তেলিহাটী স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন
Published: 2nd, April 2025 GMT
চৈত্রের আকাশে তপ্ত সূর্য। রোদের তীব্রতাকে সঙ্গী করে শুরু হয় দিনটি। সকাল বেলাতেই তেতে উঠে প্রকৃতি। রোদ আর প্রচণ্ড গরমকে উপেক্ষা করে ছেলে মেয়ে আর নাতি-নাতনিকে নিয়ে প্রাণের বিদ্যাপীঠে হাজির হন ৭৫ বছর বয়সী আব্দুল আওয়াল। পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় পর পুরোনো সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া আব্দুল আওয়াল। স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন তিনি। ফিরে যান হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে, শৈশবে। আওয়ালের মতো প্রবীণদের সঙ্গে যোগ দেন নবীনরাও। এ প্রজন্মের সঙ্গে সে প্রজন্মের মেলবন্ধন। এভাবেই ৩ হাজার শিক্ষার্থীর আড্ডা, সেলফি আর স্মৃতিমন্থনে জমে ওঠে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। স্কুলটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার দিনভর চলে জমকালো আয়োজন।
অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় এক মাস আগে থেকে চলে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া। ‘এসো স্মৃতির প্রাঙ্গণে মিলি প্রীতির বন্ধনে’ স্লোগানে আনন্দ উৎসবের জন্য সাজানো হয় পুরো বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। সকাল সকাল বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। স্কুলে আসা মাত্রই আয়োজক কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকের হাতে টি-শার্ট, ব্যাগ ও উপহারসামগ্রী তুলে দেন। সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ের মাঠ বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়।
সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, কৃষক, গাড়িচালক কিংবা রিকশা চালক-এ বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সকল শ্রেণিপেশার মানুষের গায়ে একই পোশাক। সাদা টি-শার্ট। কারো সঙ্গে কারো ভিন্নতা নেই। পরে বিশাল প্যান্ডেলে সহস্রাধিকার চেয়ারে সারিবদ্ধভাবে বসেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শুরু হয় প্রবীণ ও নবীন শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান। মধ্যাহ্নভোজের পরও চলে স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান। বিকেলে চা বিরতির পর শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন এ স্কুলের ১৯৯০ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। বর্তমানে তিনি বরিশালের জেলা প্রশাসক। প্রায় ৩৫ বছর পর প্রাণের বিদ্যাপীঠে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ স্কুলে আমার হাজারো স্মৃতি রয়েছে কোনটা রেখে কোনটা বলব। বাল্যকালের অনেক বন্ধু এসেছে। ভীষণ ভালো লাগার একটি দিন কাটল স্কুলে এসে। আয়োজনটাও বেশ চমৎকার।
১৯৭৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী গোলাম মোস্তফা বলেন, এই বয়সে এসে এমন একটি দিন পাবো এটা কল্পনা করতে পারি না। ৫০ বছরের বন্ধুদের পেয়েছি। গল্প করছি। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া আড্ডা। আবার বর্তমান শিক্ষার্থীদেরও পেয়েছি।
১৯৯৫ ব্যাচের ছাত্রী শাহীন সুলতানা বলেন, মিলনমেলাটা আমাদের সবাইকে এক করে দিয়েছে। পেশাগত কারণে সবাই ব্যস্ত। এই আয়োজন সব ব্যস্ততা কাটিয়ে সবাইকে এক করে দিয়েছে। সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সবার বিষয়ে জানা হয়েছে। সত্যিই দিনটি খুবই আনন্দে কেটেছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু জাফরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় পুরো আয়োজন। রাতে দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের গান পরিবেশনায় মুগ্ধ হন সবাই।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনার কয়রা: জোয়ার ঠেকাতে বাঁধের ওপর ‘দেয়াল’ দিচ্ছে এলাকার মানুষ
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের রত্নাঘেরি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। ওপারে দাঁড়িয়ে আছে সবুজে মোড়া সুন্দরবন। নদীর ঢেউ আর জোয়ারের গর্জনে আতঙ্কে থাকেন নদীপারের মানুষ। এলাকার বাসিন্দাদের এখন একমাত্র ভরসা একফালি মাটির বাঁধ। আর সেই বাঁধের ওপর হাতে গড়া নতুন দেয়াল।
সম্প্রতি এক সকালে কাদামাখা বাঁধের ওপরের সরু পথ ধরে বাজারের ব্যাগ হাতে হেঁটে যাচ্ছিলেন অরবিন্দ কুমার। এক হাতে শার্ট গুটিয়ে কাদায় সাবধানে পা ফেলছিলেন। কাছে গিয়ে কথা বলতেই তিনি হেসে বললেন, ‘ভাই, নদী এখন আর আগের মতো শান্ত নেই। জোয়ারের পানি বাঁধ ছাপায়ে গ্রামে ঢুকতি চায়। একবার যদি ঢুকে পড়ে, ঘরবাড়ি সব ভাইসে যাবে। তাই আর কারও মুখের দিকি না চায়ি এই বাঁধের ওপর আমরা নিজেরাই দেয়াল তুলিছি।’
জোয়ারের পানি থেকে বাঁচতে এই দেয়াল রত্নাঘেরির মানুষেরা গড়েছেন। প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধের ওপর নদীর চরের মাটি কেটে, ঝুড়ি আর কোদাল হাতে নিয়ে দেয়াল তুলেছেন গ্রামের মানুষ। শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাথরখালী মিলনী যুব সংঘের সভাপতি অভিজিৎ মহলদার জানান, সেই দেয়াল তৈরির কথা।
অভিজিৎ বলেন, ‘এই জায়গাটা খুব নিচু। জোয়ার একটু বাড়লেই পানি বাঁধ ছাপিয়ে ঢুকে পড়ে। তাই সম্প্রতি দুই শতাধিক যুবক আর গ্রামের নারী-পুরুষ মিলে আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটেছি, বস্তা টেনেছি, বাঁধের ওপর দেয়াল তুলেছি। আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ দিনমজুর। একদিন কাজ না করলে চুলায় আগুন জ্বলে না। তবুও সেদিন সবাই রোজগার ফেলে কোদাল হাতে নিয়েছে। কেউ মাটি কেটেছে, কেউ বস্তায় ভরেছে, কেউ দেয়ালে বসিয়েছে। কারণ আমরা জানি, একবার বাঁধ ভাঙলে কেমন কষ্ট হয়।’
রত্নাঘেরির এই দৃশ্য আসলে কয়রা উপজেলার প্রতিচ্ছবি। সরেজমিনে কয়রার মহেশ্বরীপুর, নয়ানি, বাবুরাবাদ, চৌকুনি, তেঁতুলতলার চর, মঠবাড়ি, হায়াতখালী যেখানেই যাওয়া যায়, দেখা যায় বাঁধের ওপর বানানো নতুন মাটির দেয়াল। ষাটের দশকে বানানো বাঁধগুলো এখন আর জোয়ারের পানি সামলাতে পারে না। নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে পলিতে, জেগেছে চর। বাঁধ উপচে পানি চলে আসে গ্রামে।
মহেশ্বরীপুরের অনুপম কুমার বলেন, ১০ বছর আগে এই নদীতে জোয়ারের সময় ৭০-৮০ হাত পানি থাকত। এখন পলি পড়ে থাকে ২৫-৩০ হাত। নদীর তলা যত ভরে, ততই জোয়ারে পানি উঁচু হয়। বাঁধ উপচে পানি ঢোকে। তাই নিজেরাই মাটি তুলে দেয়াল বানিয়েছেন।
উত্তর বেদকাশীর শাকবাড়িয়া নদীর ধারে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানান, ‘প্রতি জোয়ারে গাঙের পানি এমন ওঠে, বুক ধড়ফড় করে। আগে ভরা জোয়ারে বাঁধের অর্ধেক পর্যন্ত পানি উঠত, এখন কানায় কানায় উঠে যায়। তাই আমরা দেয়াল তুলছি, না হলে গ্রাম তলিয়ে যেত।’
কয়রার মহেশ্বরীপুর, নয়ানি, বাবুরাবাদ, চৌকুনি, তেঁতুলতলার চর, মঠবাড়ি, হায়াতখালী এলাকায় বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল বানানো হয়েছে