শিক্ষাজীবনে ডিগ্রি পাস করা আছিয়া বেগম (ছদ্মনাম) বর্তমানে গৃহিণী। স্বামী-সন্তান নিয়ে তাঁর সংসারজীবন। স্বামীরা তিন ভাই হলেও গ্রামের বাড়িতে থাকার কারণে শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখার ভার আছিয়ার কাঁধে পড়ে। গত তিন বছর ধরে তাঁর শ্বশুর অসুস্থ। বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন।
প্রথম দুই বছর সংসারের কাজ এবং দেখাশোনার কাজ একাই করতেন। এক সময় তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে তাঁর জন্য একজন সাহায্যকারী রাখা হয়। তবুও সংসারের বেশির ভাগ কাজ করতে হয় আছিয়াকে।
২০২৩ সালে আছিয়ার শ্বশুর মারা যান। আছিয়া খোঁজ পান ঢাকার কারওয়ান বাজারে বাংলাদেশ কেয়ারগিভিং এবং টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বিসিটিটিআই) কেয়ারগিভিং-এর প্রশিক্ষণ এবং জাপানি ভাষা শেখানো হয়। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, এ দুটো কাজ জানা থাকলে তিনি জাপানে চাকরি করতে পারবেন।
আছিয়া বেগমের কাছে কিছু টাকা ছিল। তিনি সে টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে জাপানে উচ্চ বেতনে কাজ পান। গত তিন বছরে শ্বশুরের জন্য বিনা বেতনে ভালোবেসে যে কাজ করেছেন আছিয়া, সেখানে তিনি সম্মান পাননি। সেই একই কাজ এখন দেশের বাইরে গিয়ে করতে পারছেন। সম্মান এবং টাকা দুটোই মিলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩ অনুযায়ী, কৃষিতে নারীর অবদান পুরুষের তুলনায় বেশি। নারীর কৃষি কাজে অবদান ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পুরুষের ১৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে, শিল্পকারখানা এবং হোয়াইট কলার কাজে নারীর অবদান শূন্যের কোঠায় না হলেও পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ কম। হোয়াইট কলার কাজ হলো, যারা ডেস্কে কাজ করেন।
পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা কাজ করছেন। তবুও নারীর সম্মান অধরা। অর্থনীতিতে কাঠামোগত কী পরিবর্তন করলে নারীর সম্মান বাড়তে পারে। এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী বলেন, ‘সম্মানের অনেক স্তর রয়েছে। নারীর সম্মান অবশ্যই বেড়েছে। তবে অর্থনীতিতে নারীর যে পরিমাণ অংশগ্রহণ, সে পরিমাণ সম্মান তারা পান না। তাদের এখন কথা বলার অধিকার হয়েছে। তারা মতামত দিতে পারেন। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কম। অবস্থার পরিবর্তন খুব ক্ষীণ হলেও, পরিবর্তন হচ্ছে। এটি রাতারাতি বেড়ে যাবে, ভাবা ভুল।
নারীর অনেক কাজ এখন জিডিপি এবং জিএসপিতে অবদান রাখছে। যেমন– হস্তশিল্প, কেয়ারগিভার এবং নানা ধরনের কায়িক শ্রমের কাজ। অনেক ক্ষেত্রে নারী রেমিট্যান্সযোদ্ধা হিসেবেও কাজ করছেন। তারা পিছিয়ে পড়ছেন দুটি কাঠামোগত কারণে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, নারী যে পরিমাণ শিক্ষিত সে অনুযায়ী চাকরিতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। প্রথমত, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা কাঠামোগতভাবে আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ফলে নারী যোগ্য হলেও যথাযথ কাঠামো না থাকার কারণে তাকে সে সব দায়িত্বে ডুবে যেতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নেই। যেমন ব্যবসাক্ষেত্রে চাঁদাবাজি বা একজন নারী সহজে যেন দোকান ভাড়া পান এবং নিরাপদে ব্যবসা করার পরিবেশ এগুলো নিশ্চিত করলে নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.
বিশ্বব্যাংকের ‘নারী, ব্যবসা ও আইন-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সমাজে নারীর আয় এখন আর সেকেন্ডারি বিষয় না, এটি অপরিহার্য। শুধু পারিবারিক ও সামাজিক প্রয়োজনে নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও দরকার। জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুসারে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৪ হাজার বেশি। দেশে সংখ্যায় নারী বেশি হলেও শ্রমক্ষেত্রে সুযোগ কম। অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যবসায় আসছেন। তারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকারও হচ্ছেন। তাদের অনেকেই পড়াশোনায় পিছিয়ে আছেন, মূলধন কম, সহজে ঋণ পাচ্ছেন না, আছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও পারিবারিক চাপ।
অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশ বাড়লেও কাজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও উপযোগী কাজের পরিবেশের অভাবসহ নানা কারণে নারীরা শ্রমবাজারের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। শহরে নারী ও পুরুষের কাজের অসমতার হার আগের চাইতে বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, কর্মদক্ষ নারীর যতজন শ্রমশক্তিতে থাকার কথা, ততটা নেই।
শহরাঞ্চলে অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হারানো নারীর একটা বড় অংশ গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্ন মজুরি বা মজুরি ছাড়াই পরিবারের কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে যুক্ত হচ্ছেন। তাদের অংশগ্রহণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না।
কৃষিক্ষেত্রে শ্রম কম মূল্যায়িত বলে সেখানে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। অথচ অসমতা দূর করতে হলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে শিল্প ও সেবা খাতে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা থেকে মুক্তি নাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, নারী কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে নারী বেশি বৈষ্যমের শিকার হন। একই কাজ নারী করলেও পুরুষের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পান।
এ প্রসঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য কল্পনা আখতার বলেন, ‘নারী আজ শিক্ষা, প্রযুক্তি ও কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। তারা দক্ষতা ও মেধার দিক থেকে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তবুও সমাজে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা এখনও অধরা। কর্মক্ষেত্রে নারীর পরিশ্রমকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না; বরং যৌনতা ও শারীরিক গঠনের মাধ্যমে তাদের বিচার করা হয়। নির্মাণকাজ কিংবা ইটভাটার মতো কঠিন শারীরিক পরিশ্রমে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও নারী পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পান, যা স্পষ্টভাবে বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ।’
এ সমস্যার মূল কারণ হলো– দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং জেন্ডার সচেতনতার অভাব। নারীর সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে সমাজে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, যেখানে নারীকে কেবল মেধাবী কর্মী হিসেবে নয়, একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখা হবে। কর্মক্ষেত্রে সমান মজুরি ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও স্বাস্থ্যজনিত প্রয়োজনকে সহানুভূতির সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে পারে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মনোভাবের পরিবর্তন, তবেই নারীর সম্মান নিশ্চিত হবে।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ও ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের প্রধান মাসুমা বিল্লাহ বলেন, ‘ছেলেরাও অনেকে শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে। তাদের একজন নারীর থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি আমাদের সমাজের সমস্যা। একটি ছেলে দিনে পাঁচবার সিগারেট খেলে সময় নষ্ট হয় না। অথচ নারী মাসে বিশেষ সময়ে অসুস্থ থাকলে প্রতিষ্ঠানের কাজের ক্ষতি হচ্ছে– এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।’ v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত করত র পর ব ক জ কর র জন য ব যবস অবদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।
১. এটাই জান্নাতের পথ
এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’
এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি
বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।
তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’
এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।
৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট
মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?
এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।
৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা
পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।
৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।
আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫৭. পালিয়ে যাওয়া
ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।
৮. সহনশীলতার খেলা
পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।
৯. অস্বস্তিকর আলাপ
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।
১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা
পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা
গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
১২. নিয়তের পবিত্রতা
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)
যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।
১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা
পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন
একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)
এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা
চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’
এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’
১৬. মায়ের শক্তি
আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।
১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত
আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।
১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট
পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।
২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব
এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪