ঈদের সকাল মানেই হাসি-আনন্দে ভরা এক রঙিন ছবি। মসজিদের পথে পুরুষদের সাদা জামা, নারীদের ফুলের মতো রঙিন পোশাক আর শিশুদের নতুন জামায় উচ্ছ্বাস—এই দৃশ্য যেন চিরকালের উৎসবের। অনেক পুরোনো না হলেও ঈদের পোশাকের এই গল্প আজকের নয়, এর শিকড় ইসলামের ১৪ শতাব্দীর ইতিহাসে। কীভাবে পোশাক বদলেছে? কীভাবে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা একসঙ্গে হেঁটেছে? আর আজকের অর্থনৈতিক সংকটে কীভাবে আমরা ঈদের আনন্দ ধরে রাখছি? এই গল্প আমাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর অদম্য উৎসবমুখরতার।
পোশাকের প্রাচীন যাত্রা
মানুষের ইতিহাসে পোশাকের গল্প প্রায় তিন লাখ বছরের পুরোনো। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বছর আগে মরক্কোর তামারা শহরের একটি গুহায় প্রাচীন মানুষ পশুর চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি করত, যা ঠান্ডা থেকে তাদের রক্ষা করত। আই সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, গুহায় পাওয়া পশুর হাড়ে কাটার দাগ ছিল, যা আধুনিক চামড়া ছাড়ানোর কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়। তখন পোশাক ছিল বেঁচে থাকার উপায়; কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি উৎসবের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনের বেথলেহেমে পাওয়া ‘আশিকা আইন সাখরি’ নামের প্রায় ৯ হাজার বছরের প্রাচীন একটি মূর্তি দেখায়, প্রাচীন মানুষ উৎসবের জন্য বিশেষ পোশাক পরত। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্যানুসারে, এই মূর্তিতে প্রেমিক-প্রেমিকা চামড়ার তৈরি অলংকৃত পোশাকে সজ্জিত। প্রাচীন মিসরের মধ্য রাজ্যের (মিডল কিংডম) সময়ে (খ্রিষ্টপূর্ব ২০৫৫-১৬৫০) ‘হেব-সেদ’ উৎসবে রাজা আমুনের কাছ থেকে যৌবনের আশীর্বাদ নিতেন। রানি নেফারতিতি সাদা প্রশস্ত হাতার পোশাক পরতেন, যা তৎকালীন নারীদের সাধারণ পোশাক থেকে আলাদা ছিল। ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়ায় এ তথ্য পাওয়া যায়।
ফিলিস্তিনের বেথলেহেমে পাওয়া ‘আশিকা আইন সাখরি’ নামের প্রায় ৯ হাজার বছরের প্রাচীন একটি মূর্তি দেখায়, প্রাচীন মানুষ উৎসবের জন্য বিশেষ পোশাক পরত।আরও পড়ুনজান্নাত লাভের পথ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় বাতলে দিলেন রাসুল (সা.)১৮ এপ্রিল ২০২৪
ইসলামে পোশাকের নতুন রূপ
ইসলামের আগমন পোশাকের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করল। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, আমরা তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সৌন্দর্য বাড়ায়।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৬)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা সুন্দর পোশাক পরো এবং চেহারা সুন্দর করো। কেননা, আল্লাহ সুন্দর এবং সৌন্দর্য পছন্দ করেন’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,০৩১)। এই শিক্ষা পোশাককে শুধু কার্যকর নয়, সৌন্দর্য ও শালীনতার প্রতীক বানিয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে পোশাক ছিল সাধারণ। ঈদ ও জুমার নামাজে মুসলমানরা তাদের সেরা পোশাক পরতেন। ইসলাম যখন মিসর, সিরিয়া ও ইরানে ছড়িয়ে পড়ল, তখন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব পোশাককে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। অ্যারাব ড্রেস বইয়ে বলা হয়েছে, মিসর থেকে আসত ‘কিবাতি’ নামে উৎকৃষ্ট কাপড়, যা কাবার কিসওয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।
উমাইয়া ও ফাতেমি যুগের ঐশ্বর্য
উমাইয়া যুগে পোশাক বিলাসবহুল হয়ে ওঠে। তারিখুল আযইয়া গ্রন্থে বলা হয়, তারা রোমান স্টাইলের পোশাক পরলেও পাগড়ি ও তলোয়ার ধরে রাখত। তাদের পোশাকে ছিল রঙিন সূচিকর্ম। ফাতেমি যুগে এই বিলাসিতা চরমে পৌঁছায়। খলিফা মুয়িজ লি-দিনিল্লাহ ‘দারুল কিসওয়া’ নামে একটি কারখানা তৈরি করেন, যেখানে শাসকদের জন্য সোনা ও রুপার সুতা দিয়ে পোশাক তৈরি হতো। এই পোশাকগুলোতে ১২টি অংশ থাকত এবং সাধারণ কর্মচারীরাও এগুলো পেতেন।
ঈদুল ফিতরে খলিফারা সোনার সুতার পোশাক ‘বাদনা’ ও রত্নখচিত পাগড়ি পরতেন। ঈদুল আজহায় লাল পোশাক পরা হতো। কারণ, এটি কোরবানির সঙ্গে যুক্ত। ফাতেমি খলিফারা ঈদে জনগণের মধ্যে পোশাক বিতরণ করতেন, যার কারণে ঈদুল ফিতর ‘ঈদুল হুল্লা’ নামে পরিচিত ছিল।
খলিফা মুয়িজ লি-দিনিল্লাহ ‘দারুল কিসওয়া’ নামে একটি কারখানা তৈরি করেন, যেখানে শাসকদের জন্য সোনা ও রুপার সুতা দিয়ে পোশাক তৈরি হতো।আরও পড়ুনমানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও পরিণতির পথ১৩ মে ২০২৫মামলুক যুগে ফ্যাশনের উত্থান
মামলুক যুগে ঈদের পোশাক আরও বৈচিত্র্যময় হয়। ইতিহাসবিদ মকরিজি তার আল মুজতামাউল মিসরি ফি আসরি সালাতিনিল মামলুক গ্রন্থে লিখেছেন, সাধারণ মানুষ ঈদের আগে রাত জেগে পোশাক সেলাই করতেন। এই যুগে ফ্যাশনের ধারণা এল। উচ্চবিত্ত নারীদের বিলাসবহুল পোশাক সাধারণ নারীরা অনুকরণ করতেন। সরকার কখনো অতিরিক্ত লম্বা হাতার পোশাক নিষিদ্ধ করলেও নতুন ফ্যাশন ছড়িয়ে পড়ত।
আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ
উসমানীয় যুগে পোশাকের ধরন খুব বেশি বদলায়নি। পুরুষরা কাফতান আর নারীরা ‘ইয়েলিক’ নামের জ্যাকেট পরতেন। শিল্পবিপ্লবের পর পোশাক তৈরি সহজ ও সস্তা হলো। ২০ শতকে পশ্চিমা ফ্যাশনের প্রভাব এলেও ঈদে ঐতিহ্যবাহী পোশাক জনপ্রিয় রইল। বাংলাদেশের গ্রামে এখনো নারীরা রঙিন শাড়ি বা সালোয়ার–কামিজ পরেন; আর পুরুষরা পাঞ্জাবি বা পাজামায় সেজে ওঠেন।
আরও পড়ুনবিপদের সময় বলতে হবে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ঈদের পোশাক আমাদের ইতিহাস ও বিশ্বাসের প্রতীক। ইসলামের শুরু থেকে আজ অবধি, পোশাক বদলেছে; কিন্তু এর পেছনের আবেগ একই নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন।কিন্তু আজকের অর্থনৈতিক সংকট ঈদের আনন্দে ছায়া ফেলছে। নতুন পোশাক কেনা অনেক পরিবারের জন্য কঠিন। এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত পোশাকের বাজার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ড. মুহাম্মদ আহমদ ইবরাহিম তাতুরুল মালাবিস ফিল মুজতামায়ির মিসরি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ফাতেমি যুগের ‘মুস্তানসিরিয়া সংকটে’ও এমন বাজার ছিল, যেখানে ব্যবহৃত পোশাক বিক্রি করা হতো। বাংলাদেশে ঢাকার গাউছিয়া বা চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত পোশাক পাওয়া যায়, যা ঈদের আনন্দ ধরে রাখতে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সহায়ক হয়েছে।
ঈদের পোশাক আমাদের ইতিহাস ও বিশ্বাসের প্রতীক। ইসলামের শুরু থেকে আজ অবধি, পোশাক বদলেছে; কিন্তু এর পেছনের আবেগ একই—নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ ঈদের হাসি ধরে রেখেছেন। নতুন হোক বা পুরোনো, ঈদের পোশাক আমাদের শিকড়ের কথা মনে করায় এবং ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায়।
আলজাজিরা ডটনেট অবলম্বনে
আরও পড়ুনঈদুল আজহা ও হজ যখন প্রতিবাদের ক্ষেত্র১২ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঈদ র প শ ক প শ ক পরত প শ ক পর ইসল ম র উৎসব র আম দ র স ন দর র জন য আনন দ পরত ন
এছাড়াও পড়ুন:
পূজাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।
সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য।
সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।
দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।
এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।
এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।