সাফল্য অর্জনের জন্য মুমিন সমাজকে সম্মিলিতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু মৌলিক শর্ত পালন করতে হয়:

১. আত্মশুদ্ধি

আত্মশুদ্ধি হলো ব্যক্তির ভেতরের সৎ ও ন্যায়ের দিকে ধাবিত হওয়া সহজাত প্রবণতাগুলোকে পরিচর্যা করা এবং সেগুলোকে বিকশিত করা।

বাহ্যিক পরিবেশ, নির্দেশনা ও উদ্দীপনা এই সহজাত প্রবণতাকে জাগ্রত করতে, শাণিত করতে ও সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে, যাতে মানুষ সত্যকে তার সঠিক রূপে উপলব্ধি করতে পারে। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, “নিশ্চয় সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে আত্মাকে পবিত্র করেছে।” (সুরা শামস, আয়াত: ৯)

২.

সবর

সবর হলো ধৈর্য, যা সাফল্যের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। এটি তিন ধরনের হয়:

আনুগত্যে ধৈর্য: আল্লাহর বিধান ও ইবাদত পালনে ধৈর্যধারণ করা।

পাপ থেকে বিরত থাকার ধৈর্য: নফসের কামনা, লোভ ও আকাঙ্ক্ষা এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে দূরে থাকার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।

বিপদাপদে ধৈর্য: বাতিল ও অসত্যের বাড়াবাড়ি, জালিমের নির্লজ্জতা, দুর্দিনে সাহায্যকারীর অভাব এবং কঠিন মুহূর্তে হতাশা ও সন্দেহের বিরুদ্ধে অবিচল থাকা।

এর পাশাপাশি বিজয় ও ক্ষমতা লাভের পর বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ধৈর্যও জরুরি। সকল পরিস্থিতিতে—সুখে-দুঃখে—আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ বজায় রাখা এবং তাঁর ফয়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করাই সবর। (গাজালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ৪/৫৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৫)

৩. অবিচলতা

অবিচলতা মানে এখানে শত্রুদের চেয়েও বেশি দৃঢ় ও অবিচল থাকা। এটি শত্রুর ধৈর্যের বিরুদ্ধে নিজেদের ধৈর্যের এক প্রতিযোগিতা। যখন ভ্রান্তপন্থীরা তাদের পথে অবিচল থাকে, তখন সত্যপন্থীদের উচিত আরও বেশি দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।

আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা কষ্ট পাও, তবে তারাও তোমাদের মতোই কষ্ট পাচ্ছে, আর তোমরা আল্লাহর কাছে এমন কিছু আশা করো যা তারা আশা করে না।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১০৪)

আরও পড়ুনসফলতা ও বিজয়ের জন্য ঐক্যের গুরুত্ব ১৬ আগস্ট ২০২৪৪. সতর্ক অবস্থান

ইসলামি পরিভাষায় একে বলে মুরাবাতা। অর্থাৎ, জিহাদের স্থানে, সীমান্ত ও স্পর্শকাতর অঞ্চলে সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকা। ইসলাম প্রচারের গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মুসলিম উম্মাহ সবসময় শত্রুদের বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এটি নবীদের ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহর এক সাধারণ নীতি। যখন ওয়ারাকা ইবনে নওফল রাসুল (সা.)-কে বলেছিলেন যে, “আপনার মতো বার্তা নিয়ে এমন কেউ আসেনি, যার বিরুদ্ধে শত্রুতা করা হয়নি” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩), তখন এটিই প্রমাণিত হয়েছে।

এই কারণে মুসলিম উম্মাহকে তার স্থায়ী ও স্বাভাবিক শত্রুদের থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য সর্বদা সতর্কতা ও পাহারায় থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো এবং সীমান্ত পাহারায় প্রস্তুত থাকো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)

৫. খোদাভীতি

খোদাভীতি হলো ভেতরের সেই সুরক্ষা, যা ব্যক্তিকে খারাপ পরিস্থিতিতে প্রভাবিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। কঠিন সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সামরিক পরাজয় ততক্ষণ পর্যন্ত সামান্যই ক্ষতি করতে পারে, যতক্ষণ না তা মৌলিক নীতি, নৈতিকতা ও আত্মাকে পরিবর্তন করে ফেলে।

আল্লাহকে ভয় করা সমাজের আত্মাকে পরিমার্জিত, শক্তিশালী ও উন্নত করার পথ। এর মধ্যে রয়েছে সৎ আচরণ, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা (যেমন সুদ, মদ, জুয়া), কঠোরভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, লোভের প্রতিরোধ করা, সহযোগিতা, আত্মত্যাগ, আল্লাহর পথে ব্যয় এবং জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা।

খোদাভীতিই বিবেক বা চেতনার সতর্ক প্রহরী, যা ব্যক্তিকে ভুল পথে বা দুর্বলতায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটিই সাফল্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু, “সুতরাং হে জ্ঞানীরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১০০)

৬. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ

সমাজকে সংশোধন ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করার জন্য এই কাজটি অপরিহার্য। এটি ধর্ম, জীবন, জ্ঞান, সম্পদ ও বংশ—এই পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে রক্ষা করে। এর মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আল্লাহ উম্মাহকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে; আর এরাই হলো সফলকাম।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪)

আরও পড়ুনবিশ্বাসীরা কখন সফল হবে০৮ মে ২০২৫৭. রাসুল (সা.)-এর খাঁটি অনুসরণ

সাফল্যের জন্য আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য একমাত্র সেই পদ্ধতিতেই করতে হবে, যা তিনি তাঁর রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে বিধিবদ্ধ করেছেন। যারা রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং তাঁর সঙ্গে নাজিলকৃত নূর (কোরআন) অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭)

৮. অনুতাপ ও প্রত্যাবর্তন

তওবা মানে আল্লাহর দিকে দ্রুত ফিরে আসা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি ভ্রান্ত পথ থেকে সরে আসার প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা তওবাকে সাফল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা জুমার, আয়াত: ৩১)

৯. আল্লাহকে স্মরণ করা

আল্লাহর জিকির বা স্মরণ অধিক পরিমাণে করলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী। কোরআনে বলা হয়েছে, “আর তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা জুমুআ, আয়াত: ১০)

১০. আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া

আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, যা তিনি কৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন, এর মাধ্যমেও সাফল্য লাভ হয়: “সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৯)

আরও পড়ুনসফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য২৫ মার্চ ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ফল য র সৎ ক জ র জন য আল ল হ স মরণ সতর ক

এছাড়াও পড়ুন:

একঘেয়ে পড়াশোনা থেকে মুক্তি: ‘উইক প্ল্যান’ পদ্ধতিতে মেলে সফলতা

১৯৯৪ সালে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’ ধারণা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। তিন দশকের বেশি সময় পরও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনো জটিল একটি বিষয়।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এখনো নানা ধরনের বঞ্চনার মুখোমুখি হয়। অনেক সময় তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব কমই মিশতে পারে। সহায়ক কর্মী বা প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ার কারণে অনেকের শিক্ষাজীবনও সীমিত হয়ে যায়। এতে শিক্ষকেরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণে হিমশিম খেয়ে যান।

‘বিকল্প শিখনপদ্ধতি’র শিকড়

বিংশ শতাব্দীর শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্টেসরি (ইতালি), সেলেস্তাঁ ফ্রেনে (ফ্রান্স), পিটার পিটারসেন (জার্মানি) ও হেলেন পারখার্স্ট (যুক্তরাষ্ট্র) প্রবর্তিত শিক্ষা আন্দোলনগুলোই আধুনিক বিকল্প শিক্ষা মডেলের ভিত্তি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত, একঘেয়ে ও বর্জনমূলক শ্রেণিকক্ষ পদ্ধতির বিকল্প তৈরি করা, যেখানে শিশুর শেখার স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘গড় শিক্ষার্থী’ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রেণিকক্ষে বিকল্প শিখনপদ্ধতি প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও শেখার মান বাড়ে। এটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আরও পড়ুনকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে ব্রিটেনে কারিগরি শিক্ষার উত্থান০৬ ডিসেম্বর ২০২৫‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’: শিক্ষার্থীর হাতে নিয়ন্ত্রণ

এই আন্দোলনগুলো থেকে বিকশিত একটি পদ্ধতি হলো ‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’, যেখানে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। শিক্ষক (কখনো শিক্ষার্থীর সহযোগিতায়) সাপ্তাহিক পরিকল্পনা তৈরি করেন—যেখানে শেখার লক্ষ্য, করণীয় কাজ ও ধাপগুলো নির্ধারিত থাকে।

কানাডায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগ

অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ এক গবেষক নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্স রিজিওনাল এডুকেশন সেন্টারের শিক্ষক হ্যারিয়েট জনস্টনের সঙ্গে মিলে নবম ও একাদশ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।

প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সপ্তাহের শুরুতে একটি ফোল্ডার দেওয়া হয়, যেখানে নির্দিষ্ট কাজ ও কার্যক্রমের তালিকা থাকে। তারা নিজের মতো করে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারে—এককভাবে বা দলগতভাবে। সপ্তাহ শেষে কাজ মূল্যায়ন ও আলোচনা হয়।

এই পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি পাঠদান কমিয়ে ‘কোচ’ বা ‘মেন্টর’-এর ভূমিকা পালন করেন। এতে শিক্ষক একান্ত সহায়তার প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে পারেন।

ছবি: কবির হোসেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউটিউব দেখে মাশরুম চাষ, শাহজাদীর মাসে আয় ৩০ হাজার টাকা
  • ‘ইয়াকিন’ কীভাবে অর্জন করা যায়
  • একঘেয়ে পড়াশোনা থেকে মুক্তি: ‘উইক প্ল্যান’ পদ্ধতিতে মেলে সফলতা