নদী, পাহাড় শেষ হচ্ছে, তবু মামলা মোটে ৫ শতাংশ
Published: 28th, October 2025 GMT
চট্টগ্রামের প্রাণখ্যাত কর্ণফুলী নদী দখল-দূষণে দীর্ঘদিন ধরে মুমূর্ষু। বছরের পর বছর ধরে গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানার বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এই নদী। কর্ণফুলীর পানি ও পলিতে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ কণা খুঁজে পেয়েছেন একদল গবেষক। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত হুমকি বাড়ছে।
শুধু নদীর ওপর অত্যাচার চলছে এমন নয়, চট্টগ্রামের পাহাড়ও রক্ষা পাচ্ছে না। চার দশকে ২০০টির বেশি পাহাড়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে ১২০টি।
পাহাড়-নদীঘেরা চট্টগ্রাম মারাত্মক বায়ুদূষণের শিকার। দেশের জেলাগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত দূষিত জেলা হিসেবে চট্টগ্রামের নামও উঠে এসেছে বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের ২০২১ সালের সমীক্ষায়। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বায়ুমান ১৬৫ দশমিক ৩১ মাইক্রোগ্রাম, যেখানে আদর্শ মান ৬৫ মাইক্রোগ্রাম।
পাহাড়-নদীর ওপর এমন ‘অত্যাচারে’ একসময়ের সুন্দর ও নান্দনিক চট্টগ্রামের পরিবেশ আজ অনেকটাই বিপর্যস্ত। পরিবেশবিধ্বংসী কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কারাভোগের পরিবর্তে অর্থদণ্ড দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১ হাজার ৩২৩টি। এর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলা মাত্র ৭২টি, যা মোট মামলার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। বাকি মামলাগুলো ফৌজদারি ও দেওয়ানির। পরিবেশের মামলা কম থাকায় ফৌজদারি ও দেওয়ানির বিচারকাজও হয় পরিবেশ আদালতে।
পরিবেশবিষয়ক আইনজীবীদের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেই মামলা দেওয়া হয় কম। অধিদপ্তরের মামলার চেয়ে অর্থদণ্ডের দিকে ঝোঁক বেশি। আর পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষ বা সংগঠন সরাসরি মামলা করতে পারে না। আবার মামলা হলেও এগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। তবে অধিদপ্তরের দাবি, আগের তুলনায় মামলা বাড়ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কারাদণ্ড ও জরিমানা অথবা অর্থদণ্ড ও জরিমানা রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হবে, যাতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।পরিবেশ আদালত চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি হুমায়ুন রশিদ তালুকদারতিন বছরে মাত্র একটি মামলায় কারাদণ্ড
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে হওয়া মামলার বিচারকাজ চলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে। এ আদালতে চট্টগ্রামে তিন বছরে মাত্র একটি মামলার রায়ে কারাদণ্ড হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল এই রায় দেওয়া হয়। কক্সবাজার সদর থানার খুরুশকুল এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫–এর ১৫(১)–এর ৫ ধারায় ১১ আসামিকে দেড় বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৮ সালের এ মামলার সব আসামি পলাতক।
এদিকে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে অনেক মামলা। কক্সবাজারের ঝিলংজা এলাকায় পাহাড় কেটে বসতবাড়ি তৈরির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৭ জুলাই পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সদর থানায় ওয়াজেদ আলী নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট ওয়াজেদ আলীকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিদর্শক ফাইজুল কবির। কিন্তু চার সাক্ষীর কেউ আদালতে হাজির হননি।
পাহাড়-নদীর ওপর এমন ‘অত্যাচারে’ একসময়ের সুন্দর ও নান্দনিক চট্টগ্রামের পরিবেশ আজ অনেকটাই বিপর্যস্ত।অর্থদণ্ডে পার পান দোষীরা
পরিবেশ আদালত চট্টগ্রামে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৪টি; ২০২৪–এ ১০০টি এবং ২০২৩ সালে ৩০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব মামলার বেশির ভাগেই অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড অনাদায়ে কারাদণ্ড দেন আদালত।
রাউজানের ডাবুয়ায় সনাতন পদ্ধতির ১২০ ফুট চিমনি ব্যবহার করে ইট পোড়ানোর অভিযোগে ইটভাটামালিক সৈয়দ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল। গত ২৬ মে আসামি দোষ স্বীকার করলে আদালত তাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন। আসামি জরিমানা পরিশোধও করেন।
আইনজীবীরা জানান, অর্থদণ্ড হওয়ায় আসামিরা আপিল আদালতে আপিল করেন। অনেকে খালাস পান। আর রায় বহাল থাকলেও জরিমানা দিয়ে খালাস পান। কোনো সাজা ভোগ করতে হয় না।
পরিবেশ আদালত চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি হুমায়ুন রশিদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কারাদণ্ড ও জরিমানা অথবা অর্থদণ্ড ও জরিমানা রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হবে, যাতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতেও অর্থদণ্ড বেশি দেওয়া হয়। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে মামলা করা হয়েছে ১০টি। এসব মামলায় জরিমানা করা হয় ১ কোটি ৬ লাখ টাকা।
অবৈধ পলিথিন জব্দ, অবৈধ ইটভাটা, কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ, পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে পরিবেশদূষণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে দণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতে পরিবেশ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা মোট মামলার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ শুনে বিস্মিত হয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে যে পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়, নদী দখল, গাছ কাটা, শিল্পদূষণ হয়; তাতে কোনো অবস্থাতেই মামলার সংখ্যা এত কম হতে পারে না।
ভুক্তভোগীরা পরিবেশ আদালতে সরাসরি মামলা করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক বাধার সম্মুখীন হন জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, পরিবেশ আদালতকে এত দুর্বলভাবে গঠন করা হয়েছে, এখান থেকে যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যায় না বললে চলে। এ বাধা দূর করতে হবে। নইলে পরিবেশ বিনষ্টকারী শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র পর ব শ বছর র প র র পর
এছাড়াও পড়ুন:
দুবাই থেকে বিমানবন্দরে নেমেই উড়ালসড়কে অপহরণের শিকার প্রবাসী
হাসপাতালে শয্যাশায়ী অসুস্থ বাবাকে দেখার জন্য ছেলে ইমরান মুন্না ছুটে আসেন আরব আমিরাতের দুবাই থেকে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে নেমে বাড়ির উদ্দেশে ওঠেন সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। অটোরিকশাটি পতেঙ্গা উড়াল সড়কে ওঠার পর অস্ত্রের মুখে মুন্না ও তাঁর এক আত্মীয়কে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল এই ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে, তবে অপহরণকারী ব্যক্তিদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী সুলতান মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল পতেঙ্গা হলেও ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় উদ্ধার হন। সেখানে মামলা করার কথা বললে অপহরণের শিকার ইমরান রাজি হননি, তবে তাঁকে বুঝিয়ে মামলা করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নুর ইসলাম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ইমরান মুন্নার গ্রামের বাড়ি হাটহাজারী নজুমিয়াহাট এলাকায়। বিমানবন্দরে নেমে তিনি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় ওঠেন। সঙ্গে ছিলেন সুলাইমান নামের তাঁর এক আত্মীয়। তাঁদের বহনকারী অটোরিকশা শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়কে ওঠার পর একটি প্রাইভেট কার এসে গতি রোধ করে। এরপর দেশি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাঁদের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আতুরার ডিপো এলাকার একটি পরিত্যক্ত কটন মিলের ভেতরে নিয়ে যায়।
অপহরণের বিষয়টি গোপনসূত্রে জানতে পারে পতেঙ্গা থানা–পুলিশ। পরে বায়েজিদসহ বিভিন্ন থানায় বিষয়টি জানায় তারা। এরপর খবর পেয়ে বায়েজিদ থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে অভিযান চালায়। পুলিশ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে দেখে অপহরণকারী ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়। উদ্ধার করা হয় প্রবাসী মুন্নাকে। পরে তাঁর আত্মীয় সুলাইমানকেও পাওয়া যায়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় প্রবাসীর লাগেজও।
অভিযানে থাকা বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই মোহাম্মদ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, দুই ভুক্তভোগী ও অটোরিকশাচালকের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত থানায় বোঝানো হয়। কিন্তু তাঁরা কিছুতে মামলা করতে রাজি হচ্ছেন না।
প্রবাসী ইমরান মুন্নার মুঠোফোনে রাতে যোগাযোগ করা হলে এই বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।