আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা চলছে বলে সন্দেহ করছে বিএনপি। গণপরিষদ নির্বাচন, নতুন সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিক ও জুলাই ঘোষণাপত্র ঘিরে সময়ক্ষেপণের আয়োজন করা হচ্ছে বলেও মনে করে দলটি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উল্লেখ করে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান যে লক্ষ্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, এভাবে চলতে থাকলে সেটি ধীরে ধীরে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তারা ‘নির্বাচন প্রলম্বিত করার’ আয়োজন হিসেবে দেখছেন।
পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার যদি ‘অনির্দিষ্ট মেয়াদে’ ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে, তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মাঠের রাজনীতিতে থাকা বৃহৎ এই দলটি।
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপচারিতায়ও একই ভাষ্য পাওয়া যায়। নেতারা বলছেন, তাদের সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তাহলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব তৈরি হবে। এতে করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আবার সুযোগ নিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীর প্রতি সহিংসতা, উগ্রপন্থিদের উত্থান, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দোসররাও যুক্ত আছে বলে কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে। নির্বাচিত সরকার না এলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সামনের দিনে আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করা হলে নিজেদের করণীয় বিষয়ে কৌশল নির্ধারণে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে দলটি। যদিও দলটির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে একাধিকবার বলা হয়েছে, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। তবে দলটির নেতারা বলছেন, যদি সংস্কারের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া না হয়, তাহলে জনমনে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এর ফলে অনেকে অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ নিতে পারে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী সমকালকে বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন মানুষ ভোট দিতে চায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। যে সংস্কারগুলো একান্ত দরকার, সেগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিষয়টি ‘নির্বাচনী সংস্কার’ উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে, দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে আস্থা ও নিরাপত্তা দিতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
একদিকে এসব নিয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে গণপরিষদ নির্বাচনের আলোচনা চালু করার মাধ্যমে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। বিতর্ক তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলো এভাবে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবার সুযোগ করে নিতে পারে। তাদের এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। সংস্কারের আলাপের নামে জাতিকে বিভক্ত করা ঠিক হবে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রমে তাদের বিরোধিতা নেই। তারা সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছেন। তবে বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচন, তাই যে সংস্কারগুলো একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত– রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে সেগুলোতে সরকারের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এখন সবাই ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের একটি বড় অংশ তরুণ, তারাও এখন পর্যন্ত ভোট প্রয়োগের সুযোগ পায়নি। তাই ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে বড় সংস্কার। তাই সরকারের উচিত, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নতুন দলের বক্তব্য নিয়ে সতর্ক
গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব থেকে তৈরি হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, শুধু একটি নির্বাচনের জন্য দেশে অভ্যুত্থান হয়নি। তাদের এ ধরনের বক্তব্যকে সতর্কতার সঙ্গে দেখছে বিএনপি। বিশেষ করে, সেকেন্ড রিপাবলিক ও নতুন সংবিধান নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্যকে কর্তৃত্ব ধরে রাখার কৌশল বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আমার ধারণা, যারা সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ নির্বাচন, জুলাই ঘোষণাপত্র বিষয়ে কথা বলছেন, তারা মূলত রাজনৈতিক অভিধানে কিছু শব্দ প্রবেশ করাতে চাচ্ছেন। এগুলো শব্দবিলাস বা বাক্যবিলাস। নতুন সংবিধানের যে আলাপ এখন তোলা হচ্ছে, সেটি তো কোনো আভিধানিক কথা হতে পারে না। আবার সেকেন্ড রিপাবলিকের কথাও বলা হচ্ছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেন। ব্যাপক সংশোধনের মাধ্যমে সেটি করা সম্ভব। কিন্তু সেটা নতুন সংবিধান হিসেবে গৃহীত হবে না। সেটি হবে ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান।
গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচন একই সঙ্গে করার প্রস্তাবকে ‘জগাখিচুড়ি’ বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যখন একটি রিপাবলিক একভাবে ফাংশন করে, তখন সেই রিপাবলিকের খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য দরকার ব্যাপক সংশোধন। যেহেতু এটি হচ্ছে সার্বভৌম অবস্থা। কিন্তু সেটা কোনোভাবে সেকেন্ড রিপাবলিক হিসেবে চিহ্নিত হবে না।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, এই ধরনের আলোচনা অহেতুক। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে যে কেউ যে কোনো দাবি জানাতে পারেন।
তিনি বলেন, গণপরিষদ নির্বাচন, সংবিধান সংশোধনের মতো বিষয়গুলো জাতীয় নির্বাচনের দ্বারা মীমাংসিত হওয়া ভালো। সবচেয়ে জরুরি হলো, এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যে পৌঁছাতে হবে।
দেশে সম্প্রতি নারীর প্রতি অসম্মান ও বিভিন্ন জায়গায় নৈরাজ্যকর ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলতে চাই, দেশে একটি নির্বাচিত সরকার থাকলে এই ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে। সমাজে ও রাষ্ট্রে যেভাবে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে, তা দ্রুত নিষ্পত্তি করা না গেলে গণঅভ্যুত্থানের মূল যে চেতনা, সেটি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এ জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এসবের পাশাপাশি বিএনপি মনে করছে, সরকারকে ব্যর্থ করতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা সর্বোচ্চ মাত্রায় তৎপর রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে তারা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সমকালকে বলেন, যতদিন দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন না হবে, ততদিন আওয়ামী লীগও এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের অপতৎরতা অব্যাহত রাখবে।
মনোবল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা
গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে এক ধরনের জাগরণী তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দীর্ঘসূত্রতা দলটির এই মনোবল নষ্ট করে দিতে পারে আশঙ্কা করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তাই দলটি চায়, নির্বাচনী সংস্কার শেষে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক।
একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ৫ আগস্টের পরে নতুনভাবে রাজনীতির ময়দানে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির একই রকম সংস্কারের দাবির কারণে তারা নির্বাচন বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তাই সরকারকে চাপে রাখতে রমজান শেষে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সরব হবেন। এরই মধ্যে বিভাগীয় সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি চলছে। একই সময় জোট শরিকদের মাঠে সক্রিয় করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ স ক ন ড র প বল ক গণঅভ য ত থ ন র পর স থ ত ব এনপ র সরক র র ন র জন বলছ ন ধরন র দলট র আশঙ ক আওয় ম করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘শত শত বাস আসছে, পা ফেলানোর জায়গা নাই’
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর নারান্দিয়ার বাসিন্দা শেফালী বেগম। সাভারের বাইপাইল এলাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন তিনি। ঈদুল আজহার ছুটি শেষ হওয়ায় শনিবার (১৪ জুন) বিকেলে প্রায় চার ঘণ্টা কালিহাতীর এলেঙ্গায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন এই নারী। বাসে উঠতে না পেরে কর্মস্থলে যেতে তাকে উঠতে হয় পিকআপ ভ্যানে। ২০০ টাকার জায়গায় ৩৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে রওনা হন গন্তব্যে।
যাত্রা শুরুর আগে শেফালী বলেন, “গরম ও সড়কের ধুলাবালিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সড়কে চার ঘণ্টা দাঁড়িয় থেকে উপায় না পেয়ে পিকআপে করে ঢাকায় যেতে হচ্ছে।”
শুধু শেফালী নয়, তার মতো লাখ লাখ মানুষ আজ দিনভর ভোগান্তি নিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে দিয়ে ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরছেন। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষকে গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ ২ ঘণ্টা, কেউ ৩ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন গণপরিবহনের জন্য।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে মহাসড়কে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের চাপ
সিরাজগঞ্জে গাড়ির অপেক্ষায় কর্মস্থলে ফেরা মানুষ
জুলেখা বেগম বলেন, “আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। উত্তরবঙ্গ থেকে শত শত বাস আসছে, কিন্তু কোনো বাসেই পা ফেলানোর মতো জায়গা নাই। গরমও সহ্য হচ্ছে না।”
কর্মস্থলে ফিরতে বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের একাংশ
ইকবাল আলী বলেন, “মহাসড়কে ভোগান্তি ছাড়া কিছুই দেখছি না। পরিবহনগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।”
হারুন মিয়া নামে এক ট্রাক চালক বলেন, “সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। স্বাভাবিক সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা।”
এর আগে, গতকাল শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, একাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ও যানবাহন বিকল হওয়ায় যমুনা সেতুর টোলপ্লাজা থেকে টাঙ্গাইলের রাবনা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে তা কমে ১৪ কিলোমিটারে আসে। এছাড়া, মহাসড়কে গণপরিবহনের সংকট থাকায় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা ট্রাক ও পিকআপে গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ। সব মিলিয়ে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯ হাজার ১৮২টি যানবাহন যমুনা সেতা পারাপার করেছে। এ থেকে টোল আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ২০০ টাকা।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “মহাসড়কে যানজট নিরসনে পুলিশ কাজ করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”
ঢাকা/কাওছার/মাসুদ