গুমের মামলায় শুধু সেনা কর্মকর্তাদের আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন তাঁদের আইনজীবীর
Published: 14th, December 2025 GMT
র্যাবে পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা কাজ করলেও গুমের মামলায় শুধু সেনা কর্মকর্তাদের আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী তাবারক হোসেন। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাত করেছেন বলে তাঁর অভিযোগ।
আওয়ামী লীগ আমলে র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুমের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আজ রোববার শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে তাবারক হোসেন সাংবাদিকদের কাছে এই বক্তব্য দেন, যা শুনানিতে তুলে ধরেছেন বলে জানান তিনি।
গুমের এই মামলার ১৭ আসামির মধ্যে যে ১০ জন গ্রেপ্তার আছেন, তাঁরা সবাই সেনা কর্মকর্তা। র্যাবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) এবং ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) শাখার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তারা। এই ১০ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ৭ জনের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাবারক হোসেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেছেন, এ মামলায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘হ্যান্ডপিক’ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা এখানে বায়াসড (পক্ষপাতদুষ্ট) ছিলেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, র্যাবের এডিজি (অতিরিক্ত মহাপরিচালক–অপারেশন্স) বিভিন্ন সময়ে বিদেশে গিয়েছেন। তখন বিভিন্ন সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পুলিশের একজন ডিআইজি সেই এডিজির দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সেসব পুলিশ কর্মকর্তার একজনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়নি। তাহলে কি সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে না যে শুধু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের বহু অভিযোগ ওঠে। গত বছর অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। র্যাবের টিএফআই সেলে গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটিতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি করা হয় ১৭ জনকে।
তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার ১০ জন সেনা কর্মকর্তা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.
আইনজীবী তাবারক হোসেন বলেন, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের কাজ বুঝতে হবে। র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন। প্রতিটি ব্যাটালিয়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তাদের কাজের সঙ্গে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা এমন কথা বলেছেন জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, তিনি গুম কমিশনের একটি কথাও ট্রাইব্যুনালের নজরে এনেছেন। গুম কমিশনের কাজ পুলিশিং করা নয়। গুম কমিশনের কেউ যদি নিয়মনীতিবহির্ভূতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন, ট্রাইব্যুনালকে সেই জিনিসটার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ গণমাধ্যমে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করেন, তা নিয়েও আদালতে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী তাবারক হোসেন। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন গণমাধ্যমে বলে ‘পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি’ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের কথা ট্রমা তৈরি করে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে।
এ মামলায় প্রসিকিউশন ১ হাজার ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি নথিপত্র দিয়েছে জানিয়ে আইনজীবী তাবারক বলেন, প্রসিকিউশন এত ডকুমেন্টস দিয়েছে। সেসব দেখে তাঁর ডিফেন্স (আত্মপক্ষ) প্রস্তুতি নিতে হবে। সে জন্য তিনি তিন মাস সময় চেয়েছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ আজ মামলাটির শুনানি হয়। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলার ১৭ আসামির অব্যাহতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। এরপর আদালত এই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে বিষয়ে ২১ ডিসেম্বর আদেশ দেওয়ার দিন ধার্য করেন।
গুমের ঘটনায় দুটি মামলার বিচার হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। অন্যটিতে আসামি ১৩ জন। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) গুম করে রাখার ওই মামলার আসামিদের মধ্যে ১০ জন পলাতক। গ্রেপ্তার আছেন তিন সেনা কর্মকর্তা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক তিন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র ত ব রক হ স ন র আইনজ ব অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে আরও এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে মারধর, অপহরণচেষ্টা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আজ রোববার বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান গ্রেপ্তার আবেদন মঞ্জুর করেন। পরে এ মামলায় তুরিনের পক্ষে জামিন শুনানি করেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন।
শুনানিতে আইনজীবী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁর (তুরিন আফরোজ) বিরুদ্ধে বারবার মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের হত্যা ও হত্যাচেষ্টা এবং সর্বশেষ আজ অপহরণ ও মারধরের অভিযোগে মোট ছয়টি মামলা হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আজ সকালে তুরিন আফরোজকে আদালতে এনে হাজতখানায় রাখা হয়। হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আদালতের উদ্দেশে হাজতখানা থেকে বের করা হয়। এ সময় তাঁর দুই পাশে দুই হাত ধরে রাখেন পুলিশের নারী সদস্যরা। সামনে ও পেছনে ছিলেন ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য। নবম তলার ৩২ নম্বর আদালতে তোলার সময় তাঁকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। আদালতের কাঠগড়ায় তোলার সময় তাঁর মাথার হেলমেট খুলে রাখা হয়। বিচারের জন্য অপেক্ষাধীন থাকা অবস্থায় আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
পরে জানানো হয়, ৩৩ নম্বর আদালতে শুনানি হবে। আবারও হেলমেট ও জ্যাকেট পরিয়ে ৩৩ নম্বর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী হাসিখুশির কারণ জানতে চেয়ে দূর থেকে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব দেননি। পরে আদালতে তুরিন আফরোজকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়।
পরে বিচারকের অনুমতি নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বারবার মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। এ মামলার অভিযোগ ২০২২ সালের। অভিযোগ আনা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রভাব খাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি ২০১৯ সালে ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিন বছর পর কীভাবে তিনি প্রভাব খাটাবেন? তখন তো তাঁর হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই।
আইনজীবী বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা। হয়রানি করার জন্য মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। তিনি অসুস্থ, জামিন পেলে পলাতক হবেন না। যেকোনো শর্তে তাঁর জামিন আবেদন করছি।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, তুরিন আফরোজ বাদীর কাছ থেকে ৭৮ লাখ টাকায় দুটি বাস কিনেছেন। কিন্তু সব টাকা পরিশোধ না করে বাস নিয়ে যান। বাকি টাকা চাইতে গেলে তুরিন আফরোজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রভাব খাটিয়ে বাদীকে হুমকি দেন এবং বাদীর বাসায় গিয়ে ভাঙচুরের পর তাঁর মেয়েকে অপহরণের চেষ্টা করেন। ২০২২ সালে মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেয়নি। পরে তিনি আদালতে মামলা করেন।
শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই দুটি বাস কেনার জন্য বাদীর সঙ্গে ৭৮ লাখ টাকার চুক্তি করেন আসামি তুরিন আফরোজ। এরপর আসামি ৪৮ লাখ টাকা পরিশোধ করে অবশিষ্ট টাকা ২৪ মাসের মধ্যে পরিশোধ করবেন বলে বাস দুটি নিয়ে যান। পরে আসামি কোনো কিস্তির টাকা পরিশোধ না করে বাদীকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেন এবং মারধর করে পেশার প্রভাব দেখান।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল বাদী আসামির কাছে আবার টাকা চাইলে আসামির নির্দেশে ২৫ থেকে ৩০ জন অজ্ঞাতানামা সন্ত্রাসী বাদীর বাসায় গিয়ে বাদীকে অস্ত্রের মুখে মারধর করেন এবং বাদীর সাত বছরের কন্যাসন্তানকে অপহরণের চেষ্টা করেন। ওই সময় বাদী ৯৯৯–এ কল দিলে পুলিশের উপস্থিতিতে বাদীর কন্যাসন্তানকে বাসার বাইরে রেখে যান।
ওই ঘটনায় ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল নাবিশা এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা মনজুর আলম নাহিদ বাদী হয়ে অপহরণচেষ্টা, মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে আদালতে মামলাটি করেন।
গত ৭ এপ্রিল রাতে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের বাসা থেকে তুরিন আফরোজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাঁর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত। এর পর থেকে তিনি কারাগারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রসিকিউটরের দায়িত্বে ছিলেন তুরিন আফরোজ।