নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে
Published: 27th, October 2025 GMT
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা যাতে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য রাজনৈতিক দল, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই নির্বাচন যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী তালিকায় যাতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, নারীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ থাকে এবং দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যাতে প্রান্তিক মানুষের কথা থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
আজ সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেছেন। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন: রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শিরোনামে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে একশনএইড বাংলাদেশ-এর সুশীল প্রকল্প ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সুশীল প্রকল্পের উদ্যোগে দেশের ৯টি জেলায় সংলাপ শেষে আজ এই জাতীয় গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। জেলার সংলাপগুলোয় স্থানীয় নাগরিকেরা সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে যেসব প্রত্যাশার কথা বলেছেন, বৈঠকের শুরুতে সেগুলো নিয়ে তৈরি করা একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের উইমেন রাইটস লিড মরিয়ম নেছা। একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
নতুন করে সংস্কার কমিশন করবে বিএনপিঅন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে সংস্কারের যেসব সুপারিশ এসেছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করে বিএনপি। গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে অনেকগুলো সুপারিশ এসেছে, সেগুলো নিয়ে আমরা সমৃদ্ধ হব। আরও অনেক বেশি সংস্কার আমাদের করতে হবে, রিকমেন্ডেশনস (সুপারিশ) নিতে হবে। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে নতুন করে কমিশন গঠন করা হবে। আমরা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব নেব।’
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন থাকবে না, আগামী নির্বাচন সে রকম হতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, সেই লক্ষ্যে বিএনপি ভূমিকা রাখবে। জনগণ বহু বছর পরে স্বাধীনভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এখানে জনগণই পাহারা দেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা বরং গৌণ হবে, মুখ্য হবে ভোটারদের ভূমিকা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বিচারকদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। বিএনপির অঙ্গীকার, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণভার, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা হবে। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন করার আগে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালত থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের ক্লিন (পরিষ্কার) করতে হবে।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন: রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সবার
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। সিইসির তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী যাত্রায় প্রবেশ করল।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জোয়াল ভেঙে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়ার যে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হবে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর ভাষণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। নির্বাচনের যে রোডম্যাপ তিনি ঘোষণা করেছেন, সে অনুযায়ী, ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এরপর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, বাছাই, আপিল নিষ্পত্তি শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ করা হবে আগামী ২১ জানুয়ারি। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী বুধবার দুপুরে বঙ্গভবনে নির্বাচন কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস, আইনবিধি সংস্কার, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ ও বড় কাজগুলো শেষ করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনসংক্রান্ত কেনাকাটা, পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর নিবন্ধন শেষ করেছে। বর্তমানে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের কাজ চলছে।
ইতিমধ্যে প্রশাসন ও পুলিশে বড় রদবদল হয়েছে। সব মিলিয়ে তফসিল–পূর্ব ইসির প্রস্তুতিকে সন্তোষজনকই বলা যায়। তবে আমাদের নির্বাচনী ইতিহাস বলে, তফসিল ঘোষণার পরই মূল চ্যালেঞ্জটা দেখা যায়। এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য নিয়ন্ত্রণও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সময় পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। পুলিশ এখনো পুরোপুরি আগের সক্রিয়তায় ফিরতে পারেনি। যদিও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীসহ সব কটি বাহিনীর প্রায় ৯ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ সংখ্যা নিশ্চিত করেই বিপুল কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁরা কতটা সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন, তা অনেকখানি নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিচক্ষণ ও বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নেওয়া সিদ্ধান্তের ওপর। ইতিমধ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে (আরপিও) সংশোধন আনা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে ক্ষমতায়িত হয়েছে। আমরা আশা করি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগে সাহসী ও নিরপেক্ষ থাকবে।
জাতি আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালেও যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না। পরপর তিনটি জালিয়াতির নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে শেখ হাসিনা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমেছিল। গত বছরের জুলাই ও আগস্টে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিন লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ নির্বাচনী যাত্রায় প্রবেশ করল। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
অর্থনীতি, বিনিয়োগ, জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সবকিছুর বিবেচনায় ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দায়িত্ব যেমন অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের, একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর। সশস্ত্র বাহিনীরও এ ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব রয়েছে বলে আমরা মনে করি।