‘জঙ্গল বন্ধের মধ্যে আইছে ঈদ, দুই বেলা ভাতই জোটে না ঈদের আনন্দ করব ক্যামনে’
Published: 7th, June 2025 GMT
‘বন্ধের জন্যি জঙ্গলে মাছ ধরতি যাতি পারিনে। সরকারের থেইকে সাহায্য-সহযোগিতাও পাইনি। আয়রোজগার নেই, হাত খালি। পরিবার নিয়ে খাইয়ে না খাইয়ে আছি। এখন আবার বন্ধের মধ্যে আইছে ঈদ, দুই বেলা ভাতই জোটে না ঈদের আনন্দ করব ক্যামনে। ছোট ছাওয়াল–মাইয়ে নতুন কাপড়ের জন্যি কান্দে। খুব বিপদের মধ্যে আছি।’
শুক্রবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি এলাকার জেলেপল্লিতে এ কথাগুলো বলছিলেন বনজীবী জেলে ইমদাদুল গাজী। ১ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এই সময়ে সরকারি কোনো সহায়তা না পাওয়ায় ঈদের আগমুহূর্তে পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
শুধু ইমদাদুল গাজী নন, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ বনজীবী পরিবারের অবস্থাই এখন এমন। সংসারের চাকা ঘুরছে না। ধারদেনা করেই চলছে দিন। ঈদের সময়ও স্বস্তির মুখ দেখেনি তারা।
মঠবাড়ি গ্রামের জেলে মজিবর গাইন বলেন, ‘সুন্দরবন বন্ধ থাকায় সাতজনের পরিবার নিয়ে ধারদেনা করে চলছি। আজ সকালেও ৫০০ টাকা ধার করে চাল কিনেছি। বাচ্চাদের একটা জামাকাপড় কিনে দেব, ঈদের দিনে একটু ভালোমন্দ খাওয়াব, এই সামর্থ্য আমার নেই। তবে এই অবস্থা শুধু আমার একার নয়, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বেশির ভাগ মানুষের।’
বন বিভাগের তথ্য বলছে, সুন্দরবনের সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (আইআরএমপি) অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাস মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। ২০২২ সালে তা ১ জুন থেকে বাড়িয়ে তিন মাস করা হয়। এখন ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে, সেই সঙ্গে পর্যটক ও বনজীবীদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা থাকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তখন প্রত্যেক জেলেকে সরকারিভাবে ৮০ কেজি চাল দেওয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবনের জেলেদের জন্য তেমন সহায়তা নেই। ফলে নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে মানবেতর অবস্থায় পড়েন তাঁরা।
কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার বনজীবী জেলে আবদুল আহাদ বলেন, ‘সুন্দরবনে পাস বন্ধ। ডাঙায়ও কাজ নেই। বেকার বসে আছি। সংসার চলছে ধারদেনায়, খুব কষ্টে। ঈদে আমাগে কোনো উপায় নেই। চিনি-সেমাই যতটুকু হোক, গোশত তো চোখে দেখব না। আমাগের কাছে ঈদের দিন আর অন্যদিন একই সমান।’
কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৫। তবে স্থানীয় বনজীবীরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। ভৌগোলিক কারণে কয়রার পাঁচটি ইউনিয়নের অধিকাংশ পরিবারই বননির্ভর। কয়রায় অন্তত ৫০ হাজার বনজীবী পরিবারের বাস, যারা নদী ও খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরেই জীবন চালায়।
সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ থাকায় লোকালয়ের পাশের নদীতে নৌকায় বসে চিংড়ির রেণু আহরণের চেষ্টা করছেন কয়েকজন। শুক্রবার কয়রা উপজেলার কাটকাটা গ্রামসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীতে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র পর ব র উপজ ল বনজ ব
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’