গাজায় গণহত্যায় যুক্তরাজ্য যেভাবে মদদ দিচ্ছে
Published: 5th, June 2025 GMT
২০০৩ সালে বাগদাদে ১৩ বছর বয়সী হুসসাম এবং ১৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ মারা গিয়েছিল বিমান থেকে ফেলা ক্লাস্টার বোমায়। বোমাগুলো যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল।
আর ব্রিটিশ সরকারের সমর্থিত সামরিক অভিযানে সেগুলো ফেলা হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধে হুসসাম ও মুহাম্মদের মতো প্রায় দুই লাখ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধের পর অনেক বছর ধরে সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা নিয়ে তদন্তের যত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সরকার তার সব কটি ঠেকাতে চেষ্টা করেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থামানো সম্ভব হয়নি। ২০১৬ সালে চিলকট তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আমি তখন লেবার পার্টির নেতা ছিলাম। রিপোর্টে ব্রিটিশ সরকারের ভেতরকার ভয়াবহ ভুলের প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় আমি পার্লামেন্টে চিলকট তদন্তের প্রতিক্রিয়ায় বক্তব্য দিয়েছিলাম।
বক্তব্য শেষে আমি পাশের চার্চ হাউসে যাই। সেখানে আমরা যুদ্ধফেরত সেনা, ইরাকি নাগরিক এবং নিহত ব্রিটিশ সেনাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমি সেখানে ইরাকে যুদ্ধ করার দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলাম। আজ ইতিহাস আবারও যেন ঘুরে এসেছে এবং লেবার সরকার আরেকটি ভয়াবহ ভুল করছে।
আরও পড়ুনইসরায়েল, গাজা এবং পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা০৪ মার্চ ২০২৪২০ মাস ধরে চালানো ইসরায়েলি হামলায় গাজার নিহতের সংখ্যা ৫৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যারা বেঁচে আছে, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আজীবন শারীরিক ও মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াবে। ইসরায়েল একা একাই সব করছে না। তারা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা পাচ্ছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর ব্রিটেনে সরকার বদলালেও ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ একই রকম আছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য সরকার বলেছিল, ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদনের কিছুটা বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু তার কিছুদিন পরই, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে লেবার সরকার ইসরায়েলে যত অস্ত্র দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে, তা ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কনজারভেটিভ সরকার যতটা দিয়েছিল, তার চেয়েও বেশি।
আমরা অনেকবার বলেছি, ব্রিটেন এখনো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ ইসরায়েলে পাঠাচ্ছে—এটা খুবই দুঃখজনক। আমি অবাক হচ্ছি, সরকার নিজেই বলছে, অস্ত্র রপ্তানির ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও তারা ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে এই যন্ত্রাংশ পাঠানো চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যতিক্রম কি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা ঠেকানোর দায়িত্ব থেকেও ছাড় পাচ্ছে?আরও পড়ুনইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে০৮ এপ্রিল ২০২৫আমরা অনেকবার বলেছি, ব্রিটেন এখনো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ ইসরায়েলে পাঠাচ্ছে—এটা খুবই দুঃখজনক। আমি অবাক হচ্ছি, সরকার নিজেই বলছে, অস্ত্র রপ্তানির ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও তারা ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে এই যন্ত্রাংশ পাঠানো চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যতিক্রম কি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা ঠেকানোর দায়িত্ব থেকেও ছাড় পাচ্ছে? আমরা বারবার জানতে চেয়েছি, সাইপ্রাসে অবস্থিত ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলোর ভূমিকা কী ছিল? ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র পৌঁছানো এবং সামরিক গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহে এই ঘাঁটিগুলোর কোনো ভূমিকা আছে কি?
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কিয়ার স্টারমার যখন সাইপ্রাসের আরএএফ আকরোটিরি ঘাঁটি পরিদর্শনে যান, তখন তাঁকে ক্যামেরায় সেনাদের উদ্দেশে বলতে দেখা গেছে, ‘পুরো বিশ্ব তোমাদের ওপর নির্ভর করছে এবং আমাদের দেশের মানুষও তোমাদের ওপর নির্ভর করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে অনেক কিছুই হয়, যা সব সময় প্রকাশ করা যায় না…আমরা সব সময় বলতে পারি না, এখানে কী হচ্ছে।’ তাহলে সরকার কি লুকাতে চায়?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫আমাদের এসব প্রশ্নের জবাবে আমরা শুধু এড়িয়ে যাওয়া এবং নীরবতাই পেয়েছি। ফলে সরকারের দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলো কীভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, তা মানুষ জানতে পারছে না। অথচ গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি। ব্রিটিশ জনগণ জানার অধিকার রাখে যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা কতটুকু।
এ কারণেই আমি একটি প্রাইভেট মেম্বার্স বিল (এমপিদের ব্যক্তিগত বিল) পেশ করতে যাচ্ছি। তাতে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলায় যুক্তরাজ্যের ভূমিকা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বজনীন ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানানো হবে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার সত্যতা উদ্ঘাটন করা এই তদন্তের লক্ষ্য থাকবে।
এই তদন্তের মাধ্যমে জানতে হবে, ঠিক কী ধরনের অস্ত্র ইসরায়েলের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে; এর কোন কোন অস্ত্র ফিলিস্তিনিদের হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছে; সরকার কী ধরনের আইনি পরামর্শ পেয়েছে; আরএএফ আকরোটিরি ঘাঁটি গাজায় অস্ত্র পাঠানোর রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কি না; যুদ্ধক্ষেত্রের কী কী ভিডিও ফুটেজ সরকারের কাছে আছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে কী ধরনের গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করা হয়েছে।
জেরেমি করবিন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য ও লেবার পার্টির সাবেক প্রধান
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর জ য র ইসর য় ল র তদন ত র সরক র র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
তাপমাত্রা বেড়ে দেশের ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা, কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের দিনমজুর পারভিন আক্তার (৪৭)। তিনি এই বাজারে আলুর একটি আড়তে কাজ করেন। বসে বসে আলু বাছাই করা তাঁর কাজ। প্রতিদিন পান ৬০০ টাকা। সংসারে অসুস্থ স্বামী। তবে তিনি মাঝেমধ্যে রিকশা চালান। স্বামীর আয় নিয়মিত নয়। তাঁদের মেয়ে ও এক ছেলে সঙ্গে থাকে। মেয়েটির আবার দুটি সন্তান আছে। পুরো পরিবারটি পারভিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
গত এপ্রিল থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নিজে অন্তত দুই বার এবং মেয়ে ও তাঁর ছেলেটি তিন বার করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পারভিন কাজে গেলে টাকা পান, না গেলে নেই। এভাবে অসুখের কারণে এ বছর ১১ দিন কাজে যেতে পারেননি, স্মরণ করে বলেন পারভিন। কারওয়ানবাজারে কাজের যে পরিবেশ, সেখানে গরমে ঘামতে হয়। কয়েক বছর ধরে গরমটা অসহনীয় বলে মনে হয় তাঁর কাছে।
পারভিন বলছিলেন, ‘ঘাম শরীরে বইসা অসুখ বাধায়। গরম এত বাড়ছে যে কওনের কথা নাই।’
পারভিনের মতো এমন অসংখ্য মানুষের এভাবেই গরমের কারণে কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। এই তো গত বছরেই (২০২৪) ২১ হাজার কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটির নাম ‘অ্যান আনসাস্টেইনেবল লাইফ: দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ।’ এতে ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সঙ্গে আছে ২০২৪ সালে করা একটি বড় জরিপ, যেখানে দুই ধাপে ১৬ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশ্ন করা হয়।
১৯৮০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১°ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এ সময় গরমের অনুভূতি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫°ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এ সময়ে ঢাকার গরম বেড়েছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকার গরম জাতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। এর ফলে ডায়রিয়া, দীর্ঘ কাশি, শ্বাসকষ্ট আর প্রচণ্ড অবসাদ—এসব রোগ বেড়েছে।
অধ্যাপক আবদুস সালাম তাঁর একাধিক গবেষণায় দেখিয়েছেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে দূষণের সম্পর্ক আছে। তিনি বলছিলেন, বিশেষ করে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কয়েকটি ক্ষতিকর গ্যাস। এর মধ্যে আছে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই–অক্সাইড ও মিথেন।গরমের প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে। ২০২৪ সালে গরমের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ মিলিয়ন কর্মদিবস (আড়াই কোটি দিন) নষ্ট হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার এবং প্রতিবেদনের সহলেখক ইফফাত মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অতিরিক্ত গরমে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এবং এর সঙ্গে সরাসরি উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও ঘটছে। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও মানবসম্পদ ও উৎপাদনশীলতা হারানোর বাস্তব ঝুঁকির মুখে।’
আরও পড়ুনতাপমাত্রা এত বাড়ছে কেন?২১ এপ্রিল ২০২৪প্রখর রোদে ছাতা মাথায় মাঠের মধ্যে ধান শুকাচ্ছেন এক গৃহবধূ। কাইমউদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গী, নর্থ চ্যানেল, ফরিদপুর