ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে চলছে টানাপোড়েন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে আওয়ামী লীগ নিয়ে দুটি বিকল্প ভাবনার কথা জানা গেছে। একটি পক্ষ চায়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সবাইকে বাদ দিয়ে ‘রেভেল’ তথা বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ গঠন করানো। আরেকটি বিকল্প হলো, শেখ হাসিনার সম্মতিতে তাঁর পরিবর্তে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নেতৃত্বে ‘রিফাইন্ড’ তথা পরিশোধিত আওয়ামী লীগকে ভোটে রাখা।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো সমকালকে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে। এ চাওয়া পূরণে ‘শেখ হাসিনাবিরোধী নেতাদের আওয়ামী লীগ’কে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া যায় কিনা– এ ভাবনা রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশের মধ্যে। তবে এ সুযোগ পেতে ‘হাসিনাবিরোধী’ নেতাদের জুলাই গণহত্যা, তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন, গুম-খুন, ব্যাংক লুট, টাকা পাচারের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে ‘রিকনসিলিয়েশন’ বলতে চাচ্ছেন কেউ কেউ। একজন উপদেষ্টাসহ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের কয়েকজনের এতে সায় ছিল। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে গত তিন দিনে আওয়ামী লীগ নিয়ে দ্বিতীয় বিকল্প ভাবনাটি সামনে আসে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নিয়ে নতুন আওয়ামী লীগ গঠনের চিন্তাকে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ বলছেন ছাত্রনেতারা। তাদের বড় অংশই জুলাই গণহত্যার দায়ে বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধী। এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে মাঠেও নেমেছে।
গতকাল সোমবার রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ এবং সেনাবাহিনীর বিষয়ে ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্টের সম্পর্কে নেত্র নিউজ সেনাবাহিনীর বক্তব্য পেয়েছে দাবি করে প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, ১১ মার্চ দুই ছাত্রনেতার সঙ্গে বৈঠকে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অভিমত দিয়েছিলেন, যেসব নেতা ফৌজদারি মামলায় জড়িত নন এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, তাদের সমন্বয়ে নতুন আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, ফলপ্রসূ ও আন্তর্জাতিক মহলে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে এ ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিতর্কের সূত্রপাত যেভাবে
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে হাসনাত আবদুল্লাহ দাবি করেন, তিনিসহ আরও দু’জনের কাছে ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, তারা যেন আসন সমঝোতার বিনিময়ে প্রস্তাব মেনে নেন। তবে এর আগে থেকেই আওয়ামী লীগের ‘পুনর্বাসন’ নিয়ে সরব ছিলেন হাসনাত। ১২ মার্চ তিনি লেখেন, “আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছে। ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ‘ট্যাবলেট’ নিয়ে শিগগিরই হাজির হবে।” ১৫ মার্চ লেখেন, ‘যে পথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়েছে, ঠিক সে পথ দিয়েই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
২০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্বোধন করে লেখেন, ‘ড.
গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা নেই সরকারের। এ বক্তব্যের পর মধ্যরাতে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা চলছে। তিনি দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে এ প্রস্তাব এসেছে।
রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রথমবারের মতো এত খোলাখুলি আলাপ দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি করে। পরদিন শুক্রবার এনসিপি সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানায়। তবে পরদিন দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, হাসনাতের লেখা শিষ্টাচারবহির্ভূত।
ঘটনা আরও মোড় নেয় রোববার সারজিস আলমের লেখায়। তাঁর লেখার সারাংশ– ছাত্রনেতাদের আগ্রহেই ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। জেনারেল ওয়াকার আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেননি, বরং নিজের অভিমত জানান। হাসনাত যে কথোপকথনের কথা লেখেন, তা সত্য জানিয়ে সারজিস বলেছেন, সেনাপ্রধান ক্ষুব্ধ নয়; জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা যেভাবে বলেন সেভাবেই বলেছিলেন। তবে সারজিসও বলেছেন, জুলাই গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো আওয়ামী লীগের যে কোনো ‘ভার্সন’-এর রাজনীতিতে আসার বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত থাকবে।
বিএনপি-জামায়াত যা বলছে
৩ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়ার পক্ষে তারা নন। গত শনিবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন রেখেছিলেন, যারা ছাত্র হত্যা করেনি, যারা অর্থ লোপাট করেনি; সৎ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, তারা নেতৃত্বে এলে আওয়ামী লীগ কেন রাজনীতি করতে পারবে না?
তবে হাসনাতের স্ট্যাটাসের পর শুরু হওয়া আলোচনার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত শনিবার বলেছেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন হয় এমন কিছু করা যাবে না। পরদিন রুহুল কবির রিজভীও বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন চায় না বিএনপি।
তবে দলীয় সূত্রগুলো সমকালকে জানাচ্ছে, শেখ হাসিনা এবং যাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে, তাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এলে আপত্তি নেই বিএনপির। দ্রুত নির্বাচন চাওয়া দলটির নেতারা আওয়ামী লীগ বিতর্ককে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তারা একে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করছেন। সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন চান। তাই যারা নির্বাচন চায় না, তারা ওয়াকার-উজ-জামানকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি করছে।
অবশ্য বিএনপি নেতাদের কেউ ‘সেনাবাহিনী-এনসিপি-আওয়ামী লীগ’ বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত শনিবার দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমকালকে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দায়িত্ব বিএনপি নেয়নি। বিএনপি ১৭ বছর রাজপথে ছিল। নিজেদের পুনর্বাসনই এখন বিএনপির কাজ।’
হাসনাত-সারজিসদের যে বৈঠক নিয়ে আলোচনা চলছে, তেমন বৈঠক আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে হয়েছে বলে সূত্রগুলো সমকালকে জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তেমন একটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, বড় দলগুলোর আওয়ামী লীগের ‘পরিশুদ্ধ ভার্সন’ বিষয়ে অভিমত জানতে চাওয়া হয়।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, কোনোরূপেই আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে ফেরানো কারও দায়িত্ব নয়। আগে জুলাই গণহত্যা, ১৫ বছরের গুম-খুনের বিচার হোক। পরে আওয়ামী লীগ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা যাবে।
সাবের হোসেন ঘিরে আলোচনা
অভ্যুত্থানের পর হত্যা মামলায় দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাংশ কারাগারে, বাকিরা পলাতক। জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান অনুযায়ী, হত্যাযজ্ঞে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগী ছিল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলো।
সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সমকালকে বলেছেন, সরকারের চিন্তা হলো, যারা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরিত্যাগ করে ১৫ বছরের সব অপকর্মের জন্য দায় উন্মোচন করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাচনে আসতে চান, তাদের আসতে দেওয়া হবে। অতীতে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন, সরকারের এমন একজন উপদেষ্টাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এর সমান্তরালে আরেকটি প্রচেষ্টা চলছে, তা শেখ হাসিনার বদলে অন্য কাউকে দলের দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে এ দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা আছে। তবে তিনি ‘বিদ্রোহী’ হতে রাজি নন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে শুধু সাবের হোসেন চৌধুরী এবং সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জামিন পেয়েছেন। রিমান্ড চলাকালে সাবের হোসেন এক দিনে ছয় মামলায় জামিন পাওয়ায় গত অক্টোবর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিতে পারেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলা একজন রাজনীতিক সমকালকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা অনুমোদন দিলে এটা হতে পারে। আর সরকারকে দিতে হবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তবে এ বিষয়ে সাবের হোসেনের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সমকালকে বলেন, শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীক; নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই আসে না।
যেসব সমীকরণ আলোচনায়
একাধিক রাজনৈতিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, পরিশোধিত আওয়ামী লীগ হতে হবে হাসিনার অনুমোদনে। সময় ও পরিবেশ অনুকূলে এলে ‘পরিশোধিত’ আওয়ামী লীগে ফিরতে পারেন হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাই এতে রাজি নয় সরকার, ছাত্রনেতা এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
তাদের মূল্যায়ন, বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তা হবে দলটির স্থায়ী বিভক্তি। বিদ্রোহী অংশ মূল দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, কখনোই শেখ হাসিনার সমর্থকদের সমর্থন পাবে না। ফলে এই দল অন্যদের জন্য তেমন হুমকি হতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে বণর্বাদী শাসনের সময়ের অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, একই পদ্ধতিতে বিচার ও অনুশোচনার পর এই আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিতে রাজি তারা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত জ ল ই গণহত য র জন ত ক স ন উপদ ষ ট পর শ ধ ত র ফ ইন ড ই আওয় ম ব এনপ র সরক র র ন র পর ফ সব ক বল ছ ন র পর ব এনস প দলট র সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান অনড়, ইসরায়েল কঠোর
ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান দিয়ে। পাল্টা হামলায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে ইরান। এতে উভয় পক্ষে বাড়ছে প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি। বিধ্বস্ত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। ইরান তেল আবিবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল আবারও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যে পরিণত করেছে। এ অবস্থায় দুই দেশের রাজনীতিকরা ছুড়ছেন বাক্যবাণ। তারা সমঝোতা বা শান্তির বাণী না শুনিয়ে দীর্ঘ ও আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে। ইরান কিংবা ইসরায়েল– কেউ কারও অবস্থান থেকে একচুল নড়ছে না।
ইরানের সামরিক-পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের আঘাতের পর গত শুক্রবার রাতভর ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র পাল্টা হামলা চালায় ইরান। পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান শহর তেল আবিব। হাজার হাজার মানুষ ভূগর্ভের বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। নিহত হয় তিনজন। আহতের সংখ্যা ৭০।
ইরানের কয়েকটি প্রদেশে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলও। এর মধ্যে দেশটির বুশের প্রদেশে হামলায় জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ও একটি গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। পরে এ আগুন নেভাতে সক্ষম হয় ইরান। এ অবস্থায় পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
তেহরানের দাবি, তারা ইসরায়েলের তিনটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ ১০টি বিমান ভূপাতিত করেছে। পাশাপাশি দু’জন ইসরায়েলি পাইলটকে আটক করেছে। ইরানের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে দাবি করে, সর্বশেষ গতকাল শনিবার ভূপাতিত করা হয় একটি যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া গত শুক্রবার দুটি ভূপাতিত করা হয়। তিন যুদ্ধবিমানের পাইলটদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্য দু’জন ইরানের হেফাজতে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবারই প্রথম কোনো যুদ্ধে অংশ নিল। রাডার ফাঁকি দিতে পারা এসব বিমান ভূপাতিত করা প্রায় অসম্ভব বলেই বর্ণনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনে আঘাত হেনেছে। এতে ভবনটির একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এ নিয়ে ইসরায়েলের গণমাধ্যমে কোনো উল্লেখ নেই।
গতকাল শনিবার দ্বিতীয় দিনে নতুন করে ইরানের কয়েকটি প্রদেশে হামলা চালায় ইসরায়েল। এর মধ্যে রয়েছে– পূর্ব আজারবাইজান, লোরেস্তান, কারমানশাহ। এতে পূর্ব আজারবাইজানের চারটি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বার্তা সংস্থা ফার্স জানায়, লোরেস্তান প্রদেশের খুররমাবাদে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। একটি ভিডিওতে পূর্ব আজারবাইজানের তাবরিজ শহরে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। পশ্চিম ইরানের আসাদাবাদে অন্তত দু’জন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন। এসব এলাকায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দিয়ে ইসরায়েলের আঘাতের জবাব দেয় ইরান। এ হামলায় তেল আবিবসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যেই উত্তেজনার বারুদে আগুন দিচ্ছেন দুই দেশের রাজনীতিকরা। ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা হামলা চালিয়ে যাবে। আর ইসরায়েল বলেছে, এভাবে হামলা চালালে (তাদের হামলায়) তেহরান পুড়বে। এ অবস্থায় গাজাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে ইরানকে প্রথম যুদ্ধলক্ষ্য ঘোষণা করেছে ইসরায়েল।
শনিবার ভোরে চালানো ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের সাত সেনা আহত হয়। ক্ষেপণাস্ত্রটি আঘাত হানে মধ্য ইসরায়েলে। এর আগে গত শুক্রবার রাতটি ছিল ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে ভূগর্ভের কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। ধুনক থেকে ছোড়া তীরের গুচ্ছের মতো এগোতে থাকে ক্ষেপণাস্ত্র। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বেশ কিছু শূন্যে ঠেকিয়ে দিলেও কয়েকটি আঘাত হানে। ইসরায়েলের বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিদ বলেন, রাতটি ছিল ইসরায়েলের জন্য কঠিন।
সিএনএন জানায়, হামলা হয়েছে তেল আবিবের দক্ষিণে রিশোন লেজিওন এলাকায়। সেখানে ইরানের রকেট হামলায় অন্তত একজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ জন। ওই অঞ্চলের জরুরি সেবা বিভাগের উপপরিচালক রামি মুশার বলেন, ‘এটি এক কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি।’ ভবনগুলোর ভেতর আর কোনো হতাহত আছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে আমরা এখনও কাজ করে যাচ্ছি। ছবি ও ফুটেজে বিধ্বস্ত ভবন দেখা গেছে।
ইরানের এক কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের পাল্টা হামলা এখনই থামছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ফার্সকে বলেন, শুক্রবার রাতের সীমিত পদক্ষেপে এ সংঘাত শেষ হচ্ছে না। ইরানের হামলা চলতে থাকবে। এ প্রতিক্রিয়া আগ্রাসনকারীদের জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও পরিতাপের হবে। আর ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমাহ মোহাজেরানি বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় গৌরব পুনরায় অর্জন ও জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।’
অন্যদিকে গতকাল শনিবার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরানের প্রতিটি স্থাপনায় হামলা চালানো হবে। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় কঠোর আঘাত হেনেছি।’ এএফপি জানায়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানকে নতুন হামলা নিয়ে হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান যদি ইসরায়েলে আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তাহলে পাল্টা হামলা চালিয়ে তেহরানকে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, যদি আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে তেহরান জ্বলেপুড়ে যাবে।
হামলা-উত্তেজনার মধ্যে ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া শনিবার থেকে তাদের আকাশসীমা আবার খুলে দিয়েছে।
কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই গত শুক্রবার ভোরে ইরানের পারমাণবিক, সামরিক স্থাপনা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের লক্ষ্য করে নজিরবিহীন হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে শীর্ষ চার জেনারেল, ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীসহ অন্তত ৮০ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ২০ শিশুও রয়েছে। আহত হন ২৩০ জন। রাতেই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা আঘাত হানে ইরান।
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত ঘোষণা করেছে মধ্যস্থতাকারী দেশ ওমান। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বন্দর আব্বাসে হামলা হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন কাতারের শেখ তামিম। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় চারটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইরানে হামলা চলমান বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। দক্ষিণ ইরানে তেল শোধনাগারে ইসরায়েলি ড্রোন হামলার পর আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পূর্ব আজারবাইজানে ৩০ সামরিক ও একজন রেড ক্রিসেন্ট কর্মী নিহত হয়েছেন। প্রদেশটির ১৯ স্থানে হামলা হয়েছে।
পুতিন ও ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা নিয়ে ৫০ মিনিট ফোনালাপ করেছেন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, পুতিন ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছেন। দুই নেতা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। এ সময় ট্রাম্প মন্তব্য করেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থেমে যাওয়া উচিত।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ‘গুরুতর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। স্টারমার জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য একটি কূটনৈতিক সমাধানে আসতে তার মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ তাঁর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচিকে ফোনে বলেছেন, মস্কো ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বলপ্রয়োগের নিন্দা করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে প্রস্তুত। ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। তিনি ইরানকে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, পশ্চিমাঞ্চলীয় হামাদান প্রদেশে ইসরায়েলি হামলায় আসাদাবাদ পাবলিক সিকিউরিটি পুলিশের প্রধান মেজর হাবিবুল্লাহ আকবরিয়ান নিহত হয়েছেন।
আমরা সবই জানতাম– বললেন ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলার আগে তারা জানতেন। রয়টার্সের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি বলেন, ‘আমরা সবই জানতাম। আমি ইরানের অপমান ও মৃত্যু ঠেকাতে চেয়েছি। আমি তাদের রক্ষায় যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। কারণ, চুক্তি কাজ করছে– এমনটা আমি দেখতে চাই।’ তিনি বলেন, তারা এখনও চাইলে চুক্তি করতে পারে।
হামলার পর পারমাণবিক আলোচনা অর্থহীন– বলছে ইরান
ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ইসরায়েল ইরানে হামলা চালিয়েছে। তাঁর দাবি, ওয়াশিংটনের সম্মতি না থাকলে এ হামলা কখনোই হতো না। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আলোচনা চলছিল। সে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে বাকাই বলেন, ‘অন্য পক্ষ (যুক্তরাষ্ট্র) এমনভাবে আচরণ করেছে, যা আলোচনাকে অর্থহীন করে তুলেছে।’ ইরানের পাল্টা হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাস।
রাতে পাঁচবার জায়গা বদল করেন মার্কিন দূত
ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন দূত মাইক হাকাবি গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত পাঁচবার নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর হন। সিএনএন জানায়, ইসরায়েলে ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে তিনি বারবার জায়গা বদল করেন। শনিবার সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে ইসরায়েলে অবস্থানরত হাকাবি এসব কথা জানান। তিনি লিখেন, ‘ইসরায়েলে এক কঠিন রাত কাটল।’
ইরানকে হুঁশিয়ারি মার্কিন কর্মকর্তার
বিবিসি জানায়, ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে জানিয়েছিল ইসরায়েল। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল, আত্মরক্ষার্থে এ হামলা অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সংস্থাবিষয়ক ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ম্যাকয় পিট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এসব কথা বলেছেন। নিরাপত্তা পরিষদে পিট বলেন, দেশটি যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, ঘাঁটি কিংবা অবকাঠামোর ওপর হামলা চালায়, তবে পরিণতি হবে শোচনীয়।
কেউ যেন কারও অস্তিত্ব হুমকিতে না ফেলে– বললেন পোপ লিও
ইরান ও ইসরায়েলের উত্তেজনার মধ্যে শান্তির বার্তা দিয়েছেন ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ লিও। তিনি বলেন, দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে পারমাণবিক হুমকিমুক্ত বিশ্ব গড়তে হবে। কেউ যেন কারও অস্তিত্বের জন্য হুমকি না হয়ে ওঠে। প্রতিটি দেশের কর্তব্য হবে শান্তি ও পুনর্মিলনের পথ অন্বেষণ এবং সমাধান খুঁজে বের করা।
ভূরাজনৈতিকভাবে একাকী ইরান– বলছেন বিশ্লেষক
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হামেদ মুসাভি আল বলেন, ইরান তুলনামূলক ভূরাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্র থামাতে পারে না। ইরানের প্রতি কিছু আরব-মুসলিম দেশ, রাশিয়া ও চীনের প্রতীকী সমর্থন আছে। তবে কারও কাছ থেকে খুব বেশি অস্ত্র পাচ্ছে না। অন্যদিকে ইসরায়েলিদের প্রতি মার্কিন সমর্থন রয়েছে, যারা তাদের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করছে। তাদের বার্ষিক ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিচ্ছে।