রাজার অবর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে এই দোলাচল সেই ১৯৪৭ হতেই। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তানের দুই অংশের দুই প্রধান নেতা দুই রকম অবস্থানে গেলেন। ভারতে মহাত্মা গান্ধী জাতির পিতা বা ‘বাপুজি’ হয়ে দূরে থাকলেন সরকার থেকে। গান্ধীজি সরকারে না থাকায় রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চর্চা প্রথম থেকেই শুরু হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ জাতির পিতা কায়েদে আযম হয়ে রাষ্ট্রপ্রধানও হন এবং লিয়াকত আলি খান হন প্রধানমন্ত্রী। জাতির পিতার মাহাত্ম্যে পাকিস্তানে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দুই দেশের কোনোটিরই নিজস্ব সংবিধান না থাকায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিধানমতে দুই দেশের সরকার পরিচালিত হতে থাকে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৩ মাসের মাথায় মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যু ঘটলে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সুসংহত করার মানসে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে রাষ্ট্রপ্রধান বা গভর্নর জেনারেল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান অনেক বড় মাপের নেতা হওয়ার ফলে গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলি খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে পরদিন খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন এবং লিয়াকত মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী মালিক গোলাম মুহাম্মদ গভর্নর জেনারেল হন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, খাজা সাহেব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গভর্নর জেনারেল শক্তিধর হয়ে ওঠেন এবং ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। দেখা যাচ্ছে, আইন নয়, পদাধিকারীর ব্যক্তিত্বই মুখ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকলেও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের আরাধ্য সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার তাগিদে তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি; অন্যদিকে জাতির পিতার অবস্থান সবার ওপরে। এই দোদুল্যমানতায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সমীকরণে মিল না হওয়ায় ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগের পর জাতীয় সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ ১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হন। এবার রাষ্ট্রপতি
ও প্রধানমন্ত্রীর সমীকরণ আরও বেশি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
এক বৎসরের মাথায় আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে সরে আসে; বাকশালের আওতায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যে দু’জন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তারা দু’জনই নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হন।
বাকশাল গঠনের পর থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত দেশে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রচলিত ছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও সবার স্পৃহা হয়ে ওঠে সংসদীয় গণতন্ত্র। নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া; রাষ্ট্রপতি হন তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য আব্দুর রহমান বিশ্বাস। আবারও শুরু হয় বাকশালপূর্ব সিনড্রোম। কথিত আছে একদা প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করলে রাষ্ট্রপতি গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিতে উদ্যোগ নেন। প্রটোকলের কারণে
তাঁকে নিবৃত্ত করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে এসে দেখা করেন।
পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দৃঢ়চেতা রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বাসনায় আওয়ামী লীগ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি করে। কিন্তু জননিরাপত্তা আইনের বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে অনাগ্রহের ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ পর্যায়ে যায়। সৌভাগ্য যে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দল, সংসদ বা সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ডা.
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ভারত সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতার বর্মাবৃত থাকায় ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকেননি। দিল্লি বিমানবন্দরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে উপস্থিত থেকে সাদরে বরণ করার ফলে রাষ্ট্রপতির ফিরে আসার সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এবং রাষ্ট্রপতিকে উষ্ণ আলিঙ্গন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অকালে পদত্যাগ না করলে হয়তোবা দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি পদে একটি প্রতিশ্রুতিশীল ঐতিহ্যের ধারা সৃষ্টি হতে পারত।
সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের পারস্পরিক সম্পর্ক দীর্ঘ চর্চার ফসল। আমরা সেভাবে সম্পর্কটির চর্চা করিনি। এখন যেমন রাষ্ট্রপতির হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার আলোচনা চলছে, তাতে পাকিস্তানে দু’দুবার ঘটে যাওয়া জনপ্রিয় সরকারকে পদচ্যুতির পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে না ঘটার নিশ্চয়তা কে দেবে? বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বা ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকলে দেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই জন্ম দেয় স্বৈরশাসনের, রাজসিক মানসিকতার। সেই রাজসিক মানসিকতা থেকেই মালিক গোলাম মুহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করার পরে ১৯৫৫ সালে গণপরিষদ প্রস্তাবিত সংবিধানে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়ায় গণপরিষদই ভেঙে দেন।
রাজার অস্তিত্ব সমৃদ্ধ যুক্তরাজ্য, জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশ ছাড়া অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে সরকার ও রাজার প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দীর্ঘ চর্চার ধারাবাহিকতায়। সেখানে দেশটাই রাজার, সরকারও রাজার। রিপাবলিকে তা নয়। রিপাবলিকে দেশের মালিক জনগণ, জনগণ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংসদের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হলে তাঁকে রাজা বানিয়ে ফেলার নামান্তর হয়ে যাবে না তো?
রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তে সংসদ ভেঙে দেওয়ার অর্থ দাঁড়াবে জনগণের প্রতিপক্ষ হওয়া। তা হবে ‘এক ঘরমে দো পীর’; যা কখনোই শুভ হয় না, হতে পারে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য ‘করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুস ঢাস’ ধরনের রাষ্ট্রপতিই লাগসই। ব্যতিক্রম কিছু করতে হলে হোক না অন্যরকম কিছু! সংসদে সরকারি দলের প্রধান নেতা সরকারের কোনো পদে না গিয়ে থাকুন অভিভাবক হিসেবে! যে নজির সৃষ্টি করে গেছেন মহাত্মা গান্ধী।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সূচনায় তেমনটি হলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। তাতে করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো অহমের সংঘাত হতো না। এমনকি যেহেতু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাউকে ভরকেন্দ্র ধরে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হবেন না, তাই তাদের কারও সম্ভাবনা থাকবে না স্বৈরশাসক হওয়ার, রাজ
রাজর্ষি হওয়ার।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ শ খ ম জ ব র রহম ন র র ষ ট রপত র ষ ট রপত র স ঈদ চ ধ র ম হ ম মদ পদত য গ ব চ রপত ল য় কত ন র পর হওয় র সদস য ক ষমত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন না হওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে: আমীর খসরু
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র জনগণ প্রতিহত করবে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত সংসদ হবে। এটি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
আজ শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের মেহেদীবাগ এলাকায় নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-১০ আসনের শুলকবহর ও ৪২ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দ্রুত দেশে ফিরবেন। মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। তারেক রহমানের রাজনীতি এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য। জনগণের প্রত্যাশা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন তিনি।
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে আমীর খসরু তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই নির্বাচন বাংলাদেশের, গণতন্ত্রের বাঁচা–মরার সংগ্রাম। জনগণ ভোট দিলে সরকার গঠন করে প্রথম দিন থেকে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করবে বিএনপি। হাতে সময় নেই, মানুষের ধৈর্য নেই। পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক কোটি লোকের চাকরি দিতে হবে ১৮ মাসে। এই ওয়াদা পূরণ করতে হলে বিনা মূল্য প্রাথমিক পাঁচটি সেবা দিতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে পরিবার কার্ডের মাধ্যমে। কৃষকের ক্ষমতায়ন করবে কৃষক কার্ড।
তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রের পথ থেকে বিএনপি কখনো বিচ্যুত হয়নি। আওয়ামী লীগ একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল, শহীদ জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শ, বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ তারেক রহমানের আদর্শের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।
মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী বেলাল, সদস্য মামুনুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, বিএনপি নেতা আশরাফ চৌধুরী, গোলাম কাদের চৌধুরী, নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব জমির উদ্দিন, শুলকবহর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শামসুল আলম, ৪২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শায়েস্তা উল্লা চৌধুরী প্রমুখ।