মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক দাঙ্গার রাজনৈতিক হিসাব
Published: 20th, April 2025 GMT
মধ্য পশ্চিমবঙ্গের বিশালকায় মুর্শিদাবাদ জেলায় গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরে তিনজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কার্যত শুরু হয়ে গেল আগামী বছর রাজ্যের অষ্টাদশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি। যেকোনো রাষ্ট্রে, রাজ্যে বা জেলায় আলোচনার জন্য যখন মধ্যপথ খোলা থাকে না এবং রাজনীতি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক—ইংরেজিতে ‘সেক্টেরিয়ান’ হয়ে দাঁড়ায়, তখন হিংসা ও ধ্বংস অনিবার্য। বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে, পশ্চিমবঙ্গকে সেই হিংসার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, ইতিমধ্যেই যা শুরু হয়ে গেছে। শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
ইংরেজিতে আরও একটি শব্দবন্ধ আছে, ‘আন-আইডেন্টিফায়েড মিসক্রিয়েন্টস’, অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী। এই শব্দবন্ধ না থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রশাসন চালানো যেত কি না, তা গবেষণার বিষয়। যা হবে সেটাই ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী’র ওপর চাপিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। কারও দায় নেই, সব দায় ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী’র। এই পরিচয়হীন দুষ্কৃতী যদি না থাকত, তাহলে বলতে হতো যাবতীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা কে ঘটাচ্ছে। সে কোন দল, গোষ্ঠী বা সংগঠনের প্রতিনিধি, আর কেনইবা তার পরিচয় গোপন করে সমাজের জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করে চলেছে। প্রশাসনের সমস্যাও বাড়ত।
মুর্শিদাবাদে ১১ ও ১২ এপ্রিল দাঙ্গা ও হত্যার পর আবার সেই ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী’ মহাশয়ের কথা শোনা গেল। এই দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া দুষ্কর। গত ৩০ বছরের সাংবাদিক জীবনে ভারতের ছোট-বড় গোটা পনেরো দাঙ্গার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে বুঝেছি, কেন দাঙ্গা হয়েছিল এবং কে বা কারা ঘটিয়েছিল, তা কোনো সাংবাদিকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কারণ, এর জন্য যতবার ঘটনাস্থলে যাওয়া প্রয়োজন বা যত অর্থ ব্যয় করে দীর্ঘ তদন্ত করা প্রয়োজন, তা এককভাবে একজন সাংবাদিক বা দক্ষিণ এশীয় সংবাদ সংস্থার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রশাসন বা হয়তো বড় বেসরকারি নাগরিক সংগঠন এ কাজ করতে পারে, যদি তারা রাজনৈতিক চাপ অগ্রাহ্য করতে পারে, যা বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
দাঙ্গার পর সাধারণত কী হয়
সাধারণত দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার পর ভারতে স্থানীয় মানুষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করেন অর্থাৎ হিন্দুরা মুসলমানের দোষ দেন এবং মুসলমানরা হিন্দুদের দোষ দেন। পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতেও এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘পার্টি সোসাইটি’ হওয়ার কারণে এখানে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের দোষ দেয় এবং তৃণমূল বিজেপির দোষ দেয়। এভাবেই দাঙ্গার দায় নির্ধারণের ঐতিহ্য অব্যাহত। সাংবাদিকেরা সাধারণত ঘটনাস্থলে এক বা বড়জোর দুই দিন থাকেন, ছবি তোলেন এবং কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর সব দিক বাঁচিয়ে একটা প্রতিবেদন লেখেন।
স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে নানা ফাঁক থাকে, যেটা এক বা দুই দিনে ধরা সম্ভব হয় না। মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রেও তা–ই। মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, তখন হঠাৎ ঘটে না। একটা প্রস্তুতি থাকে। সেই প্রস্তুতি কে নিয়েছিলেন ও কেন নিয়েছিলেন, সেটা সাধারণত পাঠকের কাছে অধরাই থেকে যায়। প্রশাসন ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী’কে দোষ দেয় এবং বাধ্য হয়েই মানুষকে সেটা মেনে নিতে হয়।
কিন্তু রাজনৈতিক দলের এভাবে মেনে নিলে চলে না। তাদের অপর পক্ষকে দোষ দিতে হয় এবং সেভাবেই মুর্শিদাবাদে এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষ দিচ্ছে। ধরে নেওয়া যেতেই পারে, এভাবেই বেশ কিছু ঘটনা আগামী এক বছরে ঘটবে এবং দোষারোপের বহর বাড়বে। যাদের জেতার সম্ভাবনা নেই (বাম ফ্রন্ট এবং কংগ্রেস), তারা চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ—দুই পক্ষকেই দোষ দেবে।
কিন্তু দাঙ্গার দায়িত্ব কার
এর বাইরে অর্থাৎ অজ্ঞাতপরিচয় কারও ওপর দোষ চাপিয়েও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্নটি হলো নির্দিষ্ট অঞ্চলে, রাজ্যে বা ওই দেশে কে বা কারা দাঙ্গার সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন, তারা কি দায় এড়াতে পারেন? গুজরাট, উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ—ভারতের সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে এবং নিশ্চিতভাবে কোথাওই শাসক দল দায়িত্ব এড়াতে পারে না। উত্তর প্রদেশ, গুজরাটে যেমন বিজেপি পারে না, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে পারে না তৃণমূল কংগ্রেস।
ওপরের অনুচ্ছেদ থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে যে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত সরকার মুর্শিদাবাদের ঘটনার জন্য দায়ী। এর কারণ শুধু এটা নয় যে ২০১১ সাল থেকে তারা রাজ্যে ক্ষমতায় আছে। অন্য কারণ আছে।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় প্রত্যেকেই তৃণমূলের নেতা। বিজেপির প্রভাব সামান্যই। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব কতটা গভীর, সেটা দেখে নেওয়া যাক। গত সপ্তাহান্তের সহিংসতার কেন্দ্রস্থল জঙ্গিপুর মহকুমাসহ গোটা
মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূল ২০২৪ সালে তিনটি সংসদীয় আসনের তিনটিতেই জিতেছিল। জেলার ২২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০টি বর্তমানে শাসক দলের দখলে; জেলার ২৬টি পঞ্চায়েত সমিতির সব কটি তৃণমূলের। একইভাবে মোটামুটি ২৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় প্রতিটি তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণাধীন। শহরাঞ্চলের ৮টি পৌরসভার মধ্যে ৭টি তৃণমূলের। যে পৌরসভাটি (ডোমকল) দখলে নেই, সেটিও প্রশাসক হিসেবে চালাচ্ছেন তৃণমূলের এক বিধায়ক। অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের সংঘাতের জন্য বিজেপিকে দায়ী করা যাচ্ছে না। কারণ, নির্বাচনী রাজনীতিতে গেরুয়া পার্টির প্রায় কোনো অস্তিত্বই জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য মুর্শিদাবাদে (৭০ লাখের ওপর) নেই।
কিন্তু রাজনীতি সাম্প্রদায়িক চেহারা নিলে তার সুবিধা আবার মূলত পায় বিজেপি। এর প্রধান কারণ যখন পুরোপুরি ভোটের মেরুকরণ হয়ে যায়, অর্থাৎ ভোটাররা যখন রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় চরিত্রের কথা মাথায় রেখে ভোট দেন, তখন প্রধানত লাভ হয় হিন্দুত্ববাদী দলের। কারণ, ভারতে প্রায় সর্বত্রই হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর যেহেতু ভারতের প্রধান হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি, ফলে হিন্দু-মুসলমান লাইনে ভোট হলে তার সুবিধা পায় বিজেপি। মুর্শিদাবাদের মতো ঘটনা এ ধরনের মেরুকরণে গোটা রাজ্যে সাহায্য করে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যখন প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটেছিল, তখন বিজেপি মোট ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮টি পেয়েছিল। নির্বাচনী পরিসংখ্যানবিদেরা বলেছিলেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি হিন্দু ভোটের ২১ শতাংশ পেলেও ২০১৯ সালে পেয়েছিল ৫৭ শতাংশ; অর্থাৎ বিজেপির হিন্দু ভোট একলাফে ৩৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম লাইনে ভোট না হলে বিজেপির ভোট এতটা বাড়ত না। পরবর্তী দুটি নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু ভোটের বড় অংশ নিজের দিকে টানতে পেরেছিলেন। ফলে বিজেপি তাদের ২০১৯-এর ফলের পুনরাবৃত্তি গত ছয় বছরে করতে পারেনি।
কিন্তু বিজেপি জানে যে সাম্প্রদায়িক লাইনে ভোট হলে তাদের হিন্দু ভোট বাড়ে, ফলও ভালো হয়। আশা করা যায়, আগামী দিনে তারা সেই লক্ষ্যেই কাজ করবে এবং যত করবে, তত সমাজ আরও ‘সেক্টেরিয়ান’—গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়বে হিংসা, দ্বেষ, সংঘাত। আহত হবেন সাধারণ মানুষ, মৃত্যুও হবে অনেকের। স্বাভাবিকভাবেই দায়ী করা হবে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী এক বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা কীভাবে সামলান, সেদিকে নজর থাকবে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গোটা ভারতের। বাংলাদেশেরও।
● শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ত র জন ত ক ম সলম ন স ধ রণত র জন য র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন
চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।
লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।
লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।
প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।
লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’
তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?