পাপড়ি রহমান একাধারে কথাশিল্পী, সম্পাদক, গবেষক এবং অনুবাদক। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন ‘খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’। ২০২৫ বইমেলায় পাপড়ি রহমানের একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পের বই প্রকাশ হচ্ছে। নতুন বইয়ের প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন পাপড়ি রহমান। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।

রাইজিংবিডি: বইমেলা ২০২৫ প্রকাশতিব্য উপন্যাস ' ঊষর দিন, ধূসর রাত'—এর প্রেক্ষাপট জানতে চাচ্ছি।
পাপড়ি রহমান:
যারা আমার পাঠক, তারা কিন্তু জানেন যে, আমি প্রান্তিক জনজীবন নিয়েই লিখি বা লিখতে ভালোবাসি, স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বরাবরই। অধ্যাপক ড.

আকরম হোসেন একদিন বললেন যে, তুমি সারাজীবন শহরে বসবাস করলে, তোমার কলমে একটা নাগরিক উপন্যাস চাই। তুমি কি লিখবে না নাগরিক জীবন নিয়ে? অধ্যাপক ড. ভীষ্মদেব চৌধুরীও আকরম স্যারের কথায় সায় দিলেন। সেই থেকে শুরু হলো আমার প্রস্তুতি। কিন্তু বড় কঠিন ছিল এই কর্ম। কী লিখব আমি? যে সময়ে আমি লিখতে শুরু করলাম এই উপন্যাস,  তখন তো কারোর বাক স্বাধীনতাই নেই। গণতন্ত্রের নামে চলছে সার্কাস। গুম-হত্যা-খুন আর একনায়কের স্বেচ্ছাচার। এসবের মাঝে ঢাকা শহরের মানুষ, তাদের টানাপোড়েন, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি, কুটনীতি, নিউক্লিয়ার ফ্যামেলিগুলির তীব্র ক্রাইসিস, ভেঙেপড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে লড়াই এসব নিয়ে লেখা বড় মুশকিল ছিল। তবুও যতোটা এবস্ট্রাকট ফর্মে লেখা যায়, লিখতে শুরু করলাম। টানা দুই বছর লিখে গেলাম। তারপর একবছর ক্রমাগত কাটাছেঁড়া করতে করতে জুলাই বিপ্লবের আগে শেষ হলো লেখা। এবং এ বছর বইটা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রকাশ করলো ‘বেঙ্গল পাবলিকেশন্স’।
আমি চেষ্টা করেছি অন্যরকম জীবন নিয়ে লিখতে। রাজনৈতিক বিষয়াদি অত স্পষ্ট করে বলা না গেলেও টাচ করে গিয়েছি। ইঙ্গিত দিয়েছি। মানুষের মনের চেতনার গভীর স্তরগুলি অনুসন্ধান করতে চেয়েছি। জানিনা কী পেরেছি, কতোটা পেরেছি? আমার পাঠক ও শিক্ষকেরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা নিশ্চিত করে বলছি, এই ঢাকাশহরের বাস্তব জীবনের গল্পগুলোই বলার চেষ্টা করেছি আমি। পাঠক, প্রতিটি চরিত্রকে চিনতে পারবেন। একই সঙ্গে চমকেও উঠবেন হয়তো । 

রাইজিংবিডি: 'হেমন্তের দিনে' গল্পগ্রন্থটি কী ধরনের গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে। 
পাপড়ি রহমান:
আমি চাই পাঠক আমার লেখায় ডাইভার্সিটি খুঁজে পাক। গত ৫ বছরে লেখা ৫ গল্প আর ৯৫/২০০১/২০০৩ এর তিনটি গল্প মোট ৮ গল্প নিয়ে এ বই। মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমি খুব অল্প লিখেছি। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে ও যত্ন নিয়ে লিখতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য যেমন গৌরবের, তেমনি খুবই সেনসেটিভ ইস্যু। এই বইতে একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে। প্রেম ও প্রতারণার গল্প আছে। ঢাকাশহরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের গল্প আছে। প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধের গল্প আছে। ৫ বছর বাদে প্রকাশিত হলো আমার নতুন কোনো গল্পগ্রন্থ। প্রকাশ করেছে ‘ঐতিহ্য’। 

আরো পড়ুন:

হাজারমুখীরা আমাদের চারপাশেই থাকে: কাজী লাবণ্য

‘বিশ্বের বিভিন্ন অনুবাদ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে আমরা পিছিয়ে আছি’

রাইজিংবিডি: আপনিতো গল্প এবং উপন্যাস দুই’ই লেখেন। একযোগে গল্প এবং উপন্যাস লেখার কাজ কীভাবে এগিয়ে নেন।
পাপড়ি রহমান:
হ্যাঁ, আমি গল্প ও উপন্যাসেই কাজ করি। এর বাইরে সম্পাদনাও করি। বা করেছি।কিন্তু কে বললো আমি একযোগে লিখি? উপন্যাস লিখবার সময় আমি অন্য যেকোন লেখা থেকে বিরত থাকি। বিরত থাকতে চাই। এই উপন্যাসটি আমার চতুর্থ উপন্যাস 'নদীধারা আবাসিক এলাকা' প্রকাশের ৬ বছর পর বেরুলো। আর গল্প নিয়ে তো বললামই। বই করার মতো গল্প গুছাতে বছর পাঁচেক লেগে যায়। তবে এ বছর মিরাকল ঘটলো,  আমার নতুন উপন্যাস ও নতুন গল্পের বই একই মেলায় প্রকাশিত হলো।

রাইজিংবিডি: আপনার গল্প সাধারণত গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে, আপনার বেড়ে ওঠা শহরে, গ্রামকে এতো ভালো উপলব্ধি কীভাবে করতে পারেন?
পাপড়ি রহমান:
আমার শৈশব কিন্তু গ্রামে কেটেছে। মুক্তিযুদ্ধের আগের বছরগুলি। গ্রামের ওই মাটি আমাকে আজও টানে। বা মায়ামমতায় ভরা আমার দাদার বাড়ির পারিবারিক পরিবেশ। বা ওই পুকুর, গুল্ম, ধানক্ষেত, শীতকাল মানেই পিঠাপুলির ধুম। সেই পিঠা শরীকদের সবার ঘরে পৌঁছে দেওয়া। তবে গ্রাম বা শহর এখানে ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হলো আমি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছাড়া কিছুই প্রায় লিখিনা। বা লিখতে পারিনা। এটা আমার এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও বলতে পারো।

রাইজিংবিডি: অনেকেই বলেন পাপড়ি রহমানের বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া উচিত, ‘না প্রাপ্তি’ কে কীভাবে দেখেন?
পাপড়ি রহমান:
কোনো পুরস্কার কি উত্তম সাহিত্য সৃষ্টি করে? নাকি উত্তম সাহিত্যকে পুরস্কৃত করা হয়? পুরস্কার যদি উত্তম সাহিত্য সৃষ্টিতে অবশ্যম্ভাবী না হয়, তাহলে একজন লেখকের জন্য পুরস্কারের প্রয়োজন কী? এখানে কে ধন্য হয়? লেখক নাকি পুরস্কার?  কত নোবেল লরিয়েট, কত রাস্ট্রীয় পুরস্কার বাহকেরা তল্পিতল্পাসহ কে কোথায় হারিয়ে গেল, তার ইয়াত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে টেক্সটই তো, নাকি? পাঠক পুরস্কার মনে রাখে না, মনে রাখে একজন লেখকের কাজ। কবি জীবনানন্দ দাশ কয়টা পুরস্কার পেয়েছিলেন? কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির মৃত্যুর আগে পুরস্কৃত হননি, কিন্তু পুরস্কারের না পাওয়ার কারণে কি উনার লেখা থেমে ছিল? বা উনার লেখার মান ক্ষুন্ন হয়েছিল? ‘ডলু নদীর হাওয়া’ বা ‘ডুমুর খেকো মানুষ’এর কথা সাহিত্যপ্রেমীরা আজীবন স্মরণ রাখবে। তবে আরেকটি কথা, আমাদের এখানে পুরস্কার পাওয়ার জন্য যে যে যোগ্যতা লাগে, তা বোধ করি আমার নেই। এবং এই  'না প্রাপ্তি' কিন্তু এক ধরনের প্রাপ্তিই। এই 'না প্রাপ্তির' জন্যই হয়তো মনে হয়, লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল। 

রাইজিংবিডি: বাংলাদেশের ছোটগল্প সম্পাদনা করেছেন আবার এলিস মানরোর ছোটগল্পও সম্পাদনা করেছেন। হাসান আজিজুল হক, মানিক বন্দোপাধ্যায়দের গল্পকে দেখিয়েছেন মানরোর গল্পের সমান্তরালে। তার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশের ছোটগল্পের মান কোনো অংশেই কম নয় কিন্তু বিশ্ব দরবারের নানাভাষী পাঠকদের কাছে উল্লেখযোগ্যভাবে পৌঁছাতে পারছে না কেন?
পাপড়ি রহমান:
এটা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছি। বিদেশি সাহিত্যের তুলনায় বাংলাসাহিত্যের মান কোনোভাবেই নগন্য নয়। কেন বা কীভাবে পৌঁছাবে আমাদের লেখা বিশ্বের কাছে? যদি সেভাবে অনুবাদ না হয়? অনুবাদে জোর দিতে হবে। বাংলা একাডেমি কি করে এ বিষয়ে? আমাদের ক্ল্যাসিকগুলি উত্তম অনুবাদে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেয়াটা বাংলা একাডেমির দায়িত্বের মাঝেই পড়ে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি বই ছাড়া তেমন কোনো অনুবাদের কথা তো শুনিনি। বা দেখিনি। 

রাইজিংবিডি: প্রকাশনীগুলির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? কোন কোন প্রকাশক ঠিকঠাকমতো রয়্যালিটি প্রদান করেছেন?
পাপড়ি রহমান:
এ ক্ষেত্রে মিশ্র  অভিজ্ঞতা আছে। কেউ কেউ সঠিক তথ্য গোপন করে বলেন, আপনার বই তো চলেই না। ১৭ বছর ধরে প্রথম মুদ্রণের বই-ই উনারা দেদারসে বিক্রি করছেন। লামছাম রয়্যালিটি বুঝিয়ে দিয়ে বাকী বইয়ের হিসাবই আর দেননি আমাকে। বা দ্বিতীয় মুদ্রণ বা তৃতীয় মুদ্রণ এটা জানানো দূরে থাকুক।আবার কোনো কোনো প্রকাশক বাসায় এসে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে সম্মানী দিয়ে গেছেন। কেউ কেউ বলছেন, আপা, এই বইটিও শেষ হবার পথে, দ্বিতীয় মুদ্রণে যেতে হবে অচিরেই। একটা বইয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় মুদ্রণ কি লেখক ও প্রকাশকের জন্য আনন্দের নয়? তাহলে অযথা এসব কারচুপির মানে কী? আর একজন লেখককে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে। লেখকের প্রাপ্য পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দিতে হবে। তেমনি একজন লেখকও তার প্রকাশককে সম্মানিত মনে করবে।বিষয়টি কিন্তু পারিবারিক বন্ধনের মতো হওয়া উচিত। কিন্তু এই প্রকাশনার জগত আজব ভেলকির জায়গা। অন্য সবকিছুর মতো দলাদলিটাও এখানে ভালোভাবেই চলে। বা লেগপুলিং। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকেই এমন বলছি। 

রাইজিংবিডি: কেমন বইমেলা চান?
পাপড়ি রহমান:
বইমেলা যেন বইমেলাই হয়, বাণিজ্য মেলা না হয়ে ওঠে। ধুলাবালি মুক্ত, নতুন বই আর নতুন লেখকদের ভিড় আর প্রাণচাঞ্চল্য ভরপুর মেলা চাই। নতুন লেখক, নতুন লেখা না এলে চলবে নাকি? আমাদের জীবন তো সায়াহ্নে পৌঁছে গেছে। আর আমি কিছুই কুক্ষিগত করে রাখতে চাইনা। রাখিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আঁধারে। 
একেবারে সদ্য তরুণটির উজ্জ্বল মুখচ্ছবি মেলায় দেখতে চাই। তরুণদের লেখা বিমুগ্ধ হয়ে পড়তে চাই। এতসব প্রশ্ন করে আমাকে অনেক কথা বলতে দেওয়ার জন্য তোমাকে আন্তরিক ভালোবাসা ও ধন্যবাদ জানাই।

ঢাকা/লিপি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপন য স কর ছ ন র জন য জ বন ন বইম ল রহম ন

এছাড়াও পড়ুন:

এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা

জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।

১. এটাই জান্নাতের পথ

এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।

আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি

বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।

তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’

এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।

৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট

মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?

এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।

৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা

পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।

৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়

৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।

আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫

৭. পালিয়ে যাওয়া

ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।

৮. সহনশীলতার খেলা

পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।

৯. অস্বস্তিকর আলাপ

মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।

১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা

পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।

১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা

গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

১২. নিয়তের পবিত্রতা

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)

যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।

১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা

পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬

১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন

একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)

এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম

১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা

চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’

এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’

১৬. মায়ের শক্তি

আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।

১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত

আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।

১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট

পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।

২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব

এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক

আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খামেনিকে হত্যায় ইসরায়েলি পরিকল্পনা আটকে দেন ট্রাম্প
  • সাংবাদিক পরিচয়ে গেস্ট হাউসের কক্ষে কক্ষে তল্লাশি, দম্পতির কাছে বিয়ের প্রমাণ দাবি
  • ডেঙ্গু-করোনায় দুই মৃত্যু, আক্রান্ত ২৭৫ জন
  • চলতি মাসের ১৫ দিনে করোনায় ৪ জনের মৃত্যু
  • গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে প্রপাগান্ডার সয়লাব
  • কারাগারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ১
  • রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
  • গুম করা হতো তিনটি ধাপে 
  • এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা