সালভাদর দালি ঠিক কোন দিন থেকে আমার মনের গভীরে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন, সেটা মনে করতে পারি না। তবে এটুকু স্পষ্ট মনে আছে– প্রায় এক যুগ আগে, যখন প্রথম তাঁর আঁকা ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ ছবিটা দেখেছিলাম, তখনই চোখের সামনে এক অদ্ভুত জগৎ খুলে গিয়েছিল! ছবিটা ছিল অদ্ভুত! ক্যানভাসের ওপরে মোমের মতো গলে পড়ছিল তিনটি ঘড়ি; যা সময় বয়ে যাওয়ার প্রতীক, আর ছবির কোণে ছড়িয়ে থাকা পিঁপড়াগুলো যেন জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এ ছাড়া কিছু একটা ছিল ছবিটায়; যা পুরোপুরি আবিষ্কার করতে না পারলেও উপলব্ধি করে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বখ্যাত ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা ছবি আমার বহু আগে থেকেই পছন্দ ছিল। গগের তুলির আঁচড়, রং, প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করত। কিন্তু দালির চিত্রকর্ম আমাকে চিরচেনা পরিধির বাইরে কল্পনা-বাস্তবতার মিশেলে অন্যরকম এক অস্বস্তি ও প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছিল। যার ফলে, আমি টের পেয়েছিলাম একেক শিল্পীর একেক চিত্রকর্ম নিয়ে অনুভূতি ও উপলব্ধি একইসাথে কতটা গভীর এবং ভিন্ন হতে পারে। পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম, ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ ছবিটা শুধু দালির শিল্পীসত্তার নিদর্শনই নয়, বরং সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি।
১৯৩১ সালে, যখন স্পেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে, দারিদ্র্য ক্রমশ গ্রাস করছে দেশকে, তখনই জন্ম নেয় এই চিত্রকর্ম। সেই সময়, স্পেন একদিকে রাজতন্ত্র ও অন্যদিকে একনায়কতন্ত্রের চাপে ছিল দমবন্ধ অবস্থায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক শিল্পীর মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। অজস্র শিল্পী তখন হয়ে উঠছিলেন বিদ্রোহী। সে সময়েই প্রচলিত শিল্পের সংজ্ঞা ও রীতিনীতি ছুড়ে ফেলে তারা জন্ম দেন এক নতুন আন্দোলনের– সুররিয়ালিজম। যাকে বলা যায়, “যুক্তির নিয়ন্ত্রণ ছাড়া, স্বাধীন চিন্তার প্রবাহ”– সহজ কথায়, বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে কল্পনার এক মুক্ত ভূমি। এই ভাবনারই চূড়ান্ত প্রকাশ সেই বিখ্যাত গলিত ঘড়ির চিত্রকর্ম, যা আজও সহস্র কোটি দর্শকের চেতনায় অনুরণন তোলে।
আমি জানতাম, দালির জীবদ্দশায় মাত্র দুটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল– একটি তাঁর নিজ দেশ স্পেনের ফিগুয়েরসে, আর অন্যটি ফ্লোরিডায়। তাই যখন শুনলাম ‘দ্য সালভাদর দালি মিউজিয়াম’ সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে, তখন থেকেই সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম।
ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্কের কনকনে শীত যখন চারদিক জমিয়ে তুলল, তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম– পরিবার নিয়ে ফ্লোরিডা চলে যাব! ‘সানশাইন সিটি’ নামে পরিচিত এই রাজ্য ডিসেম্বর মাসেও রোদেলা, আরামদায়ক উষ্ণতায় মোড়ানো। যেখানে নিউইয়র্কের রাস্তায় ভারী কোটের নিচেও শীত হাড়ে কাটে, সেখানে ফ্লোরিডার সৈকতে নরম বালির ওপর পা ছড়িয়ে, গা এলিয়ে দেওয়া যায়। সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের ছন্দে মন হারিয়ে যায়, বাতাসে ভেসে আসে সিগালের করুণ ডাক। আকাশে সাদা মেঘ সাঁতার কাটে। ফুরফুরে বাতাস আর চারপাশে সি-ফুডের মোহনীয় ঘ্রাণ, রেস্তোরাঁগুলোয় পর্যটকদের টানা আনাগোনা। সব মিলিয়ে স্বপ্নরাজ্যের চেয়ে কম কিছু না। কিন্তু এসবে নয়, ফ্লোরিডার পুরো ট্যুর জুড়েই আমার চোখ ছিল অন্য এক গন্তব্যে– দালি মিউজিয়ামে!
মিউজিয়ামটা সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের ডাউনটাউনে। শহরটা অনেক পুরোনো, ১৮৮৮ সালে জন সি.
পরের দিন সকাল ঠিক দশটায় মিউজিয়াম খোলামাত্রই সেখানে উপস্থিত হলাম। চারপাশের সাদা দেয়াল ঘেরা মিউজিয়ামের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছিল নীল রঙের গম্বুজ, সেখানে ছায়া পড়েছে আকাশের। মিউজিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম, মনে একইসাথে ভালো লাগা ও অস্থিরতা কাজ করছে। তবে ভেতরে ঢোকার লাইনে দাঁড়াতেই হকচকিয়ে যেতে হলো। সকাল দশটাতেই দর্শনার্থীর দীর্ঘ লাইন। এবং প্রায় সবার পরনে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক। যেন সবাই কোনো আনন্দ উৎসবে এসেছে। লম্বা ফার কোট, সাথে রঙিন স্কার্ফ, উজ্জ্বল রঙের গাউন, বাহারি স্কার্ট-টপসহ বড় কোনো রেস্তোরাঁয় যাবার মতো পরিপাটি পোশাক পরে আছে, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ প্রায় সকলেই। নিজেদেরই বরং মনে হলো খুব সাদামাটা। কিন্তু পোশাকে মনোযোগ দেবার কোনো বাড়তি সময় আমার ছিল না। আমার চোখে শুধু ভাসছিল, দালির আত্মবিশ্বাসী শীতল দৃষ্টি, অদ্ভুত গোঁফের বাঁক, এবং বাস্তবতার সীমানা ভেঙে দেওয়া তাঁর চিত্রকর্মগুলো; যা আমি শুধু অনলাইনেই দেখেছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাচ্ছিলাম সালভাদর দালি মিউজিয়াম শুধুই একটি সংগ্রহশালা নয়– এটি যেন বাস্তব আর কল্পনার মাঝের এক সেতু, যেখানে পদক্ষেপ ফেলামাত্রই মনে হয়, পরিচিত পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে প্রবেশ করেছি এক স্বপ্নময় জগতে। চারপাশের স্থাপত্য, শিল্পকর্ম, আলো-ছায়ার খেলা– সবকিছুই যেন দালির সৃষ্টির প্রতিচ্ছবি। যেন তিনি এখনও আছেন, আমাদের মনশ্চক্ষুর সামনে নতুন এক বাস্তবতা উন্মোচন করে চলেছেন।
জাদুঘরের বিশাল কাচের “এনিগমা” গম্বুজটা দেখে এরপর মনে হলো, এ যেন এক স্বপ্নের দরজা– যেখান দিয়ে ঢুকলে সময়ের ধারণাটাই বদলে যায়। সর্পিল সিঁড়িগুলো যেন আমাদের সরাসরি নিয়ে যায় অবচেতন আর বাস্তবতার মিলনবিন্দুতে। পুরো পরিবেশটাই এমন যে, মনে হবে আমি কোনো জাদুকরি দৃশ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটছি– যেখানে বাস্তব বস্তু গলে পড়ছে, রংগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে, আর যুক্তির বাঁধন ছিঁড়ে কল্পনার সীমানা বিস্তৃত হচ্ছে অনন্তের দিকে।
জাদুঘরের একটি দারুণ ইন্টারঅ্যাকটিভ অংশ হলো AI-জেনারেটেড “ড্রিম ট্যাপেস্ট্রি”, যেখানে দর্শনার্থীরা নিজেদের স্বপ্ন লিখলে তা ডিজিটাল চিত্রকলায় রূপ নেয়। আমি লিখলাম: “Having a profound conversation with Dali on the beach on a beautiful day.” কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার লেখা পরিণত হলো এক অপূর্ব দৃশ্যে। নীল আকাশের নিচে শান্ত সমুদ্র, বালির ওপর বসে থাকা এক নারী, আর সামনের ঢেউয়ে ভাসতে থাকা লাল লবস্টার। প্রথমে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম, তারপর মনে এলো এই ছবিতে দালি কোথায়? আমি যদি সেই নারী হই, তাহলে দালি কোথায়?
তখনই মনে পড়ল দালির বিখ্যাত “Lobster Telephone”, যেখানে টেলিফোনের রিসিভারের জায়গায় বসানো ছিল একটি লাল লবস্টার। হয়তো আমার ছবিতেও সেই রূপকটাই ধরা পড়েছে। আমি আর লবস্টারটি যেন আলোচনায় নিমগ্ন, কিন্তু আমাদের কথোপকথন বুঝতে হলে যুক্তির জগৎ ছেড়ে কল্পনার ভেতর ডুব দিতে হবে।
এরপর আমরা দেখলাম পনেরো মিনিটের একটি তথ্যচিত্র–“Surrealism was saved and spread by Dali.” সেখানে বলা হয়, মানুষের অচেতন ও অযৌক্তিক মনই হলো সুররিয়ালিজমের প্রকৃত উৎস। বাস্তবের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে, যেখানে চিন্তা প্রবাহিত হয় অবাধে, সেখানেই জন্ম নেয় পরাবাস্তবতা।
এরপর শুরু হলো সেই মুহূর্তের মুখোমুখি হওয়া, যার জন্য আমি বহুদিন ধরে উন্মুখ হয়ে ছিলাম– দালির আঁকা চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়ানোর মুহূর্ত। ছবিগুলো যখন একে একে দেখতে শুরু করলাম মনে হলো আমি এবং বাকি সবাই অন্য জগতে প্রবেশ করেছি। যেখানে দালির অন্তর্গত চিন্তার পথে আমরা হাঁটতে পারছি। গ্যালারিতে ছিল প্রায় ৯৬টি তেলচিত্র, ১০০-রও বেশি জলরং ও অঙ্কন, ১৩০০ গ্রাফিকস, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য এবং বিভিন্ন শিল্পকর্ম।
আমরা সবাই হাঁটছিলাম, একের পর এক ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম, তারপর হারিয়ে যাচ্ছিলাম রঙের আর ব্যাখ্যাতীত রূপকের ভেতর। বিশেষ করে কিছু মাস্টারপিস, যেগুলোর সামনে এসে আচ্ছন্ন হয়ে উঠছিলাম। আমি ছাড়াও আমার চারপাশের প্রায় সবার অনুভূতি ছিল একইরকম। ফিসফিস করে তারাও সাথে নিয়ে আসা সঙ্গী কিংবা কিউরেটরকে বলছিল দালির চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হবার কথা। একে একে দেখলাম, দ্য হ্যালুসিনোজেনিক টোরাডর, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, স্থির জীবনের দ্রুত গতি, নতুন মানবের জন্ম দেখা ছোট্ট শিশু ও সেই গলিত ঘড়ির ছবি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা ঘুরে বেড়ালাম এক গ্যালারি থেকে অন্য গ্যালারিতে। ছবিগুলো আমাদের শুধু মুগ্ধই করেনি, একইসাথে শিহরিত করছিল।
এক মধ্যবয়স্ক নারী আচমকা আমাকে বলে বসেছিল, ‘দালির ছবিগুলো কত আধুনিক অথচ তাঁকে সে সময় লোকে উন্মাদ বলত। কী ভয়াবহ ব্যাপার, ভাবা যায়? আরেকজন বৃদ্ধ আমার খুব কাছে এসে বলে গেল, ‘চিন্তা করতে পারো? দালি এমন এক শিল্পী, যে নিজের উদ্ভট সব চিন্তার ছবি এঁকে আমাদের দেখিয়েছেন এবং আমরা রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, টাকাপয়সা খরচ করে সেই উদ্ভট চিন্তা দেখতে আসছি।’ এটুকু বলেই বৃদ্ধটি আবার নিজের ভাবনার জগতে উঁকি দিতে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। আর আমিও তখন বুঝতে পেরেছিলাম দালির শিল্পকর্ম দেখতে আসা সব মানুষের পোশাকে কেন এত প্রস্তুতি। কারণ তারা শুধু মিউজিয়াম দেখতেই আসেনি। একইসাথে এসেছে চিন্তা করতে এবং দালির উন্মাদনা, পরাবাস্তবতার বিচিত্র জগতে বিচরণ উদযাপন করতে। অন্যান্য বহু আর্ট মিউজিয়াম যেখানে শান্ত, মোলায়েম ও নীরব সময়ের স্বাদ এনে দেয়। দালি মিউজিয়ামের আবহ সেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে সবকিছু চলমান, আধুনিক, রঙিন ও প্রযুক্তির সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে জড়িত। এখানে অন্যরকম এক উন্মাদনা আছে। যারা দেখতে এসেছে তাদের সবার মাঝেই। যেন দালি সুররিয়ালিজমের সেই সুর ছড়িয়েছেন সকলের মাঝে।
দালি মিউজিয়ামে তাঁর শিল্পকর্ম দেখার পাশাপাশি তাঁর দর্শন ও সৃষ্টিশীলতা অনুভবের জন্য ছিল বিষয়ভিত্তিক বাগান পরিদর্শন, ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে দালির স্বপ্নময় দুনিয়ায় প্রবেশ। “সুররিয়াল নাইট” ইভেন্ট: সংগীত, আলো, আর দালির সৃষ্টিশীল থিমের মিশেলে তৈরি ব্যতিক্রমী রাত। “দালি অ্যালাইভ” ইমারসিভ এক্সপেরিয়েন্স: যেখানে দর্শনার্থীরা দালির শিল্পের ভেতর হারিয়ে যেতে পারবে এবং ছিল এক অদ্ভুত ‘বৃষ্টিস্নাত ট্যাক্সি’; যা মিউজিয়ামের পরামর্শক ইভোন মারুলিয়ে উপস্থাপন করেছেন নতুন করে। যার লক্ষ্য ছিল আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দালির আসল ‘রেইনি ট্যাক্সি’-র প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। এমনকি রোলস-রয়েস সেদানকা গাড়িটিকে দালির স্মরণেই বলা হয়েছিল ‘রেইনি রোলস’।
সব মিলিয়ে দালির মিউজিয়ামকে মনে হলো যেন একসময়-সিন্দুক, যেখানে তাঁর পাগলামি, দার্শনিকতা এবং সৃজনশীলতা এখনও প্রতিধ্বনিত হয়ে যাচ্ছে। মিউজিয়াম ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। চলে যাবার মুহূর্তে লাগোয়া গিফট শপ থেকে কিছু পোস্টকার্ড, ম্যাগনেট ও স্টিকার কিনে নিলাম নিজের ও বন্ধুদের জন্য। বের হয়ে যাবার সময় মনে হলো, ভেতরে যাবার পর সত্যিই সময়জ্ঞান হারিয়েছিলাম। সেইসাথে এমন এক মানসিক অভিযাত্রা করে এলাম, যেখানে দালির বিচিত্র জগৎ মানুষে কল্পনার দরজা ও বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারপর চিন্তার সীমানা ভেঙে মনে করিয়ে দেয়– শিল্পকলা এমন এক গভীর শক্তিশালী মাধ্যম, যা আমাদের সকল বিপন্নতার মাঝে এক অমলিন আলো হয়ে আকস্মিকভাবে প্রাণ এনে দিতে পারে, আমাদের অস্তিত্বের নতুন অর্থ উন্মোচন করতে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র চ ত রকর ম ব স তবত র শ ল পকর ম র স মন আম দ র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।
অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আরো পড়ুন:
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।
‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’
তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।
‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’
একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’
তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’
বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা//