আরিচা-খয়েরচর নৌরুট ‘সম্ভাবনার দুয়ার’
Published: 28th, October 2025 GMT
এক সময়ের দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম নৌরুট আরিচা-কাজিরহাট। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট চালু হওয়ার পর এই নৌরুট দেড় যুগ বন্ধ থাকে। ২০২১ সালে নৌরুটটি পুনরায় চালু হলেও আগের অবস্থা ফিরে পায়নি। তবে এখনও আরিচা-খয়েরচর নৌরুট দুই পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে সম্ভাবনার দুয়ারের আলো দেখাচ্ছে।
প্রকল্পের তথ্য বলছে, মানিকগঞ্জ জেলার আরিচা ঘাট থেকে পাবনা জেলার খয়েরচর (খাসেরচর) পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাবে এবং সময় কম লাগবে। বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যমুনা সেতু হয়ে পাবনার দূরত্ব প্রায় ২৩৩ কিলোমিটার। কাজিরহাট-আরিচা নৌপথে এ দূরত্ব মাত্র ১৪৭ কিলোমিটার। এই নৌপথে ১৭ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট এবং কাজিরহাট থেকে আরিচা আসতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট। সময় বেশি লাগায় অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দ্রুতগতির স্পিডবোটে যাতায়াত করছেন। একটি ‘রো রো’ ফেরিতে প্রতি ঘণ্টায় জ্বালানি খরচ হয় ১২৯ লিটার এবং ছোট ফেরিতে ১২৮ লিটার। যদি আরিচা-খয়েরচর ঘাট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে দূরত্ব কমে আসবে ১০ কিলোমিটার এবং জ্বালানি খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে ঢাকা-আরিচা সড়ক চালু হওয়ার পর আরিচা থেকে যমুনা পাড় হয়ে নগরবাড়ি এবং আরিচা থেকে যমুনা-পদ্মা পাড় হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের সঙ্গে চালু করা হয় ফেরি সার্ভিস। এতে আরিচা-নগরবাড়ি হয়ে ওঠে উত্তরবঙ্গ এবং আরিচা-গোয়ালন্দ হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান পথ। ১৯৬৩ সালে ৩১শে মার্চ কর্ণফুলি নামে একটি ফেরি সার্ভিস দিয়ে আরিচা দৌলতদিয়া নৌরুটের যাত্রা শুরু হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়া পর দ্রুত বাড়তে থাকে আরিচা ঘাটের গুরুত্ব। এক পর্যায়ে আরিচা ঘাটকে নৌবন্দরের মর্যাদা দেয়া হয়। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার যানবাহন পারাপার হতো। যাতায়াত ছিল গড়ে ৫০ হাজার মানুষের। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। তার ওপর আরিচা ঘাটের কাছে যমুনা নদীতে নাব্যতাও কমতে থাকে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০০১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি আরিচা ফেরি ঘাট নিয়ে যাওয়া হয় পাটুরিয়াতে। এরপরই এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আরিচা ঘাট তার ঐতিহ্য হারায়। শুধু রয়ে যায় কিছু লঞ্চ আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বন্ধ হয়ে যায় শত শত হোটেল-রেস্টুরেন্ট। ধস নামে বোর্ডিং ব্যবসায়। বেকার হয়ে পড়ে ঘাটের শ্রমজীবী মানুষ।
বিআইডব্লিউটিএর আরিচা কার্যালয় জানায়, উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০২৪ সালের ৯ জুন একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রস্তাবটিতে খয়েরচর (খাসেরচর) এলাকায় ৪টি ফেরিঘাট, ১টি লঞ্চঘাট ও ১টি স্পিডবোট ঘাট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি সেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, টার্মিনালসহ একাধিক উন্নয়ন কাজের প্রস্তাব রয়েছে। কাজের জন্য ১১০ কোটি টাকার বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাবনা জেলার বাসিন্দা ব্যবসায়ী কাইয়ুম পোদ্দার বলেন, ‘‘আমাদের যাতায়াতে অনেক সময় লাগে। আরিচা-কাজিরহাট ফেরি পার হতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। ব্যবসায়িক কাজে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা যেতে হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। যদি খয়েরচরে ঘাট হয়, তাহলে আমাদের কষ্ট অনেকটাই কমে যাবে।’’
পাবনা জেলার ট্রাকচালক জামাল মোল্লা বলেন, ‘‘আরিচা-কাজিরহাট ফেরি পার হতে অনেক সময় লাগে। যদি আরিচা-খয়েরচর ঘাট হয়, তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হবে, তাড়াতাড়ি নদী পার হতে পারব।’’
মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার আরিচা এলাকার বাসিন্দা সুমন মিয়া বলেন, ‘‘এক সময় আমাদের এই আরিচা ঘাট ছিল খুব জমজমাট। ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসা করে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। যদি আরিচা-খয়েরচর ঘাটটি হয়, তাহলে ঘাট আবার সেই আগের রূপে ফিরে আসবে। এই ঘাট আমাদের স্বপ্ন।’’
সামাজিক সংগঠন ‘জনস্বার্থে আমরা’র সভাপতি কলেজ শিক্ষক ইয়াসিনুর রহমান বলেন, ‘‘আরিচা-খয়েরচর নৌরুট প্রকল্প বাস্তবায়নের আশায় নতুন স্বপ্নে বিভোর পদ্মা-যমুনা নদীর দুই তীরের বাসিন্দারা। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শুধু নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই হবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মো.
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) আব্দুল সালাম বলেন, ‘‘আরিচা-খয়েরচর ঘাট দিয়ে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৬টি জেলার মানুষ সহজে যাতায়াত করতে পারবে। পাশাপাশি যমুনা সেতু ও রেল সেতুর ওপর চাপও অনেকটা কমে যাবে।’’
ঢাকা/তারা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রস ত ব ক জ রহ ট রচর ঘ ট ব যবস থ প রকল প আম দ র প র হত র আর চ
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন রূপে নদীপথে ফিরছে শতবর্ষী স্টিমার পি এস মাহসুদ
শুক্রবার সকাল ১০টা। ঢাকার সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনের সামনে বেশ জটলা। সবার চোখ শতবর্ষী স্টিমার পি এস মাহসুদের দিকে। কারও চোখে পুরোনো স্মৃতি, কারও চোখে উচ্ছ্বাস। নদীকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক পি এস মাহসুদ তিন বছর পর আবার ঢাকার নদীপথে ফিরছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) জানিয়েছে, আগামী ১৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চলাচল শুরু করবে এই ঐতিহাসিক জলযান। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতি শুক্রবার সকালে ছেড়ে যাবে বরিশালের উদ্দেশে। পরদিন শনিবার আবার ফিরবে ঢাকায়। যাত্রাপথে পর্যটকেরা উপভোগ করবেন নদী আর দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
পি এস মাহসুদ ১৯২২ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে নির্মিত হয়। বেলজিয়ামের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিমিটেডের মাধ্যমে স্টিমারটির স্টিম ইঞ্জিনকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালে মেকানিক্যাল গিয়ার সিস্টেমে রূপান্তর করা হয়।
পি এস মাহসুদে জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া, ফায়ার এক্সটিংগুইসারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। পি এস মাহসুদ শতবর্ষ ধরে নৌপথে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া নিরাপদভাবে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রী ও পর্যটনসেবা দিয়ে আসছে।
ঢাকা থেকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে চলাচল করত স্টিমারটি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রীর অভাবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে স্টিমারটির চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিন বছর ধরে অচল থাকা প্যাডেল স্টিমারটিকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এর সংস্কারকাজ করা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিসি জানিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার স্টিমারটির ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে পরীক্ষামূলক যাত্রা শেষে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পি এস মাহসুদ কেবল একটি নৌযান নয়, এটি বাংলাদেশের নদীজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। আমরা চাই, নতুন প্রজন্ম কাছ থেকে দেখুক, একসময় নদীপথই ছিল যোগাযোগ ও সংস্কৃতির প্রাণ।’
উপদেষ্টা জানান, পি এস মাহসুদের পাশাপাশি আরও তিনটি পুরোনো স্টিমার—পি এস অস্ট্রিচ, পি এস লেপচা ও পি এস টার্ন সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নদীপথের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও নদীভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনা বিস্তৃত করার লক্ষ্যে এটা করা হবে।
শতবর্ষী স্টিমার পি এস মাহসুদ তিন বছর পর আবার নদীপথে যাত্রী পরিবহন শুরু করছে। গতকাল শুক্রবার সদরঘাটে