সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ফিরে চায় বিটিআরসি
Published: 22nd, April 2025 GMT
গঠনের পর থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। ২০১০ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা খর্ব করে সংস্থাটিকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে এই সংস্থা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিটিআরসি স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ফিরে পেতে চাচ্ছে। এ জন্য টেলিযোগাযোগ আইনের সংশোধন বাতিল চেয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বিটিআরসি। একই সঙ্গে সংস্থাটি ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে।
কী ছিল সংশোধনীতে
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড অধ্যাদেশের মাধ্যমে টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড গঠিত হয়। অধ্যাদেশটি ১৯৯৫ সালে সংশোধন করা হয়। ২০০১ সালে প্রণিত হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন। এই আইনের অধীনে ২০০২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিটিআরসি যাত্রা শুরু করে। আইনটি ২০১০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে বিটিআরসির ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করা হয়।
২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের প্রস্তাবনায় বলা ছিল, ‘যেহেতু বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং টেলিযোগাযোগ সেবা নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা, কার্যাবলি ও দায়িত্ব কমিশনের কাছে হস্তান্তর এবং আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন, সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’ ২০১০ সালে আইন সংশোধন করে প্রস্তাবনা অংশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ‘ক্ষমতা’ পরিবর্তন করে ‘কতিপয় ক্ষমতা’ করা হয়।
আইনের ৩১ ধারায় কমিশনের ক্ষমতা বিষয়ে বলা ছিল, কমিশন টেলিযোগাযোগ সেবা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স প্রদান, তা বাতিল করা, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, টেলিযোগাযোগ সেবার ট্যারিফ, কলচার্জ নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। এই ক্ষমতা আংশিক খর্ব করে সংশোধিত আইনে লাইসেন্স দেওয়ার, লাইসেন্স হস্তান্তর বা বাতিল করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান করা হয়। মূল ১ ধারায় শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন’। ২০১০ সালে এটা পাল্টে করা হয় ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন’। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সেই সময় এ ধরনের আইন সংশোধনের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
বিটিআরসির উদ্যোগ
১৬ এপ্রিল বিটিআরসি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে একটি পত্র দেয়। সংস্থাটির মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুণ্ডু স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে বলা হয়, টেলিযোগাযোগ খাতে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করা অপরিহার্য, যা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত শতাধিক সদস্য রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করেছে। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন নীতিমালা, নির্দেশিকা, গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক। কিন্তু ২০১০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সরকারের পূর্বানুমোদন-সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা হয়। এতে লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, লাইসেন্সের নাম পরিবর্তন এবং ট্যারিফ অনুমোদনসহ বিভিন্ন অপারেশনাল কাজে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধের সংস্কৃতির বিষয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন।
সংশোধিত আইন ২০১০ দ্রুত বাতিল করার জন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি। পাশাপাশি ২০০১ সালের আইন যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিচ্ছে বিটিআরসি।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী গত শনিবার এক সেমিনারে বলেন, টেলিযোগাযোগ আইন যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত খসড়া
সূত্র জানিয়েছে, ২০০১ সালের আইনের সংশোধনে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৮৭তম কমিশন সভায়। কমিটি গত জানুয়ারি মাসে একটি সংশোধিত খসড়া কমিশনে জমা দেয়। কমিশন গত ১৩ জানুয়ারি এই খসড়া অনুমোদন করে টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠায়। এখন তা মন্ত্রণালয়ে আটকে রয়েছে।
খসড়ায় আইনের ২ ও ১৮ ধারা সংশোধন করে ওটিটি, ডিজিটাল সেবা, ভ্যালু এডেড সার্ভিস ইত্যাদি নতুন প্রযুক্তি ও সেবা-সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের পরিবর্তে কমিশন যুক্ত করা হয়েছে। সরকারের পূর্বানুমোদনের শর্ত বাদ দেওয়া হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ট আরস ট ল য গ য গ আইন ২০০১ স ল র ২০১০ স ল র ক ষমত সরক র র ব ট আরস ক ত কর আইন র গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
মাদক মামলার আসামি, দিয়েছেন ‘জাল’ সনদ, তবু তিনি স্কুল কমিটির সভাপতি
চট্টগ্রামে মাদক মামলার এক আসামিকে বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সভাপতির যোগ্যতা পূরণ করতে স্নাতকের ‘জাল’ সনদ ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর গোমদণ্ডী উচ্চবিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলীকে ঘিরে এসব অভিযোগ ওঠে। গত ২৪ মার্চ চার সদস্যের এই অ্যাডহক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।
ছয় মাসের জন্য চার সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেন বোর্ডের তৎকালীন বিদ্যালয় পরিদর্শক বিপ্লব গাঙ্গুলী। পদাধিকারবলে কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে। অন্য দুই সদস্য হলেন শিক্ষক প্রতিনিধি আলিম উদ্দিন ও অভিভাবক প্রতিনিধি মো. ইউছুপ মিয়া চৌধুরী।
বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটি সাধারণত কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারেন না। তবে বিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনে তাঁর সই প্রয়োজন হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক মামলা থাকলে সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা শিক্ষার্থীদের জন্য নেতিবাচক বার্তা দেবে। পাশাপাশি একটি ‘জাল’ সনদ দিয়ে একটি কমিটিতে আসা বোর্ডের দায়িত্বের অবহেলার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর বোয়ালখালীতে এক হাজার লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন কান্তি দে বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে এসআই রহমত উল্লাহ মোহাম্মদ আলীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এ মামলায় ২০২২ সালের ২২ জুলাই মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। বর্তমানে মাদক মামলাটি বিচারাধীন।
নিয়ম অনুযায়ী সভাপতি হতে মোহাম্মদ আলী স্নাতকের যে সনদ জমা দিয়েছেন, সেটিও ‘জাল’ বলে জানা গেছে। আবেদনের পর সব সনদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অ্যাডহক কমিটির সদস্যসচিব এ কে এম হারুন। এরপর বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ সেটি জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠিয়ে দেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শরীফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ধরনের অভিযোগ থাকলে সেটি বোর্ডে জানানোর সুযোগ আছে। মূলত প্রধান শিক্ষকের পাঠানো তালিকাটি ডিসি স্যারের (জেলা প্রশাসক) সঙ্গে আলোচনা করে বোর্ডে পাঠানো হয়। বোর্ডই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তালিকা পাওয়ার পর কেউ অভিযোগ করলে আমরা খোঁজখবর নিয়ে থাকি।’
মোহাম্মদ আলী নিজেকে সাংবাদিক ও বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর ফেসবুক আইডিতে তিনি নিজেকে দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও বোয়ালখালী পৌরসভা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এবং দৈনিক আলোকিত শতাব্দীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেন।
যোগ্যতা পূরণে ‘জাল’ সনদ
গত বছরের ১৮ নভেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলীর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অ্যাডহক কমিটির সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা কলেজের ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর ও স্কুলের ক্ষেত্রে স্নাতক পাস। মোহাম্মদ আলী তাঁর দাখিল, আলিম ও স্নাতকের সনদ জমা দিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০০৩ সালে তিনি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন।
তবে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, এই নামে কোনো বিভাগ তাঁদের নেই। যেটি আছে, সেটির নাম ইসলামিক স্টাডিজ। এটি চালু হয়েছে ২০১০ সালে। বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুন্নবী বলেন, ‘এই নামে কোনো বিভাগ আমাদের নেই। ২০১০ সালে ইসলামিক স্টাডিজ চালু হয়েছে। সনদটি ফেইক (জাল) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
জানতে চাইলে উত্তর গোমদণ্ডী উচ্চবিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ১টি নয়, ১৭টি মামলা আছে। মাদকের মামলাটিও রাজনৈতিক। আমি ঘটনা জেনেছি চার্জশিট হওয়ার কয়েক মাস পর। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমি জামিন নিয়েছি। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মাদক মামলাটি সামনে আনা হয়েছে।’
২০১০ চালু হওয়া বিভাগ থেকে ২০০৩ সালে কীভাবে সনদ পেলেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এগুলো অনেক আগের পুরোনো ফাইল। সভাপতি মনোনয়নের সময় আমি খুঁজে সনদের ছবি তুলে দিয়েছি। আমি কোনো আর্থিক লাভের জন্য সভাপতি হয়নি।’
বেসরকারি বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২৪ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের) গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা অনুযায়ী। চট্টগ্রাম বোর্ডের এই প্রবিধানমালা অনুযায়ী, অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হবে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত। সভাপতির জন্য তিনজন মনোনীত ব্যক্তির তালিকা বোর্ডে পাঠাতে হবে।
চট্টগ্রাম বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আবুল কাসেম বলেন, চার্জশিটভুক্ত আসামি হলে কোনোভাবেই সভাপতি থাকতে পারবে না। সনদের জালিয়াতির বিষয়টি এড়ানোর সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হবে যাচাই না করে তালিকা পাঠানোর জন্য।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক হলেন আখতার কবীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানে একজন মাদক ব্যবসায়ী ও যাঁর সনদ প্রশ্নবিদ্ধ তাঁকে সভাপতি করে আমরা শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিচ্ছি, সেটি প্রশ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, বোর্ড এটি জানার পর ব্যবস্থা নেবে।’