দশ মন্ত্রণালয়ের ৬১% কাজ পেয়েছে ৫% ঠিকাদার: টিআইবি
Published: 25th, February 2025 GMT
আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তি—এই ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি কেনাকাটার বাজার দখল হয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারই মোট চুক্তিমূল্যের ৬১ শতাংশ কাজ পেয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য: একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, গবেষক দলের সদস্য সহকারী কো-অর্ডিনেটর রিফাত রহমান ও কে এম রফিকুল আলম।
টিআইবির গবেষণায় ২০১২-২৪ সময়ে দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মোট ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৪টি কেনাকাটা কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তিমূল্যের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ কাজ পেয়েছে। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারত্ব সব মন্ত্রণালয় মিলিয়ে ১ শতাংশের কম।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে।
টিআইবির গবেষণা অনুসারে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার এক দশকে তাঁদের বাজার অংশীদারত্ব বাড়িয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৩৫ জন ঠিকাদারই প্রায় ৭৩ শতাংশ বাজার দখল করেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩৮ জন ঠিকাদার প্রায় ৩১ শতাংশ; গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৮১ জন ঠিকাদার ৩২ শতাংশ; স্থানীয় সরকার বিভাগে ২৯৪ জন ঠিকাদার প্রায় ২৮ শতাংশ বাজার দখল করেছে।
টিআইবি বলেছে, বাজার দখলের পেছনের কারণ হলো, শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠন করে বড় প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগে ৯টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। একইভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১২টি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১১টি ঠিকাদারি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি কেনাকাটা খাত সারা বিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারত্বের হাতে জিম্মিদশায় নিমজ্জিত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি; বরং ইলেকট্রনিক উপায়ে কেনাকাটাব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে বাজার দখল আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কর্তৃত্ববাদ–পরবর্তী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে।
টিআইবি এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন নিশ্চিতে ছয় দফা সুপারিশ করেছে। সংস্থাটির সুপারিশমালার মধ্যে অন্যতম হলো বাজার দখল ঠেকাতে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ; সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রতিযোগিতামূলক আইন প্রণয়ন ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের কার্যক্রম সীমিতকরণ; বাজারে একচ্ছত্র ব্যবস্থার বদলে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি; যে চুক্তিগুলো ই-প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় হয়নি সেগুলোকে দ্রুত ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জন ঠ ক দ র ব জ র দখল র জন ত ক ট আইব র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বড় বন্দরে ভারী কাজ করেও চলে না সংসার
দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি হয় চট্টগ্রামে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর দিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি হওয়ার পর সেগুলো বিভিন্ন লাইটার জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন ঘাট হয়ে গুদামজাত হয়। এরপর সেখান থেকে যায় বিভিন্ন বাজারে। লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত শত শত শ্রমিক দিন রাত পরিশ্রম করেন। তারপরও কষ্টে চলে তাদের সংসার।
চট্টগ্রাম মহানগরীর মাঝিরঘাট এলাকায় ১৭টি ঘাটে আমদানি পণ্য খালাস হয়। আর এসব খালাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ৪ হাজার ঘাট শ্রমিক। এই শ্রমিকরা পালাক্রমে কাজ করেন ঘাটে। দিন-রাত হাড় ভাঙা খাটুনির পরও দিন যায় কষ্টে। সময়ের সঙ্গে তাদের শ্রমের মূল্য বাড়লেও তা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়।
চট্টগ্রাম গুদাম ও ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আবদুল খালেক রাইজিংবিডিকে বলেন, “প্রতি বছর মে দিবসে অনেকেই আমাদের স্মরণ করেন। কিন্তু বছর জুড়ে আমাদের অবহেলা আর বঞ্ছনার জীবন। সারা দিন কাজ করে ঘাট শ্রমিকরা ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকে। কিন্তু এর বিনিময়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ভারী বস্তা বহন করে শ্রম দিতে হয়। কখনো কখনো এই পারিশ্রমিকও জোটে না। আবার সব শ্রমিকের প্রতিদিন কাজও জোটে না।”
ঘাট শ্রমিক আবদুল মতিন জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘাটে আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, গম, সার, চিনি, সাদা মটর, পাথর, কয়লা, ফ্লাইঅ্যাশ, বল ক্লে, লাইম স্টোন, জিপসাম, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী পণ্য। এসব পণ্য মাদার ভেসের থেকে লাইটার জাহাজে খালাসের পর মাঝিরঘাটের বিভিন্ন গুদামে আনা হয়। সেখান থেকে শ্রমিকরা খালাস করে বিভিন্ন ট্রাকে লোড করেন, আবার ট্রাক থেকে বিভিন্ন গুদামে মজুদের জন্য আনলোড করেন। প্রতিদিন একজন শ্রমিক একশ’ দেড়শো বস্তা পর্যন্ত পণ্য বহন করেন। ভোর ৬টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা ভারী পণ্য বহনের এসব কাজ করেন। এতে তাদের দৈনিক মজুরি মিলে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা।
মনিরুল মোল্লা নামে আরেক শ্রমিক রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমরা দিনে হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পেলেও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বস্তা বহন অতি পরিশ্রমের কাজ। এ জন্য আমাদের অনেক খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। প্রতিদিন একজন শ্রমিকের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করতে হয় খাওয়ার পেছনে। এতে দিনের আয়ের অর্ধেক চলে যায়। বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে ৫-৬ জন সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। পরিবার সন্তানদের জন্য মাসে এক দুই বার মাছ মাংস খাওয়া সম্ভব হয় না।”
আবদুল সবুর নামের অপর একজন ঘাট শ্রমিক রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমাদের শ্রমে-ঘামে দেশের আমদানি রপ্তানি বড় কার্যক্রম চলে চট্টগ্রামে। কিন্তু আমাদের জীবন চলে অনেক কষ্টে। অসুস্থ হলে কাজ জোটে না, খাবার জোটে না। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন।”
ঘাট শ্রমিক ফরিদুল মোস্তফা বলেন, “৪ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার। প্রতিদিন যা আয় করি তার অর্ধেক চলে যায় ব্যক্তিগত খরচে। বাকি অর্ধেক দিয়ে পুরো সংসার চালাতে হয়। জিনিসপত্রের যা দাম অর্ধেক আয় দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিন বেলা খাওয়াও কষ্ট।”
সফি মোল্লা নামের অপর এক শ্রমিক বলেন, “ভারী কাজ প্রতিদিন করা সম্ভব হয় না। সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক আহত হন। অনেকেই কর্মক্ষমতা হারায়। কিন্তু আমাদের দেখার কেউ নাই। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে অনেক সময় ঘাট বন্ধ থাকে। তখন কাজ থাকে না। এতে আমাদের অভাবের শেষ থাকে না।”
ঢাকা/ইভা