পেটেই থাকতে মেয়েশিশু নষ্ট করতে চেয়েছিলেন স্বামী, জন্মের পর বিক্রি করেছেন মা
Published: 21st, April 2025 GMT
স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতন আর অভাবের তাড়নায় মেয়েশিশু বিক্রি করে দিয়েছেন এক মা। সাতক্ষীরার আশাশুনির একটি গ্রামে তিন মাসের বেশি সময় আগে ঘটলেও তা জানাজানি হয়েছে গতকাল রোববার। শিশুটিকে কিনে নেওয়া দম্পতি তার নাম রেখেছেন রাফিয়া জান্নাতুল। নতুন মা-বাবাই নন, শিশুটিকে নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মেতে আছেন।
শিশুটির মা-বাবার নাম আশামনি খাতুন ও শামিম হোসেন। সাড়ে চার বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। শামিম পেশায় দিনমজুর। তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাঁদের ঘরে আসে একটি কন্যাসন্তান।
শিশুটির নানি মনোয়ার খাতুন জানান, দ্বিতীয়বারের মতো মেয়েসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর থেকে কারণে-অকারণে আশামনিকে মারধর করতেন শামিম। খেতে দিতেন না। এ অবস্থায় গত ৭ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে তাঁদের আরও একটি কন্যাসন্তান হয়। হাসপাতাল থেকে ১৫ জানুয়ারি ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় আশামনিকে আর ভরণপোষণ দিতে পারবেন না বলে জানান শামিম। তাঁকে মৌখিকভাবে তালাক দেওয়া হয়। এ অবস্থায় সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে আশামনি তাঁর মেয়েশিশুটিকে একই উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের চায়ের দোকানি রবিউল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী কাজল খাতুনের কাছে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।
কাজল খাতুন জানান, ২০১৩ সালের ৬ জুন তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ১১ বছর পার হয়ে গেলেও তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। এ জন্য তাঁদের একটি সন্তানের চাহিদা ছিল। ২৮ জানুয়ারি কাজল খাতুনকে হামকুড়া গ্রাম থেকে তাঁর মা মাজেদা খাতুন মুঠোফোনে জানান, তাঁদের বাড়ির সামনে একজন মা তাঁর একটি শিশুকে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন। দুধ কেনার সামর্থ্য নেই ওই মায়ের, তিনি সন্তান বিক্রি করতে চান। এই কথা শুনে স্বামী রবিউল ইসলামকে নিয়ে ওই দিনই বাবার বাড়িতে গিয়ে তাঁরা নবজাতকের মা আশামনির সঙ্গে কথা বলেন। তিনি শিশুটিকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে রাজি হন। পরে শিশুটির বাবা শামিম হোসেনের সঙ্গেও মুঠোফোনে কথা বলেন তাঁরা। সন্তান বিক্রিতে তিনিও কোনো আপত্তি জানাননি। পরের দিন ২৯ জানুয়ারি ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে উভয় পক্ষের স্বাক্ষরসহ শিশুটিকে ২০ হাজার টাকায় কিনে নেন বলে জানান কাজল খাতুন।
নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের ওপরে লেখা রয়েছে ‘দানপত্র’। নিচে আশামনির বয়ানে লেখা রয়েছে, ‘বাচ্চার প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। আমার বাচ্চা আমি স্বেচ্ছায় আপনাদের দিয়া দিলাম। আমার বাচ্চার গার্জেন শুধু আমি। আমার স্বামী বাচ্চার কোনো খোঁজখবর নেয় না। আমার স্বামী মেয়ে হবে, জানতে পেরে ছয় মাসে আমার বাচ্চা নষ্ট করতে চেয়েছিল। জানতে পেরে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আমি বাচ্চা রেখে দিয়েছি। তাই আমি আমার এক বোনকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার বাচ্চা দিয়ে দিলাম। আমি খুব অসুস্থ, তাই ডাক্তার দেখানোর জন্য এ টাকা নিলাম। আমার দেখার ইচ্ছা হলে বাচ্চা দেখতে যেতে পারব।’
আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাদাকাটি গ্রামে আশামনির মা মনোয়ারা খাতুনের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, আশামনি মায়ের সঙ্গে প্রথম মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। বাড়িতে তাঁকে পাওয়া যায়নি। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও তিনি সামনে আসেননি। প্রতিবেশীরা বলেছেন তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। আশামনির বাবার সঙ্গে মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়েছে অনেক আগে। পরিবারটিতে হাল ধরার কেউ নেই।
শামিম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আশামনির মা মনোয়ারা জানান, তাঁর মেয়ে দ্বিতীয়বার কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর শামিম কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না। মৌখিকভাবে তালাক দিয়েছেন। মনোয়ারা খাতুনের দাবি, শামিম আশামনিকে নিয়ে পাঁচটি বিয়ে করছেন। প্রত্যেককে তালাক দিয়েছেন।
শিশুটিকে কিনে নেওয়া তেঁতুলিয়া গ্রামের দম্পতির বাড়িতে গিয়ে রবিউল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। কাজল খাতুনের মামিশাশুড়ি বিলকিস ও আসমা খাতুন জানান, রাফিয়া জান্নাতুলকে নিয়ে রবিউল ও কাজল দম্পতি খুবই ভালো আছেন। মেয়ের জন্য প্রতিদিন আড়াই শ টাকার দুধ লাগছে। এ জন্য কাজল সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। আর প্রতিবেশীরা মিলে প্রতিদিন দুধ কিনে দিচ্ছেন। চায়ের দোকান ভালো চলছে না বলে নতুন মেয়ের জন্য রবিউল নওগাঁয় শ্রমিকের কাজ করতে গেছেন।
বিষয়টি নজরে আনা হলে আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামছুল আরেফিন জানান, ঘটনাটি গত জানুয়ারি মাসের। তিনি ১৫ এপ্রিল এ থানায় যোগ দিয়েছেন। শোনার পর ঘটনাস্থলে একজন উপপরিদর্শককে আজ সোমবার দুপুরে পাঠিয়েছেন। কেউ সন্তান বিক্রি করতে পারে না, দত্তক দিতে পারে। তবে কারও যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, সে ক্ষেত্রে সেখানে কিছু করার থাকে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০ হ জ র ট ক আম র ব চ চ মন য় র অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।