সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেল, আবারও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষাবিদেরা এই পরীক্ষার ব্যাপারে এর আগেও আপত্তি জানিয়ে এসেছেন। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের পরীক্ষা কেন অপ্রয়োজনীয়, তার ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপন করেছেন। তারপরও কেন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা একেবারেই বোধগম্য নয়।

অনেক অভিভাবকের ধারণা, পরীক্ষা নেওয়া ভালো। কারণ, পরীক্ষার সূত্র ধরে শিক্ষার্থীরা অন্তত কিছু পড়ালেখা করে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের বড় অংশ পরীক্ষার ব্যাপারে নানা সময়ে এমন সব যুক্তি তুলে ধরেন, যেগুলো যথার্থ নয়। সেসব যুক্তি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে। তাই পরীক্ষার পক্ষে কথা বলার আগে প্রথমেই বোঝা দরকার পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়।

গত বছরও বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শেষ পর্যন্ত নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার কারণে এই পরীক্ষা আর হয়নি। এখন আবারও সেই আগের পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। তাঁরা কি নিজেদের বুদ্ধিতে, নাকি শিক্ষক আর গাইড-প্রকাশকদের সুপারিশ আর আগ্রহে আবার পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

একই সঙ্গে বোঝা দরকার, স্কুলগুলোতে এই পরীক্ষার উদ্দেশ্যই বা কতটুকু পূরণ হয়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা কোচিং আর প্রাইভেটমুখী হয়ে পড়েছে। এর ওপর যদি প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা চালু হয়, তবে এই কোচিং আর প্রাইভেট-বাণিজ্য আরও রমরমা হবে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হাতে গোনা দু-একজন বাদে শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীই কোচিং বা গাইড ছাড়া পড়াশোনা করতে পারে না। এখন অভিভাবকদেরও বোঝা দরকার, শিক্ষকের দেওয়া সাজেশন পড়ে বা প্রশ্নের উত্তর লিখে পরীক্ষায় হয়তো ভালো নম্বর পাওয়া যায়, কিন্তু শেখার আসল কাজটা হয় না।

কারও কারও ধারণা, বৃত্তি পরীক্ষা থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এই পরীক্ষা শিশুমনে বৈষম্যের ধারণাও তৈরি করে। একসময় স্কুলের শতকরা ৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বাড়তি যত্ন নেওয়া হতো। এদের কারণে শ্রেণির বাকি শিক্ষার্থীরা হীনম্মন্যতায় ভুগত। বাকিরা নিজেদের অযোগ্য বা অমেধাবী মনে করত। এখন যদি কেউ বৃত্তি পায়, আর কেউ না পায়, তবে অনেক শিক্ষার্থীই নিজেকে মেধাহীন মনে করতে পারে।

তা ছাড়া বাস্তবতা এই, আর্থিক সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি যতটুকু না মেধার, তার চেয়ে বেশি দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই পরীক্ষা নিয়ে বৃত্তি দেওয়ার চেয়ে এলাকাভিত্তিক দরিদ্র নির্ধারণ করে উপবৃত্তির ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। দারিদ্র্যের মাত্রা অনুযায়ী উপবৃত্তির পরিমাণও কমবেশি হতে পারে। সব শিশুর শিক্ষার অধিকার রয়েছে। দারিদ্র্যের কারণে যাতে কোনো শিশু এই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে কেন এত আগ্রহ, সেটিও একটি প্রশ্ন। ভেবে পাই না, তাঁরা কেন মনে করেন বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা বেশি পড়াশোনা করবে এবং এর ফলে শিক্ষার মান বাড়বে। নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে বেশি বেশি পড়ার সম্পর্ক নেই। যোগ্যতা অর্জনকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, তার প্রধানও মনে করেন, এই পরীক্ষা নেওয়া হলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। তিনি বলেন, এই পরীক্ষা নেওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য পরামর্শক কমিটির যেসব সুপারিশ আছে, সেগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।

অভিভাবকদেরও মাথায় রাখা দরকার, এভাবে পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা আর সার্টিফিকেট অর্জন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করে তুলবে না। বিষয়ভিত্তিক নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন না করলে পরবর্তী শ্রেণিগুলোতেও ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে পড়তে হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থায় নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার।

গত বছরও বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শেষ পর্যন্ত নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার কারণে এই পরীক্ষা আর হয়নি। এখন আবারও সেই আগের পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। তাঁরা কি নিজেদের বুদ্ধিতে, নাকি শিক্ষক আর গাইড-প্রকাশকদের সুপারিশ আর আগ্রহে আবার পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ক ষ পর ক ষ র ই পর ক ষ ব যবস থ য গ যত র জন য দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আবারও কেন বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড়

সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেল, আবারও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষাবিদেরা এই পরীক্ষার ব্যাপারে এর আগেও আপত্তি জানিয়ে এসেছেন। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের পরীক্ষা কেন অপ্রয়োজনীয়, তার ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপন করেছেন। তারপরও কেন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা একেবারেই বোধগম্য নয়।

অনেক অভিভাবকের ধারণা, পরীক্ষা নেওয়া ভালো। কারণ, পরীক্ষার সূত্র ধরে শিক্ষার্থীরা অন্তত কিছু পড়ালেখা করে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের বড় অংশ পরীক্ষার ব্যাপারে নানা সময়ে এমন সব যুক্তি তুলে ধরেন, যেগুলো যথার্থ নয়। সেসব যুক্তি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে। তাই পরীক্ষার পক্ষে কথা বলার আগে প্রথমেই বোঝা দরকার পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়।

গত বছরও বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শেষ পর্যন্ত নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার কারণে এই পরীক্ষা আর হয়নি। এখন আবারও সেই আগের পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। তাঁরা কি নিজেদের বুদ্ধিতে, নাকি শিক্ষক আর গাইড-প্রকাশকদের সুপারিশ আর আগ্রহে আবার পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

একই সঙ্গে বোঝা দরকার, স্কুলগুলোতে এই পরীক্ষার উদ্দেশ্যই বা কতটুকু পূরণ হয়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা কোচিং আর প্রাইভেটমুখী হয়ে পড়েছে। এর ওপর যদি প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা চালু হয়, তবে এই কোচিং আর প্রাইভেট-বাণিজ্য আরও রমরমা হবে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হাতে গোনা দু-একজন বাদে শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীই কোচিং বা গাইড ছাড়া পড়াশোনা করতে পারে না। এখন অভিভাবকদেরও বোঝা দরকার, শিক্ষকের দেওয়া সাজেশন পড়ে বা প্রশ্নের উত্তর লিখে পরীক্ষায় হয়তো ভালো নম্বর পাওয়া যায়, কিন্তু শেখার আসল কাজটা হয় না।

কারও কারও ধারণা, বৃত্তি পরীক্ষা থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এই পরীক্ষা শিশুমনে বৈষম্যের ধারণাও তৈরি করে। একসময় স্কুলের শতকরা ৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বাড়তি যত্ন নেওয়া হতো। এদের কারণে শ্রেণির বাকি শিক্ষার্থীরা হীনম্মন্যতায় ভুগত। বাকিরা নিজেদের অযোগ্য বা অমেধাবী মনে করত। এখন যদি কেউ বৃত্তি পায়, আর কেউ না পায়, তবে অনেক শিক্ষার্থীই নিজেকে মেধাহীন মনে করতে পারে।

তা ছাড়া বাস্তবতা এই, আর্থিক সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি যতটুকু না মেধার, তার চেয়ে বেশি দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই পরীক্ষা নিয়ে বৃত্তি দেওয়ার চেয়ে এলাকাভিত্তিক দরিদ্র নির্ধারণ করে উপবৃত্তির ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। দারিদ্র্যের মাত্রা অনুযায়ী উপবৃত্তির পরিমাণও কমবেশি হতে পারে। সব শিশুর শিক্ষার অধিকার রয়েছে। দারিদ্র্যের কারণে যাতে কোনো শিশু এই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে কেন এত আগ্রহ, সেটিও একটি প্রশ্ন। ভেবে পাই না, তাঁরা কেন মনে করেন বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা বেশি পড়াশোনা করবে এবং এর ফলে শিক্ষার মান বাড়বে। নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে বেশি বেশি পড়ার সম্পর্ক নেই। যোগ্যতা অর্জনকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, তার প্রধানও মনে করেন, এই পরীক্ষা নেওয়া হলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। তিনি বলেন, এই পরীক্ষা নেওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য পরামর্শক কমিটির যেসব সুপারিশ আছে, সেগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।

অভিভাবকদেরও মাথায় রাখা দরকার, এভাবে পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা আর সার্টিফিকেট অর্জন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করে তুলবে না। বিষয়ভিত্তিক নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন না করলে পরবর্তী শ্রেণিগুলোতেও ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে পড়তে হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থায় নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার।

গত বছরও বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শেষ পর্যন্ত নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার কারণে এই পরীক্ষা আর হয়নি। এখন আবারও সেই আগের পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। তাঁরা কি নিজেদের বুদ্ধিতে, নাকি শিক্ষক আর গাইড-প্রকাশকদের সুপারিশ আর আগ্রহে আবার পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সম্পর্কিত নিবন্ধ