মাআমাকে ক্ষমা করো। এ পথটাই আমি বেছে নিয়েছি। আমি মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো, মা। আমি শপথ করে বলছি, আমি কেবল মানুষকে সাহায্য করার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছিলাম। এগুলো ছিল গাজার তরুণ ফিলিস্তিনি চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ানের শেষ কথা। রাফার ঠান্ডা রাতের আকাশের নিচে ইসরায়েলি সৈন্যঘেরা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত একটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। আহতদের বাঁচাতে তিনি তাঁর চিকিৎসক দলের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। কেউ ফিরে আসেননি। 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালিয়ে রাদওয়ানসহ ১৪ জন জরুরি ভিত্তিতে কর্মরত চিকিৎসককে হত্যা করে। পরে তাদের মৃতদেহ একটি অগভীর কবর থেকে উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে কারও কারও হাত বা পা বাঁধা ছিল। স্পষ্টত, খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করা হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যদিও তারা চিকিৎসকের পোশাক পরা ছিলেন। সঙ্গে ছিল রেডিও, গ্লাভস ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম। তবুও ইসরায়েল মিথ্যাচার করছে। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বকে বলেছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো চিহ্নিত করা যায়নি এবং ‘সন্দেহজনক’ ছিল। এ কারণে ইসরায়েলি আক্রমণ ন্যায্য ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ফুটেজে দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল। আলো জ্বলছিল এবং মেডিকেল জ্যাকেটগুলো দেখা যাচ্ছিল। এতে কোনো হুমকির চিহ্ন ছিল না; ছিল না কোনো ক্রসফায়ার। এমনকি কোনো অস্পষ্টতাও ছিল না। মনে হচ্ছে, এগুলো শুধুই ইচ্ছাকৃত নির্বিচার হত্যা। 
অতি জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা পুষ্ট হয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন: ‘এটি আমাদের সবার জন্য, সমস্ত সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা বর্বরতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লড়ছি.

.. আমি বিশ্বাস করি, আমরা আমাদের সবার সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার জন্য একই যুদ্ধে লড়ছি।’

গাজায় ইসরায়েল যা করছে তা যুদ্ধ নয়। এটি জীবন নিশ্চিহ্ন করা। শ্বাস-প্রশ্বাস বা স্বপ্ন যা কিছু আছে, তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধ্বংস করা। এখানে কোনো লাল সীমারেখা নেই। কি চিকিৎসক, শিশু, এমনকি মৃত ব্যক্তির জন্যও কোনো চিহ্নরেখা নেই। ইসরায়েলি সৈন্যরা হাসপাতালে হামলাকালে একজন নার্স অস্ত্রোপচারের মাঝখানে এক রোগীকে ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। অন্য এক চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, তারা তাকে হাঁটুতে গুলি করে হাড় ভেঙে দেয় এবং পরে টেনে নিয়ে যায়। তাকে নির্যাতন করে অন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গুরুতর অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়।
গাজার শীর্ষস্থানীয় অর্থোপেডিক সার্জন আদনান আল-বুরশকে আল-আওদা হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে ইসরায়েলি কারাগারে ফেলে রাখা হয়েছিল। তাঁকে মারধর, ধর্ষণ করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়। তথাকথিত যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে ভয়াবহতা আরও তীব্র হয়েছে। খাবার নেই, জ্বালানি নেই এবং জলজ উদ্ভিদগুলো নির্জীব হয়ে পড়েছে। গাজার বেকারিগুলো ভেঙে পড়েছে। পরিবারগুলো নালার পানি পান এবং পশুখাদ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছে। অথচ তাঁর চিকিৎসা করার জন্য কেউ অবশিষ্ট নেই। এটি ‘সভ্যতা’র নামে ইসরায়েলের যুদ্ধ। দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জোনাথন হুইটল একে ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ বলে তুলে ধরেছেন। ইসরায়েল আইন, নীতি ও শালীনতার প্রতিটি সীমা পদদলিত করেছে। কোনো অঞ্চল নিরাপদ নয়; কোনো হাসপাতাল রেহাই পায় না; কোনো শিশুও বাদ যায় না। এটি কোনো সংঘাত নয়, বরং অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ। 

আর যে মিথ্যাচার এতে উস্কানি দিচ্ছে, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তৈরি হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে ‘সহিংস ফিলিস্তিনিদের’ ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে প্রচারিত হচ্ছে, যা একটি আধুনিক ঔপনিবেশিক মিথ। ইসরায়েল নিজেকে গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা এবং অবরুদ্ধ সভ্যতার ঘাঁটি হিসেবে উপস্থাপন করে। তেল আবিব গল্পটি তৈরি করেছে; ওয়াশিংটন অস্ত্রের জোগান দিয়েছে, লন্ডন তা মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছে এবং হলিউড এটি বিক্রি করেছে। এটি কখনোই সত্য ছিল না। এটি ছিল প্রোপাগান্ডা, ঘষামাজা করে তৈরি, বারবার তুলে ধরা এবং হাতিয়ারে পরিণত করা। 
এই গণহত্যা দুর্ঘটনাজনিত কারণে নয়; যুদ্ধের কোনো মর্মান্তিক উৎসজাতও নয়। এটি একটি পলিসি। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট, যা বিশ্বব্যাপী একটি উদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রশংসিত, মানবিক কারণে গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার আবেদন সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একজন বিচারকও শিশুসহ আটকে পড়া জনগোষ্ঠীকে অনাহারে রাখার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।
ইসরায়েল হত্যা করবে, তারপর মিথ্যা বলবে। আত্মরক্ষার জন্য হত্যা পুনরায় চালিয়ে যেতে তারা আরেকটি মিডিয়া বিবৃতি দেবে। রাদওয়ান জেগে উঠেছেন– কেবল স্পিরিট নিয়ে নয়, প্রতিরোধের সঙ্গে। তিনি ভয়, প্রোপাগান্ডা, মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছেন। যে পৃথিবী কেবল মৃত্যুসংখ্যায় নিমগ্ন, সেখানে তিনি মানবতা ফিরিয়ে এনেছেন। এখন রাদওয়ান ইসরায়েলের সব চেষ্টার স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন, যারা সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সেখানে রাদওয়ান একজন মর্যাদার প্রতীক ও নিষ্ঠুরতার পাল্টা জবাবে উপস্থিত। 

সুমাইয়া ঘানুশি: ব্রিটিশ তিউনিসিয়ান লেখক এবং
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ; মিডল ইস্ট আই
থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র জন য ত র জন ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন

‘“এ সকল নষ্ট মাইয়াদের জন্য বাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। যা যা বাস থেকে নেমে যা নষ্ট মাইয়াছেলে”—বাস কন্ডাক্টরের এই মন্তব্য শোনার পর নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি।’ কথাগুলো বলছিলেন বাসে হেনস্তার শিকার ওই তরুণী। আজ প্রথম আলোর সঙ্গে মুঠোফোনে দীর্ঘ আলাপে তিনি সেদিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান। বললেন, ঘটনার সময় বাসে একজন মানুষও প্রতিবাদ না করায় কষ্ট পেয়েছেন। যিনি এ ঘটনার ভিডিও করেছিলেন, তাঁর কাছ থেকেও কটু কথা শুনতে হয়েছিল। এমনকি তিনি বাস থেকে নামতে গিয়েও পারছিলেন না। যতবার নামার চেষ্টা করেন, চালক বাস টান দিচ্ছিলেন।

তবে দৃঢ়তার সঙ্গে এই তরুণী জানিয়েছেন, এই হেনস্তার ঘটনা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন।

জুতা হাতে বাস কন্ডাক্টরের আচরণের প্রতিবাদ জানানোর ওই ঘটনা ঘটে গত ২৭ অক্টোবর। বাসের এক ব্যক্তি ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করলে তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার রমজান পরিবহন নামের বাসের হেনস্তাকারী কন্ডাক্টর নিজাম উদ্দিনকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় তরুণীর এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র বাদী হয়ে গতকাল শুক্রবার মামলা করে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় (যৌন নিপীড়নের অভিযোগ) মামলাটি করা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল, বাসের সামনের আসনে বসা এক ব্যক্তির কোনো একটি মন্তব্য নিয়ে এক তরুণী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তিনি তেড়ে যান লোকটির দিকে। ওই সময় লোকটি আসন ছেড়ে উঠে তরুণীকে চড় মারেন। একপর্যায়ে দুজন জুতা খুলে দুজনের দিকে তুলে ধরেন। সে সময় ওই ব্যক্তি তরুণীকে আঘাত করেন এবং ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। ওই ব্যক্তি এরপর বারবার তরুণীর গায়ে ধাক্কা মারেন ও আঘাত করার চেষ্টা করেন। তরুণী চিৎকার করে বলছিলেন, ‘তুই আমার পোশাক তুলে কেন কথা বলবি?’ এ সময় সামনের দিকে থাকা দুই নারী ও একজন পুরুষ যাত্রী ছাড়া আর কেউ আঘাত করা ব্যক্তিটিকে থামানোর চেষ্টা করেননি, প্রতিবাদ করেননি।

ওই তরুণী প্রথম আলোকে জানান, তাঁর মা–বাবা ও ভাই–বোনরা চাঁদপুরে থাকেন। বাবার দোকান রয়েছে। ভাই–বোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়। চাঁদপুর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর এখন ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ছেন। পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবাকে সহায়তা করতে নিজেও টুকটাক কাজ করেন। হাতের কাজ, ছবি আঁকার কাজ করেন, টেলিভিশন চ্যানেলে মাঝেমধ্যে কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেন। রাজধানীর বছিলা এলাকায় কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন।

‘শুরুতে আমি উত্তেজিত হইনি’

সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে তরুণী বলেন, তিনি মুঠোফোন ঠিক করতে হাতিরপুলে মোতালিব প্লাজায় গিয়েছিলেন। বাসায় ফেরার জন্য সেখান থেকে ধানমন্ডি–১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে আসেন এবং রমজান পরিবহনের ওই বাসটিতে ওঠেন। তখন বেলা দুইটা কি আড়াইটা। তিনি বাসে উঠে মাঝামাঝি জায়গায় একটি আসনে বসেন। বাস কন্ডাক্টর তাঁর কাছে এসে ভাড়া চাইলে ‘স্টুডেন্ট’ (শিক্ষার্থী) জানিয়ে তিনি অর্ধেক ভাড়া দেন। তরুণী দাবি করেন, বাস কন্ডাক্টর তখন বলে ওঠেন, ‘চেহারা আর পোশাক দেখলে তো মনে হয় না স্টুডেন্ট!’ তখন তিনি রাগ হলেও কন্ডাক্টরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে বলেন, ‘স্টুডেন্টের সঙ্গে পোশাকের কী সম্পর্ক? আপনি এসব কী ধরনের কথা বলছেন? ওই সময় কিছুটা কথা-কাটাকাটি হয়। শুরুতে আমি উত্তেজিত হইনি।’

রাজধানীর বছিলায় বাসের মধ্যে পোশাক নিয়ে কটূক্তির সাহসী প্রতিবাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর প্রশংসা করে এমন চিত্র ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঢাবি থেকে ড. জাকির নায়েককে ডক্টরেট দেওয়ার দাবি শিক্ষার্থীদের
  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
  • বগুড়ায় বাড়িতে হাতবোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ, আহত একজন গ্রেপ্তার
  • ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন