ষোভে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় নেতা–কর্মীরা ‘হাদিকে গুলি কেন, ইন্টেরিম জবাব দে’, ‘হাদির ওপর হামলা কেন, ইন্টেরিম জবাব দে’, ‘ছাত্রদলের অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

ছাত্রদলের নেতারা ওসমান হাদির ওপর হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ